চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

সুষ্ঠু পরিবহন : বাধা সদিচ্ছার অভাব

মিজানুর রহমান

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ | ১২:১৩ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামে অবকাঠামোখাতে উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও গণপরিবহন ব্যবস্থা সেকেলেই রয়ে গেছে। বাস টার্মিনালের সংকট, মালিক-শ্রমিকের সদিচ্ছার অভাব, ট্রাফিক পুলিশ-বিআরটিএসহ সরকারি সংস্থাগুলোর অব্যবস্থাপনার কারণে গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা চলছেই। এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে যার যেটা দায়িত্ব, তা পালনে সদিচ্ছার পাশাপাশি কোম্পানিভিত্তিক বাস চালু করা প্রয়োজন। এতে হয়তো কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

প্রতিষ্ঠার ৩৯ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দৈনিক পূর্বকোণের বিশেষ ক্রোড়পত্রের জন্য আয়োজিত ‘পরিকল্পিত চট্টগ্রাম নগরী : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে আলোচকরা এসব কথা বলেন। আলোচনার ষষ্ঠ পর্বে চট্টগ্রামে সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিতে চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে মতামত দেন সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধি ও পরিবহনখাতের নেতারা।

 

নগর ট্রাফিক পুলিশের উপ-কমিশনার জয়নুল আবেদীন জানান, সড়কে অবৈধ গাড়ি রয়েছে। তবে নগরীতে স্থায়ী ডাাম্পিং ইয়ার্ড না থাকায় সব গাড়ি আটক করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে মামলা দিচ্ছি। প্রতিমাসে গড়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। নগর ট্রাফিকে জনবল সংকট রয়েছে। নিজস্ব কোন ম্যাজিস্ট্রেটও নেই। এ কারণে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।

 

তিনি বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি সরাতে পরিবহন নেতাদের উদ্যোগী হতে হবে। তারা নিজেরা না চাইলে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ কঠিন। ব্যাটারি রিকশা সড়ক থেকে সরাতে বার বার চেষ্টা করেও আইনের মারপ্যাঁচে হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো যার যেটা দায়িত্ব, তা পালন না করলে ট্রাফিকের একার পক্ষে পরিবহনখাতে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়।

 

নগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে বিআরটিএ মাস ট্রান্সপোর্টের দিকে যাচ্ছে বলে জানান সংস্থাটির উপ-পরিচালক সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী। তিনি বলেন, ৩টি অটোরিকশা একটি বাসের সমান জায়গা নেয়। সেখানে যাত্রী ওঠে নয়জন। কিন্তু একটি বাস ৩০-৪০ জন যাত্রী বহন করতে পারে। তাই ছোট গাড়ির চেয়ে কোম্পানিভিত্তিক বাস চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে অবকাঠামোখাতে অভাবনীয় উন্নয়ন হলেও গণপরিবহন ব্যবস্থা সেকেলে রয়ে গেছে। ‘লক্কর-ঝক্কর’ বাস ও মুড়িরটিনের মতো ছোট ছোট টেম্পো-ম্যাক্সিমাগুলো বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানেও সকালে এক ভাড়া, বিকেলে আরেক ভাড়া, বৃষ্টির দিনে আরেক ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছে যাত্রীরা।

 

তিনি বলেন, কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় কালুরঘাট-পতেঙ্গা পর্যন্ত বাস-র‌্যাপিড ট্রানজিট চালুর সুপারিশ ছিল। ফ্লাইওভার করে সেটি গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মেট্রোরেলের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগে সবপক্ষের মতামত নেয়া হয়নি। এখন আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা চ্যালেঞ্জের। নিরাপদ, সাশ্রয়ী, স্মার্ট গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়তে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে।

 

নাগরিক উদ্যোগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. ইলিয়াছ বলেন, নগরীতে যেরকম গণপরিবহন ব্যবস্থা আশা করি, তার প্রতিফলন দেখতে পাই না। মারাত্মক বিশৃঙ্খলা চলছে। ড্রাইভার-কন্ডাক্টরের খারাপ আচরণ, অতিরিক্ত যাত্রী তোলা, ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়, চলন্ত অবস্থায় যাত্রী ওঠা-নামা, লাঠি দিয়ে ট্রাফিক সিগন্যাল পরিচালনা পুরো ব্যবস্থাকে হ-য-ব-র-ল অবস্থায় ফেলেছে। এসব নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতে হবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকলে যানজটের কোন কারণ দেখি না।

 

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ২৩-২৪ বছর ধরে পরিবহনখাতে আছি। প্রশাসনের প্রতিটি বৈঠকে সিটি এলাকার জন্য টার্মিনাল দাবি করে আসছি। অদ্যাবধি হয়নি। আমার মৃত্যুর পরও হয় কিনা জানি না। বাংলাদেশে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা কখন হবে কেউ জানে না। পরিবহনে সমস্ত অনিয়মের পেছনে প্রশাসন জড়িত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ চায় না সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আসুক। প্রশাসন যদি চায় গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসতে বাধ্য। কিন্তু সেটা তারা করছে না। করলে তাদের আর্থিক লেনদেন কমে যাবে।

 

সিটি সার্ভিস ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি তরুণ দাশগুপ্ত ভানু বলেন, নগরীতে ২০০০ সালের আগে নিয়ম মেনে গণপরিবহন চলাচল করতো। ওয়ার্কশিট পদ্ধতি বাতিল করে দেয়ায় এখন বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। ২০০৪-০৫ সালের দিকে কাউন্টার সিস্টেম করেছিলাম। কিন্তু স্টাফদের কারণে টিকে থাকতে পারিনি। পার্টসের দাম বাড়ায় মালিকেরা কোনরকম পোষাতে পারছে না। প্রশাসন রক্ষক হয়ে ভক্ষকের কাজ করছে। এভাবে চললে আগামীদিনে চট্টগ্রাম শহরে বাস থাকবে না। বাস কেউ কিনবে না।

 

চট্টগ্রাম বেবিট্যাক্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস কে সিকদার বলেন, আগে সমস্যা সমাধানে জেলা প্রশাসন বা পুলিশ কমিশনার কার্যালয় থেকে আলোচনার জন্য ডাকা হতো। এখন ডাকাডাকি নেই। কারণ সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতা করছে অন্য একটি পক্ষ। যারা পরিবহনে চাঁদাবাজির সাথে জড়িত। পরিবহনে টোকেন বা স্লিপ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। বৈধ ট্যাক্সির চেয়ে অবৈধ অর্থাৎ গ্রামের ট্যাক্সি বেশি চলছে শহরে। সেটাও কয়েকগুণ বেশি। এগুলোর সঙ্গে ট্রাফিক বিভাগের অনেক সদস্য জড়িত। তাদের অনেকের নামে অসংখ্য ট্যাক্সি চলাচল করে।

 

চট্টগ্রাম মহানগরী বাস মিনিবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, আন্তঃজেলার গাড়িগুলো এসে শহরে যানজট সৃষ্টি করছে। পার্কিং নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। কিন্তু পার্কিং নির্ধারিত করে দেয়া হয়নি। নগরীতে কার্ডধারী তিন হাজার পরিবহন শ্রমিক আছে। অনিয়ম করলে তাদের ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে ছিন্নমূল থেকে উঠে আসা কিছু শ্রমিক যাত্রীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে।

 

দৈনিক পূর্বকোণের প্রধান প্রতিবেদক সাইফুল আলম বলেন, একটা শহর কতটা সভ্য, সেটা সেখানকার গণপরিবহন দেখলে বোঝা যায়। কিন্তু আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থা মোটেও দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে মানানসই নয়। ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও গণপরিবহন নির্দিষ্ট কোম্পানির অধীনে এলে হয়তো কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে আসতো।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট