চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রশাসন চাইলে তিন মাসেই শৃঙ্খলা ফিরবে গণপরিবহনে

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ | ১২:২৫ অপরাহ্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখান এবং বাস্তবায়নও করেন। তিনি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ ছিল বাংলাদেশ। এরপর তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়েছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করেছেন। এখন প্রধানমন্ত্রীর ভিশন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার। আর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে সবাই চলনে-বলনে স্মার্ট হতে হবে। গণপরিবহনের ক্ষেত্রেও তাই প্রশাসনসহ সর্বস্তরের মালিক-শ্রমিককে এ লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো নগরে পরিবহন ব্যবসা এবং শৃঙ্খলা ফেরানোর প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ ও পুলিশ প্রশাসন। চট্টগ্রাম শহরে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে, তা চলতে থাকলে হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে গণপরিবহনের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে।

পরিবহনে যে অনিয়মগুলো হচ্ছে, সমস্ত অনিয়মের পেছনে প্রশাসন জড়িত। চট্টগ্রামে রাস্তার পাশে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা নেই। এরা সাইনবোর্ড দিয়েছে বাস দাঁড়াবে। কিন্তু আগে থেকেই ভ্যানগাড়ি, প্রাইভেটকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে গণপরিবহন যে জায়গায় দাঁড়ানো দরকার, সে জায়গায় দাঁড়াতে পারে না। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায়। আবার কোথাও কোথাও বাসস্টপেজের স্থাপনা মাদকাসক্তরা কেটে নিয়ে গেছে। সেখানে সাইনবোর্ডও নেই। মোটামুটি অব্যবস্থাপনার মধ্যে আছে।

 

চট্টগ্রাম শহরে গাড়িগুলো কালুরঘাট থেকে পতেঙ্গা সি-বিচ যায়। তাহলে সেখানে বিশ্রামের জন্য একটা টার্মিনাল প্রয়োজন। আমি পরিবহন ব্যবসায় প্রায় ২৩-২৪ বছর। এ সময়ের মধ্যে প্রশাসনের প্রতিটি বৈঠকে আমি সিটি এলাকার জন্য একটা টার্মিনাল দাবি করে আসছি। অদ্যাবধি হয়নি। আমার মৃত্যুর পরও হয় কিনা জানি না। বাংলাদেশে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা কখন হবে কেউ জানে না। অথচ পৃথিবীর সব দেশে আছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল ভুটানে রয়েছে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা। আমাদের চেয়ে গরিব দেশেও আছে। উন্নত দেশের সাথে তুলনা করলে আমাদের ট্রাফিক বিভাগের দুরবস্থা ভেসে ওঠে।

 

এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে না। এটা আমাদের জন্য খুবই লজ্জার বিষয়। প্রত্যেকটা মোড়ে মোড়ে ৪-৫ জন করে ট্রাফিক সার্জেন্ট ও কনস্টেবল থাকে। তারা হাতে সিগন্যাল দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবে। রৌদ্রে শুকাবে, বৃষ্টিতে ভিজবে। সার্জেন্ট মোটরসাইকেল নিয়ে বসে থাকবে। এতে লাভ তাদেরই। ট্রাফিক ব্যবস্থা আধুনিক হোক- এটা তারা চায় না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিকরা কোন গাড়িতে ডকুমেন্টস নেই, কোন গাড়ি ঢাকা মেট্রো, কোন গাড়ি পুরনো ঝকঝকে, সেটা তারা চিহ্নিত করবে। এরপর একজন ট্রাফিক গিয়ে গাড়িটি সাইড করবে, যাতে টাকা আয় করতে পারে। এটা তাদের কাছে তথাকথিত স্বভাব হয়ে গেছে।

 

রাস্তার পাশে হকার বসে থাকার পেছনে ইন্ধনদাতা হচ্ছে প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী। যারা সরকারের দিকনির্দেশনা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। তারা চায় না আধুনিক ব্যবস্থাপনা চালু হোক। রাস্তার পাশে যে হকাররা ভ্যানগাড়ি নিয়ে ব্যবসা করে, তাদের কাছ থেকে মাসিক টাকা তোলে থানার ক্যাশিয়ার, থানার বাবুর্চি, থানার রাইটার। এদেরকে বসার সুযোগ তারাই করে দেয়। একদিকে রুট পারমিটবিহীন গাড়ি চলার জন্য সার্জেন্টরাই মাসোহারা আদায় করে, অন্যদিকে বৈধ গাড়িগুলোকে আইনের গ্যাঁড়াকলে ফেলে বিভিন্ন ধারায় মামলা দিয়ে দেয়। আর তাই সবাই বলে, আকাশের যত তারা পুলিশের কাছে তার চেয়ে বেশি ধারা।

 

যে গাড়িগুলোর কোন ডকুমেন্টস, পারমিট নেই কিন্তু পুলিশের সাথে মাসিক চুক্তি আছে, সেগুলো নির্বিঘেœ রাস্তায় চলতে থাকে। এটাই হচ্ছে চট্টগ্রামের পরিবহন ব্যবস্থা। আমরা এই চট্টগ্রামকে নান্দনিক চট্টগ্রাম, বাণিজ্যিক চট্টগ্রাম, প্রাচ্যের রাণী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন নামে অভিহিত করি। কিন্তু বাস্তবতা হলো শুধুমাত্র চট্টগ্রাম শহরে অটো-টেম্পোর যে নৈরাজ্য সেটা নিয়ন্ত্রণের কোন উদ্যোগ দেখি না। বিভিন্ন সমিতির নামে রুট পারমিট নেয়া হচ্ছে।

 

একটা সময় ছিল মালিক ও শ্রমিক সমিতি। মালিক সমিতি হচ্ছে মালিকদের সংগঠন। কিন্তু এখন হয়ে গেছে সমিতির মালিক। যাদের কোন গাড়ি নেই। যারা কোন পরিবহনের মালিকও না, তারা একেকটা সমিতির মালিক। মালিক হয়ে সে তার পেশিশক্তি দিয়ে মানুষের সাথে সখ্যতা করে, প্রশাসনের সাথে সখ্যতা করে, আর একটা সাইনবোর্ড লাগায় সমিতির। একটা রুটে সে স্টিকার লাগায়। পারমিট হচ্ছে অক্সিজেন থেকে ওয়াসা পর্যন্ত। সে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে রুটটাকে তিনভাগ করছে। অক্সিজেন থেকে বায়েজিদ একভাগ। বায়েজিদ থেকে দুই নম্বর গেট এবং দুই নম্বর গেট থেকে ওয়াসা পর্যন্ত আরও দুই ভাগ। ট্রাফিক বিভাগ এটা দেখেও না দেখার ভান করে। কারণ এখানে তাদের স্বার্থ আছে।

 

পরিবহনে যদি শৃঙ্খলা চলে আসে তাহলে ট্রাফিকের এত লোকবল দরকার নেই। শৃঙ্খলা তারা চায় না বলেই এত জনবল। আমরা যখন বৈঠকে বসি তখন তারা বলেন ট্রাফিকের সীমাবদ্ধতা আছে, জনবলের অভাব আছে, তাই আমরা পারছি না। একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি বিশ^াস করি, প্রশাসন চাইলে সব সম্ভব। ২০১৪ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতকে পুলিশ যেভাবে বিতাড়িত করেছে সেটা আমরা দেখেছি। আর তারা পারে না- এটা যারা মনে করেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। পুলিশ প্রশাসন যদি চায় গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসতে বাধ্য। কিন্তু সেটা তারা করছে না। করলে তাদের আর্থিক লেনদেন কমে যাবে।

 

একসময় আমরা কিছু হলুদ টেম্পো দেখতাম। এই টেম্পোগুলোর আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ওই টেম্পোগুলোর ডকুমেন্টস দিয়ে এখনও বহদ্দারহাট, নতুন ব্রিজ এলাকা, কর্নেলহাট এলাকায় চলছে দেশে তৈরি সবুজ টেম্পো। শহরে অনুমোদিত টেম্পো যদি থাকে এক হাজার, সেখানে চলছে ৩-৪ হাজার। চট্টগ্রামে সিএনজিচালিত অটোরিকশার অনুমোদন আছে ১৩ হাজার। কিন্তু চলে ৩৯ হাজার। এসব নৈরাজ্যে পরিবহনের বেহাল অবস্থা। এক একটা সার্জেন্টের অধীনে অনেকগুলো সিএনজি ট্যাক্সি রয়েছে। বিভিন্ন কনস্টেবলের নামে রয়েছে। এগুলোতে ছোট ছোট টোকেনও আছে। এক সার্জেন্ট ধরে আরেক সার্জেন্টের টোকেন দেখলে ছেড়ে দেয়। এভাবে চলছে।

 

ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ আছে। কিন্তু প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এই গাড়িগুলো বন্ধ করছে না। এগুলো যারা চালায় তারা লাইনম্যান নামে পরিচিত। এদের সাথে আলাপ করে জেনেছি আয়ের একটা বড় অংশ থানায় যায়। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় স্থানীয় কিছ যুবক এগুলো থেকে টাকা নেয়। অথচ প্রকৃত রাজনীতিকরা এগুলোর সাথে জড়িত না।

 

শহরে অব্যবস্থাপনা দূর করতে ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে আমরা কাউন্টার সার্ভিস চালু করছিলাম। কর্নেল শাহরিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করে মেট্রো স্পেশাল সার্ভিস চালু করেছিলাম। এরপর যখন আমাদের এম এ মান্নান ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হলো, তখন রাস্তায় অব্যবস্থাপনার কারণে সেটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে আবার চালু করি। আমি চাই চট্টগ্রাম শহরের প্রত্যেকটা রুটে যদি কোম্পানিভিত্তিক কাউন্টার সার্ভিস চালু করা যায়, তাহলে গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠিত হবে।

 

গণপরিবহনে এসব নৈরাজ্যে মালিক হিসেবে নিজের কাছে অত্যন্ত লজ্জা লাগে। একটা বয়সে গিয়ে আমার ছেলেমেয়েরাই আমাকে গালি দেবে। তাই দায়বদ্ধতা থেকে কোম্পানি সার্ভিস চালু করেছি। লোকাল গাড়িতে একজন মা অথবা একজন বোন ওঠার সময় যখন গাড়ির হেলপার তাকে জড়িয়ে ধরে গাড়িতে তোলে তখন আমার খুবই লজ্জা লাগে।

 

আমার রাজনৈতিক নেতা মরহুম এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী আমাদেরকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। তিনি সর্বপ্রথম মহিলাদের জন্য বাস চালু করেছিলেন। সেগুলোও আমি চালু করেছি। পরবর্তীতে ১/১১ এর সময় উনি যখন গ্রেপ্তার হলেন, এই গাড়িগুলো বিকল হয়ে যায়। আজকে ৮ বছর ধরে কাউন্টার সার্ভিস চালিয়ে যাচ্ছি। চট্টগ্রামে ৬টা মালিক সমিতি আছে। আমরা ধাপে ধাপে মিটিং করেছি কীভাবে কোম্পানিভিত্তিক রুটগুলোকে আনা যায়। আগামী তিন মাসের মধ্যে কয়েকটা রুটকে কোম্পানিভিত্তিক করে ফেলতে পারবো। নিজেদের মধ্যে ঐক্যের জায়গায় আমরা এসেছি। চট্টগ্রামের মানুষকে ভালো পরিবহন ব্যবস্থা দেয়ার চেষ্টা করছি এবং এটা অব্যাহত থাকবে। তবে প্রশাসন যদি বাধা হয়, তাহলে সেটা বাস্তবায়ন হবে না।

 

সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনে আমাদের গাড়িগুলো রিকুইজিশন হয়েছে। আমরা গাড়ি দিতে বাধ্য। প্রশাসন এর আগে আমাদের মালিক শ্রমিক সংগঠনের সাথে আলাপ করে গাড়ি নিতো। কিন্তু গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে প্রশাসন আমাদের সাথে বৈরিতাসুলভ আরচণ করছে। তারা রাস্তা থেকে সন্ত্রাসীদের মতো গাড়ি নিয়ে চলে যায়। ড্রাইভার থেকে মোবাইল নিয়ে ফেলে। যাত্রী নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। এক মাস আগে রিকুইজিশন স্লিপ দিয়ে দেয়। নির্বাচনে যানবাহনের জন্য টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদেরকে কোন টাকা দেওয়া হয় না। লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

 

পরিশেষে আবারও বলতে চাই, আমাদের প্রশাসন বা ট্রাফিক বিভাগ যদি চায়, তাদের যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে চট্টগ্রামের গণপরিবহন ব্যবস্থা তিন মাসের মধ্যেই সুশৃঙ্খল হয়ে যাবে।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট