চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি অসম্ভব

মিজানুর রহমান

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ | ১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ

‘চট্টগ্রামের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ক্যানভাস খুব সুখকর নয়। এর বড় কারণ সবকিছু পরিচালিত হয় ঢাকা থেকে। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমতা সেন্ট্রালাইজ থাকবে, ততক্ষণ চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির কথা কল্পনা করা যাবে না। আমলাকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা না করে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট জনবল দিয়ে হাসপাতাল পরিচালিত হলে অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। মানুষ ভালো সেবা পাবে।’

প্রতিষ্ঠার ৩৯ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দৈনিক পূর্বকোণের বিশেষ ক্রোড়পত্রের জন্য আয়োজিত ‘পরিকল্পিত চট্টগ্রাম নগরী : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে আলোচকরা এসব কথা বলেন। আলোচনার তৃতীয় পর্বে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতের চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে মতামত দেন বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরা।

 

আলোচনায় অংশ নিয়ে চমেকের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুস বলেন, চট্টগ্রামের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ক্যানভাস খুব সুখকর নয়। এ চিত্র পাল্টাতে সবার আগে আমাদের হৃদয়ে একটি কথা ঢুকাতে হবে- ‘সুযোগ, সামর্থ্য ও আস্থার অভাবে কোন জীবনপ্রদীপ যেন নিভে না যায়’। সুযোগ সামর্থ্য আর আস্থার সমন্বয় হলে চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবান্ধব হবেই।

 

স্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্যখাতের বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া সমস্যার সমাধান পুরোপুরি হবে না। নিম্ন-মধ্যবিত্তরা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। আর মধ্যবিত্তরা বেসরকারি হাসপাতালে বেশি টাকা খরচ করেন। এটি চলতে দেয়া যায় না। আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন তথ্য পৌঁছে না।

 

চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় চমেক হাসপাতালে নতুন স্থাপনা হয়নি। জনবল সংকটও প্রকট। চট্টগ্রামের অনেক চিকিৎসক বিভিন্নভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। রোগীরা সিনিয়র চিকিৎসকদের সেবা পাচ্ছেন না। খুব স্বল্পসংখ্যক চিকিৎসক দিয়ে এখানে সেবা চলছে। এসব নিরসনে উদ্যোগ নিতে হবে।

 

তিনি বলেন, আমলাকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা না করে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট জনবল দিয়ে হাসপাতাল পরিচালিত হলে অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। হার্ট, কিডনি এবং ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য আট বিভাগে আটটি ১৭তলা ভবন করে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এতে সবধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। চমেক হাসপাতালেও এরকম ভবন হবে। এটি হলে চট্টগ্রামের চিকিৎসাখাত আরও এগিয়ে যাবে।

 

জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, পতেঙ্গা থেকে আগ্রাবাদ পর্যন্ত কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। সেখানে একটি সরকারি হাসপাতাল প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের একটা বড় অংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাদের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।

 

স্বাচিপের প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাত পরিচালিত হয় ঢাকা থেকে। চট্টগ্রামে ডেপুটেশন অর্ডারের ক্ষমতা পর্যন্ত রাখা হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমতা সেন্ট্রালাইজ থাকবে, ততক্ষণ চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির কথা কল্পনা করা যাবে না। আমলারা চট্টগ্রাম বিদ্বেষী বলেই চট্টগ্রাম পিছিয়ে। এজন্য এখানকার জনপ্রতিনিধিরাও কম দায়ী নন।

 

সনাক চট্টগ্রামের সভাপতি এডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী বলেন, দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দলীয়করণ আর দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য না থাকলে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতে সমস্যা থাকত না। এসবের কারণে অনেক সময় পিয়ন-গার্ডের কাছেও হাসপাতালের পরিচালক জিম্মি হয়ে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের অনেক বেসরকারি হাসপাতাল মিথ্যা বলে আয় করে নিচ্ছে। এসব রুখতে সবাইকে একসাথে লড়াই করতে হবে।

 

এভারকেয়ার হাসপাতালের জিএম ডা. মোহাম্মদ ফজল-ই-আকবর চৌধুরী বলেন, প্রায় চার কোটি লোকেরই চিকিৎসা বিভাগীয় শহর হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ‘মোর অর লেস’ এর একটা বড় অংশ চিকিৎসার জন্য বিদেশ চলে যায়। চট্টগ্রামেই কম খরচে বিশ^মানের সেবা দিতে আমরা কাজ করছি। তবে এক্ষেত্রে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

 

পার্কভিউ হসপাতালের এমডি ডা. এ টি এম রেজাউল করিম বলেন, চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শতকরা ত্রিশভাগ হচ্ছে সরকার নিয়ন্ত্রিত, আর সত্তরভাগ বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে। বেসরকারিতে হাসপাতাল করতে গেলে ১৫টির মতো সনদ নিতে হয়। নানা নিয়মকানুন। সরকার যদি আমাদের ট্যাক্স ডেবিট দেয়, তাহলে মানুষ সস্তায় আরও বেশি সেবা পাবে।

 

চসিকের জোনাল মেডিকেল অফিসার ডা. মো. হাসান মুরাদ চৌধুরী বলেন, একটা জিনিস মনে-প্রাণে ভাবতে হবে যে স্বাস্থ্য বিভাগ চসিকের একটি অংশ। কিন্তু এ মুহূর্তে চসিকের অধিকাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ এবং জরাজীর্ণ। এখানে ডাক্তারদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। দক্ষ লোকবল নেই। ওষুধের সংকট আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা স্বাস্থ্যসেবার জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।

 

দৈনিক পূর্বকোণের প্রধান প্রতিবেদক সাইফুল আলম বলেন, ঢাকায় অনেক স্পেশালাইজড হাসপাতাল আছে। কিন্তু চট্টগ্রাম এত বড় শহর। এখানে নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী- পুরো এলাকা চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। এখানে অনেক হাসপাতাল হচ্ছে- এরপরেও কিছু হলেই ভারত বা ঢাকা যেতে হচ্ছে। কারণ খুঁজে দেখা জরুরি।

 

গবেষক ও চবি অধ্যাপক ড. আদনান মান্নানের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় আরও মতামত দেন চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেহেরুন্নিছা খানম। সমাপনী বক্তব্য দেন দৈনিক পূর্বকোণের সিটি এডিটর নওশের আলী খান।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট