চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

সংস্কৃতিচর্চায় তরুণদের জাগাতে হবে

আহমেদ ইকবাল হায়দার

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ | ১২:১১ অপরাহ্ণ

মুসলিম ইনস্টিটিউটে বিশাল এক অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু নির্মাণ শেষে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে সেটা বলা যাচ্ছে না। পুরো কমপ্লেক্স নির্মাণে বরাদ্দ ২শ ৮১ কোটি টাকা। প্রথমে ২ শ ৩২ কোটি টাকা ছিল। এখন বাড়তে বাড়তে ২শ ৮১ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শহীদ মিনার থেকে শুরু করে নির্মাণাধীন হলগুলোর অবস্থা কী অনেকেই জানেন। আমি নিজ উদ্যোগে ঢুকে দেখেছি। ওদের বিরাগভাজন হয়েও কিছু কিছু ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে সেটা আরও জঘণ্য হয়েছে। বিশাল বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে কিন্তু কতটুকু থিয়েটার উপযোগী হবে সেটা বলা যাচ্ছে না।

শিল্পকলা একাডেমির এক ফোরামে আমি বলেছিলাম, রংপুর বা অন্য কোন জায়গায় একটা হলের ভাড়া হচ্ছে ১৬ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ থিয়েটারের জন্য ঢাকার জাতীয় নাট্যশালার ভাড়া ৫ হাজার টাকা, সাথে ১৫% ভ্যাট। সেখানে রংপুর, পাবনা বা বরিশালসহ বিভিন্ন জায়গায় এত বেশি টাকা কেনো নেওয়া হয়। তখন ওই সময়কার প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ভাড়া তো নির্ধারণ আছে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা। বাকিটা ইলেক্ট্রিসিটির চার্জ। এখন বিষয়টা হচ্ছে, তারা এমনভাবে তৈরি করে যেন পুরো হলে এসি চালাতে হয়। শীতকালে বেশিক্ষণ এসি চালাতে হয় না। কিন্তু যেহেতু পুরো রুমটা আবদ্ধ, সেহেতু কিছুটা সময় চালাতে হবে। নাহলে সাফোকেশন হবে। এগুলো কিছু মাথায় নেয়া হয়নি।

 

তারপর ডিজিটাল স্ক্রিন লাগিয়ে অনেক টাকা খরচ করা হয়। এসব করার পর অনেকেই ভাবে সংস্কৃতির জন্য অনেক কিছু করা হয়েছে, এই হয়েছে সেই হয়েছে। কিন্তু যারা সংস্কৃতি চর্চা করবে তাদের জন্য কিছুই হয়নি, কোন চিন্তাও নেই। মুসলিম হলে চারটা হল নির্মিত হচ্ছে। একটা বড় হলে নয়শ’ থেকে সাড়ে নয়শ’ দর্শক বসতে পারে। আরেকটা হচ্ছে এক্সপেরিমেন্টাল হল। সাড়ে তিনশো থেকে চারশো দর্শক চারদিকে বসতে পারবে। আর দু’টি সেমিনার হল। এর মধ্যে কৌশলে দুইশ’ সিটের হলে ঢুকে দেখেছিলাম ওটাতে সাংস্কৃতিক চর্চা করা যায় কিনা। নাটক বা বিভিন্ন কার্যক্রম যাতে করা যায় সেজন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম। অনেকগুলো নির্মাতারা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তারপরও হাইট কম।

 

এই চারটা হলেই কোন টয়লেট ও গ্রিনরুম নেই। যেটা চিন্তারও বাইরে। এ বিষয়ে সমালোচনা হওয়ার পর তিনটা হলে কোনভাবে টয়লেট ও গ্রিনরুম তৈরি করা হয়েছে। তবে একটা হলে করা যাচ্ছে না কোনভাবেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এক্সপেরিমেন্টাল হলের পুরোটা অকেজো স্থাপনা। এটা নিয়ে অনেকবার তর্ক হয়েছে। অনেক অনেক টাকা খরচ করা হয়েছে। সরকারের দোষ দেওয়া যায় না। কারণ তারা অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু সরকারকে এটাও ভাবতে হবে, যারা এই কাজটা করছে তাদের সামর্থ্য কতটুকু। এ বিষয়ে তাদের জ্ঞান কতটুকু।

 

এরপর বলা হয়েছে মুসলিম হলে ১৩টা মহড়াকক্ষ করা হয়েছে। পুরো চট্টগ্রাম শহরে যারা সংস্কৃতিমনা আছে সবাই বাহবা বাহবা করছে। কিন্তু বাস্তবতা কী? কোন একটা টয়লেটের পাশে একটা জায়গা ম্যানেজ করা দেয়া হলো। অথবা বড় হলের পাশে একটা জায়গা করে দিয়েছে। ওখানে নাকি রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হবে। যদি রাজনৈতিক অনুষ্ঠান চলে, যদি চিৎকার হয়, তখন রিহার্সালের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? এর মানে এখানে ওখানে খয়রাতের মতো কোনমতে জায়গা ম্যানেজ করে দেওয়া।

 

শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য মেয়র মহোদয় বিভিন্ন পরিকল্পনাবিদকে নিয়ে একটা কমিটি করে দিয়েছিলেন। যেটাতে আমি সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছি। কমিটি অনেক ভালো সাজেশন দিয়েছিল। শহীদ মিনারের মূল নকশা যিনি করেছেন, তাকে নিয়ে এসেছিলাম আমরা। তিনিই বলেছেন, ওনার নকশায় এটা ৫২ ফিট ছিল। কিন্তু নির্মাতারা জানিয়েছেন আর্থিক সমস্যায় এটি ছোট করা হয়েছে। তাই পরবর্তীতে এটিকে আবারও

৫২ ফিট করার জন্য আমরা শক্তি বা সাপোর্ট পেয়ে গেলাম। কারণ মূল নকশায় এটা ছিল। শুধু চট্টগ্রামেই নয়, সারা বাংলাদেশেই এ ধরনের অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ হচ্ছে।

 

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমাদের একত্রিত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমি দেখছি একত্রিত হলে আরও ক্ষতি হচ্ছে। কারণ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে যে, নির্দিষ্ট বিষয়ে যোগ্যতা না থাকা ব্যাক্তিটি সে কাজের চূড়ান্ত নির্দেশনা দিচ্ছেন। শহীদ মিনারের পিছনে একটা টেরাকোটার কাজ হয়েছে। যেটি নকশা করার জন্য অলক রায়দের মতো মানুষের কথা আমি বলেছিলাম। এখনও কিন্তু কেউ বলছে না এটার আসল নকশাটা কে করেছে। ওটা দেখলেই বুঝবেন কী অবস্থা। কারও কোন দায় দায়িত্ব নেই। জানানো হচ্ছে এটা মন্ত্রী অনুমোদন করেছেন। এ ধরনের বাহানা চলতেই থাকবে। সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে আমাদের যে সামান্য টাকাপয়সা দেয়া হয় তা নিয়ে কথা হয়। কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা যে অপচয় হয়েছে এগুলোর কোন ব্যাখ্যা নেই। এখন কথা হচ্ছে এসব যারা করছে, তারা কি জানে যে কোথায় কী করতে হবে? সমস্যাটা এখানে।

 

আরেকটা বিষয় হলো, আমি যে নাটক বা সংস্কৃতি চর্চা করছি, কেন করছি? মুক্তিযুদ্ধের পরে যখন গ্রুপ থিয়েটার শুরু হলো, তখন কিন্তু একটা লক্ষ্য স্থির ছিল। একটা আবেগ, আকাক্সক্ষা, লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হতো। এখন কিন্তু লক্ষ্যবিহীন। লক্ষ্য হচ্ছে প্রচারে যাওয়া। যার ফলে আমার লক্ষ্যটা তৈরি হচ্ছে না। আর থিয়েটার সবসময়ই হচ্ছে। তখনও ছিল, এখনও আছে। আমরা এখনও নিজের পয়সা খরচ করে নাটক করছি। এটা এভাবেই চলবে। কারণ আমি আমার টার্গেটটা তৈরি করতে পারিনি। আমি প্রচারে যাচ্ছি কিন্তু আমার দর্শক কারা?

 

যারা ছবি আঁকে, তারা কিন্তু ঠিক করে তার ছবিটা কারা কিনবে। তার সৃজনশীলতার সাথে একটা ক্লাস আছে। ফলে যদি তিন লাখ টাকা খরচ হয়, সে পাঁচ লাখ টাকা উপার্জন করার একটা প্রক্রিয়া করে। কিন্তু আমাদের সেটা নেই। আমার টার্গেটটা ঠিক করা নেই। আমার টার্গেট হওয়া উচিত দর্শকের অন্তরে কীভাবে যাবো।

সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হচ্ছে। আমি নিজেও শিল্পকলার সাথে জড়িত। শিল্পকলা পুরো বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করাতেই কিন্তু এগুলো হচ্ছে। পুরো বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে অনেকগুলো গানের স্কুল ও নাচের স্কুল ছিল। ওগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্পকলায় হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যাচ্ছে শুধু সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য। যার ফলে অনেক গানের স্কুল, নাচের স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেগুলো পুরনো সংগঠন, তাদেরও স্টুডেন্ট নেই। তারা কোনরকমে চলছে।

 

আমি নাটক করি। একটা নাটক লেখার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হলো অমুক নাট্যকার তমুকের কাছে। তিনি হয়তো ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে একটা লিখে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি কী দিচ্ছেন? একটা নাটক লিখতে গেলে তো আমার একটা ফিলোসোফি থাকে। নাট্যকার তো একটা ভাবনা নিয়ে নাটকটা লিখে। আমি এই নামটা কেন চয়েস করেছি, এর পিছনেও আমার একটা ভাবনা আছে। কিন্তু এখন কী হচ্ছে? নাটকে কোন কন্টেন্ট নেই। আমাকে একটা ফরমায়েশি বিষয় দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি। এ ছাড়া বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে পুরো বাংলাদেশের থিয়েটার ব্যর্থ হয়ে গেলো, তা তো হতে পারে না। এজন্য আমার মনে হয় কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ না করে ইনডিভিজুয়ালি আমাদেরকে দেখতে হবে।

 

আমরা যে সংস্কৃতিচর্চা করি, সেটা কেন করি, তার উদ্দেশ্য কী, এটা যদি জানা থাকে, তাহলে আমি অবকাঠামো বা অন্য কী পেলাম আর কী পেলাম না, সেটা কোন প্রভাব ফেলে না। এজন্য আমার কাছে মনে হয় আমি আগে আমার লক্ষ্যটা নিয়ে পরিষ্কার হই বা আমার আকাক্সক্ষাটা স্ট্রং করি। সেটার জন্য চট্টগ্রাম একদম উর্বর জায়গা ছিল, এখনও হতে পারে। কারণ চট্টগ্রামে তারুণ্যের আধিক্য ছিল। এখনও তারুণ্যের আধিক্য আছে। সেটাকে কোথাও গিয়ে আমাদের হিট করতে হবে বা জাগাতে হবে।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট