চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

দুষ্টু চক্রের কারণে ভিনদেশে চলে যাচ্ছে স্বাস্থ্যবাণিজ্য-পর্যটন

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ | ১২:৪৫ অপরাহ্ণ

জীবন সংশ্লিষ্ট পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজন হলো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। সব কিছুর কেন্দ্রে হলো কিন্তু স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যের পরিধি ব্যাপক। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (বিশ্বাস) সংজ্ঞা হলো, ‘সামগ্রিকভাবে দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক হিতাবস্থা এবং যা শুধুমাত্র রোগ বা অক্ষমতার অনুপস্থিতি নয়’। স্বাস্থ্য ব্যাপক অর্থে প্রয়োগ হলেও চিকিৎসা ব্যবস্থার আলাদা দ্যোতনা আছে, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সমার্থক নয়। স্বাস্থ্য আর চিকিৎসার সূচক পুরোপুরি একও নয়। তবে স্বাস্থ্য রক্ষায় চিকিৎসার গুরুত্ব অপরিসীম। দিনে দিনে চট্টগ্রামের গুরুত্ব বাড়ছে। বাড়ছে বহুবিধ চিকিৎসার প্রয়োজন। অন্যদিকে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় চিকিৎসার নতুন নতুন পদ্ধতি ও পন্থ্রা উদ্ভব হচ্ছে। যা প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষিত জনশক্তি নির্ভর ও ব্যয়বহুল। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা দুই বিষয়ের সমস্যাগুলো সম্পূরক ও পরিপূরক। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বান্ধবতায় চট্টগ্রামের চ্যালেঞ্জসমূহ জরুরি ভিত্তিতে নির্ণয় ও সমাধান প্রয়োজন।

চট্টগ্রামের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ক্যানভাস পরিবীক্ষণ ও পর্যালোচনায় অবস্থা খুব সুখকর নয়। চিকিৎসাসেবাকে জীবন সংকটের পরিমাপে কয়েকভাবে ভাগ করা হয়। অতি জরুরি, জরুরি, নিয়মিত ও প্রান্তিক। অন্যভাবে বললে নিরাময় যোগ্য, জটিল, অনিরাময় যোগ্য, শেষ অবস্থা। এক এক ধরনের রোগীদের সমস্যা এক এক ধরনের। কিন্তু কিছু সমস্যা সাধারণ। চিকিৎসা কেন্দ্রের অপ্রতুলতা ও একই জায়গায় কেন্দ্রীভূত, যাতায়াতের সমস্যা, ভিড়, অব্যবস্থাপনা, অস্বাস্থ্যকর অবস্থা, চিকিৎসা ও সহায়তা সাধারণকর্মীর স্বল্পতা, চিকিৎসা উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতা, যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণে অবস্থাপনা ও বিকল হয়ে থাকা, সময়মত সেবা না পাওয়া, নগরে চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর অসম বিন্যাস বা অবস্থান, সরকারি ও বেসরকারি কেন্দ্র সমূহের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, সবকিছুতে সময় ক্ষেপণ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ইত্যাদি। সাথে আছে দালাল ও দুষ্টুচক্র যারা চিকিৎসা নিয়ে রোগীদের প্রতারণা ও শোষণ করে।

 

স্বাস্থ্যের ভিন্ন ভিন্ন শাখার পারঙ্গমতাও খুব ভালো না, ইপিআই টিকাদান ও মা ও শিশু স্বাস্থ্যের কিছু সফলতা ছাড়া। প্রাথমিক স¦াস্থ্যের উপাদানগুলি হলো স্বাস্থ্য শিক্ষা, সুষম খাদ্য পাওয়া, মা ও শিশু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, রোগ প্রতিরোধক টিকাদান, স্থানীয় ভাবে প্রাদুর্ভাবের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, প্রচলিত সাধারণ রোগ ও জখম সমুহের যথাযথ চিকিৎসা, এবং অত্যাবশকীয় ওষুধের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। প্রাথমিক স্বাস্থ্যের উপাদানগুলির কোনটির অবস্থা ও মান সন্তোষজনক নয়। চট্টগ্রামে সত্যিকারভাবে কোন বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। খ-িত একটি প্রশাসনিক বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। এককালের সবচেয়ে কার্যকরী প্রাথমিক চিকিৎসাব্যবস্থা জেনারেল প্র্যাকটিস ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। অন্যদিকে নেই চিকিৎসাব্যবস্থায় দায়বদ্ধতার প্রয়োগ। সুযোগ, সামর্থ্য ও আস্থার অভাবের এক দুষ্টুচক্র সৃষ্টি হয়ে চলছে। ফলে ভিন দেশে চলে যাচ্ছে স্বাস্থ্য বাণিজ্য এবং স্বাস্থ্য পর্যটন। চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে সুযোগের অভাব, সামর্থ্যরে অভাব ও আস্থার অভাব। সুযোগের অভাব বলতে গেলে নন কম্যুনিকেবল রোগ সমূহের সময়োপযোগী রোগ চিকিৎসার প্রতুলতা প্রকট। এসবের মধ্যে আছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সিস্টেমের রোগ সমূহ। ডায়বেটিস, হৃদরোগ, টিউমার ও ক্যান্সার, বিভিন্ন বিকলতা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন, প্লাস্টিক সার্জারি, জটিল অপারেশন, অথবা উদ্ভাবনীর নতুন বা বিকল্প ভাবনার চিকিৎসা।

 

সব খুবই অপ্রতুল বা নেই। কম্যুনিকেবল তথা সংক্রমণ রোগেও সার্বিক পরিবীক্ষণ পর্যালোচনার সুযোগ কম। সংক্রমণের কারণ ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস, প্যারাসাইট ইত্যাদি বের করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। অত্যাধুনিক রোগ নিরূপনী এবং নিত্যনতুন যথাযথ সংযোজন ও হাল নাগাদের অপ্রতুলতা। চিকিৎসা রেফারেল নেটওয়ার্কিং এর অভাব। চিকিৎসা কার্যক্রম এককভাবে কোন সেন্টার বা ব্যক্তি প্রায়ই করতে পারেন না। যেমন রোগ নিরূপণে, তেমন চিকিৎসায়। চিকিৎসা কার্যক্রমের স্বীকৃত তিনটি পর্যায় আছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও টারসিয়ারি। প্রত্যেক পর্যায়ের সেবা ও কাজের পরিধি নির্ধারণ করা আছে। তাছাড়া আছে বিশেষায়িত পর্যায়। প্রাইমারি কেন্দ্রগুলি হলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মাধ্যমিক হলো জেলা সাধারণ হাসপাতাল, তৃতীয় পর্যায়ের হাসপাতাল আসলে বাংলাদেশে প্রায় নেই। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো তৃতীয় পর্যায়ের হাসপাতাল হিসাবে চালানো হচ্ছে। ফলে হাসপাতালের একাডেমিক কার্যক্রম যেমন বিঘিœত হয়, তেমনি চিকিৎসাও যথাযথ হয় না। রাজধানী ও কয়েকটি শহরে বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। যেমন হৃদরোগ, কিডনি রোগ, ¯œায়ুরোগ, ক্যান্সার, হাড় ও জোড়া রোগ ইত্যাদি। এসব কেন্দ্রগুলির মধ্যে কোন রেফারেল নেটওয়ার্ক নেই, নেই কোন স্টান্ডার্ড অপারেশন প্রসিজিওর। প্রতি পর্যায়ে রোগীরা হেনস্থার স্বীকার হন। ডায়গনোস্টিক ল্যাব ব্যবস্থার রেফারেল সংযোগও নেই। আধুনিক রোগ নিরূপণ ব্যবস্থাসমূহ উচ্চতর প্রযুক্তি, প্রশিক্ষিত জনশক্তি নির্ভর ও ব্যয়বহুল। তাই সরকারি হাসপাতাল সমূহে রোগ নিরূপণের সুযোগ খুব কম ও অনিয়মিত। ফলে রোগীদের বেসরকারি ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হয়। আঞ্চলিক রেফারেল ল্যাবের অভাবে কিছু টেস্টের জন্য অতি উচ্চ মূল্য দিতে হয়। সরকারি ও বেসরকারি আনুষ্ঠানিক অংশীদারিত্ব থাকলে রোগ নিরূপণ সহজ ও সাশ্রয়ী হতো। বেশির ভাগ বায়োকেমিক্যাল টেস্ট ব্যাচে করতে হয়, ৫০-১০০ টেস্ট করতে যে পরিমাণ রিএজেন্ট লাগে ১ টেস্টেও একই। আর রিএজেন্ট প্রস্তুত করার পর তার শেলফ লাইফ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ২৪ ঘন্টা। তারপর রিএজেন্ট ফেলে দিতে হয়, না হলে টেস্ট রেজাল্ট সঠিক হয় না। ল্যাবগুলির মধ্যে রেফারেল সংযোগ থাকলে রিএজেন্ট সাশ্রয়ের ফলে টেস্ট ফি কমে যেত।

দ্বিতীয়ত আছে সামর্থ্যরে অভাব। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে মাত্র শতকরা পঁচিশ ভাগ রোগী বাধ্য হয়ে সরকারি ব্যবস্থায় চিকিৎসা নেন। রোগীরা সাধারণত প্রান্তিক কম উপার্জনের। বেশিরভাগ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও অনেক চিকিৎসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিতে হয়। কারণ অপ্রতুলতা বা না থাকা। দেশে কোন তৃতীয় পাক্ষিক মূল্য পরিশোধ বা ইন্সিওরেন্স বা জাতীয়ভাবে ব্যয়পূরণের ব্যবস্থা নেই। প্রায় সময় এই ব্যয় আর্থিক ক্ষমতার অনেক বাইরে। ফলে রোগী পুরো চিকিৎসা সম্পন্ন না করেই বেসরকারি হাসপাতাল ত্যাগ করে সরকারি হাসপাতালে যান। সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না থাকলে বিনা চিকিৎসায় কষ্টে কাটানো বা মৃত্যু।

 

তৃতীয়ত হচ্ছে আস্থার অভাব। রোগীর সন্তুষ্টিই হলো চিকিৎসা ব্যবস্থার মান ও কার্যকারিতার সব চেয়ে বড় সূচক। বিদ্যমান চিকিৎসা সেবায় এই সূচকের মান সবচেয়ে নিম্নে। রোগীরা চান চিকিৎসকরা তাদের সব কথা শুনবেন ও বুঝার চেষ্টা করবেন, যথাযথ জ্ঞান ও দক্ষতা ধারণ করবেন, রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে যৌক্তিক ধারণা দেবেন এবং কোন অবস্থাতেই চিকিৎসক তাদের পরিত্যাগ করবেন না। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা এই প্রত্যাশা মিটাতে হয়তো ব্যর্থ হচ্ছেন, তাই আস্থাহীনতার এই মহামারী। বিত্তশালী ও ক্ষমতাবানরা কখনই দেশের চিকিৎসায় আস্থাবান নন।

 

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এবং চেম্বারে আসা রোগীকে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করলে চিকিৎসাসেবা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সমস্যাগুলো অবলোকন ও অনুধাবন করা যায়। জরুরি ও বহিঃবিভাগে আসা রোগী, ভর্তির রোগী, অন্তঃবিভাগের রোগী, অপারেশনের রোগী, টেস্ট করতে আসা রোগী। রোগীর চিকিৎসার কাগজ পত্রাদি ও রেকর্ড সমূহ পর্যবেক্ষণ। সরকারি হাসপাতালের আউটডোর টিকেট দেখলেই উপলব্ধি হবে কতটুকু অবহেলা বা অজ্ঞতা রোগীর রোগের বর্ণনা ও চিকিৎসায়।

 

বিশেষায়িত চিকিৎসা বা কেন্দ্র আর মেডিকেল কলেজ সমার্থক নয়। মেডিকেল কলেজ হলো মেডিকেল শিক্ষা, প্রশিক্ষণ আর গবেষণার পাদপীঠ। তাই বিশেষায়িত চিকিৎসার নামে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার মত নি¤œমান সম্মত মেডিকেল কলেজ স্থাপন বন্ধ করতে হবে। দেশের সব মেডিকেল কলেজকে আন্তর্জাতিক সমমানের এবং স্বশাসিত করতে হবে।

 

চারিদিকে বিদ্যমান ব্যাপক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের পাহাড় ডিঙানো সহজ না, অসাধ্যও নয়। তবে তা হতে হবে যথাযথ পেশাগত বৈজ্ঞানিক উপায়ে আমলাতন্ত্র মুক্ত প্রেক্ষাপটে। সার্বিক তথ্য সংগ্রহ করে তত্ত্বে রূপান্তরিত করতে হবে। তা থেকে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।। প্রতিটি ক্ষেত্রানুযায়ী লক্ষ্যমাত্র একক ও সামগ্রিকভাবে অবধারণ। বিভিন্ন পর্যায়ের দক্ষ ও সমর্পিত জনবল সংগঠন, সেবা প্রদান কেন্দ্রগুলির নগর ও আশেপাশে পর্যায় ভিত্তিক সুষম বিন্যাস, নেটওয়ার্কিং, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মধ্যে আনুষ্ঠানিক অংশিদারিত্ব, রেফারেল ও চিকিৎসার গাইড লাইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ, গুড মেডিকেল প্র্যাকটিস গাইড লাইন সজ্জিত করে প্রবর্তন। সকল পর্যায়ের মেডিকেলে জনবলের জ্ঞান, দক্ষতা ও আচরণের আধুনিকায়নের জন্য নিয়মিত দেশে ও বিদেশে অনুশীলনের ব্যবস্থা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা একটি নিয়মিত কর্মযজ্ঞে পরিণত করতে হবে। এসব কাজ হবে জনগণের নির্বাচিত নির্বাহীদের নেতৃত্বে ও পেশাজীবীদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে। উপজেলা, জেলা ও অঞ্চলে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কাউন্সিলের মাধ্যমে, যেভাবে শাসনতন্ত্রে বর্ণিত আছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবার মানসিকতা পাল্টাতে হবে। একটি থিম হৃদয়ে ঢুকিয়ে দিতে হবে, ‘সুযোগ, সামর্থ্য ও আস্থার অভাবে কোন জীবনপ্রদীপ যেনো নিভে না যায়’। কল্যাণকামী মানসিকতার মাধ্যমে সুযোগ, সামর্থ্য আর আস্থার যথাযথ সমন্বয় করতে পারলে চট্টগ্রামকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবান্ধব করা যাবেই।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট