চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫

তদন্তে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের টিম

চট্টগ্রাম ওয়াসার জায়গায় অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ করে ভাড়া তুলছেন ­সিবিএ-ননসিবিএ নেতারা

মোহাম্মদ আলী

২৩ নভেম্বর, ২০২৩ | ৪:০২ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম ওয়াসার জায়গায় অবৈধভাবে দোকান নির্মাণের সত্যতা যাচাইয়ে তদন্তে এসেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টিম। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. এমদাদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত টিম গতকাল বুধবার সকালে বাকলিয়া খাজা রোডস্থ চট্টগ্রাম ওয়াসার ১৬ নম্বর পাম্পহাউসের জায়গায় অবৈধভাবে নির্মিত ৭টি দোকান ঘুরে দেখেন এবং স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলেন। তদন্ত টিমের সদস্যরা আজ বৃহস্পতিবারও ওয়াসার বিভিন্ন স্থাপনায় নির্মিত অবৈধ দোকান ঘর পরিদর্শন করবেন।

 

অভিযোগে জানা গেছে, চট্টগ্রাম ওয়াসায় সিবিএ ও নন সিবিএ সংগঠনের বাইরে ‘দি ওয়াসা এমপ্লয়িজ কো অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ (রেজিস্টেশন নং-৩১৮) নামে একটি সংগঠন রয়েছে। এ সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিয়ে ওয়াসার কর্মচারী রেজওয়ান হোসেন দুলাল ও মোহাম্মদ জাকারিয়ার নেতৃত্বে ওয়াসার কর্মচারী রুহুল আমিন, জমির খান মিয়াজী, এসকান্দর মিয়া, খোরশেদ আলম চান্দগাঁও থানাধীন বাকলিয়া খাজা রোডের খালাসী পুকুর পাড় এলাকায় চট্টগ্রাম ওয়াসার ১৬নং পাম্পহাউসের জায়গা দখল করে ৭টি পাকা দোকান নির্মাণ করেন। ইতোমধ্যে নির্মাণকৃত প্রতিটি দোকানের জন্য অগ্রিম ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা করে সালামি আদায় করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে ওয়াসার এস্টেট বিভাগ থেকে অনুমতি ব্যতীত কোন দোকান বা ঘর নির্মাণ না করার জন্য তাদের কাছে চিঠিও দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে অফিস আদেশের এই চিঠির কোন ধরনের কর্ণপাত না করে তারা পাকা দোকান নির্মাণ করেছে। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে জমি ফেরত চেয়ে মামলায় যান পাম্পহাউসের ভূমিদাতার স্বজনরা। মহানগর সিনিয়র সহকারী জজ ৫ম আদালতে এ মামলা করা হয়। মামলায় চট্টগ্রাম ওয়াসার চেয়ারম্যান, প্রধান প্রকৌশলী, এস্টেট অফিসার, সচিব, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও ভূমি হুকুম দখল কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়েছে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে নগরীর খাজা রোড এলাকার জনৈক বাসিন্দা আলী আহমদ এই পাম্পহাউস নির্মাণের জন্য ওয়াসাকে ২৪ শতক জমি দান করেন। কিন্তু দানকৃত ভূমিতে পাম্পহাউসের আড়ালে পাকা দোকান তৈরি করায় ক্ষুব্ধ হন তার স্বজনরা। ওয়াসার কাছে তাদের জমি ফেরত চেয়ে ইতোমধ্যে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে লিগ্যাল নোটিশও প্রেরণ করেন তারা। কিন্তু প্রতিকার না পাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন তারা।

 

এ প্রসঙ্গে ওই পাম্পহাউসের ভূমিদাতা আলী আহমদ এর নাতি স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল আজিম দৈনিক পূর্বকোণকে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার দাদা জমি দান করেছিলেন ওয়াসার পাম্পহাউস নির্মাণের জন্য। কিন্তু ওয়াসার কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মচারী সেই জায়গায় ব্যবসা করার জন্য দোকান নির্মাণ করে। তাই পাম্পহাউসের বাইরে অবশিষ্ট জমি ফেরত চেয়ে আদালতে মামলা করেছি। এছাড়া ওয়াসাকে আইনি নোটিশও দিয়েছি।’

 

নুরুল আজিম বলেন, ‘স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তদন্ত টিমের সাথে আমি কথা বলেছি এবং আমার অভিযোগ তাদের জানিয়েছি।’

 

জানতে চাইলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘দি ওয়াসা এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মচারীদের একটি সংগঠনের নেতাদের ওয়াসা পাম্প হাউসসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও জমির অবৈধ ব্যবহার, খালি জায়গায় ঘর-দোকানসহ নানা স্থাপনা নির্মাণে জড়িত থাকার বিষয়ে তদন্তের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত টিম চট্টগ্রামে এসেছেন। কমিটির সদস্যরা বুধবার সকালে চট্টগ্রাম ওয়াসার ১৬নং পাম্পহাউসের জায়গা দখল করে পাকা দোকান নির্মাণের স্থান সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। তদন্ত টিম আজ বৃহস্পতিবারও ওয়াসার বিভিন্ন স্থাপনায় নির্মিত দোকান ঘর পরিদর্শন করবেন।’

 

এদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তদন্ত টিমের বিষয়ে জানতে গতকাল ওয়াসার এস্টেট অফিসার বাবুল আলমের মোবাইলে দৈনিক পূর্বকোণ থেকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। অভিযোগ উঠেছে, ওয়াসার বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে একের পর এক দোকান নির্মাণের উৎসব চললেও তিনি নির্বিকার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। শুধুমাত্র জড়িতদের চিঠি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন তিনি।

 

নগরীর মনসুরাবাদ এলাকায় ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের পাশে ওয়াসার পাম্প হাউসের সামনেও অবৈধভাবে ৫টি পাকা দোকান তৈরি করা হয়েছে। এসব দোকান থেকেও ভাড়া তুলছে ওয়াসার গুটিকয়েক কর্মচারী। নগরীর বায়েজিদ সড়কের নাসিরাবাদ এলাকার ওয়াসার স্টাফ কলোনির সামনের জায়গায় কয়েকমাস আগে নির্মাণ করা হয়েছে আরো চারটি পাকা দোকান। ওয়াসা কর্মচারী রুহুল আমিন, আবদুল মোমেন সরকার, জমির খান মিয়াজি ও আউটসোর্সিং কর্মচারী রাসেল এসব দোকান নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া একই এলাকায় আরো ১৬টি দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ওয়াসার সিবিএ নেতা নুরুল ইসলাম এসব দোকানের দেখভাল করেন বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে এ নিয়ে ‘দি ওয়াসা এমপ্লয়িজ কো অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে’র বর্তমান নেতৃত্বের সাথে আগের নেতৃত্বের দফায় দফায় সংঘাত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

 

অভিযোগে জানা গেছে, বছরের পর বছর ধরে গুটিকয়েক কর্মচারী শ্রমিক সংগঠনের নাম ভাঙ্গিয়ে ওয়াসার বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ করে ভাড়া আদায় করলেও কর্তৃপক্ষ কোন ধরনের প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো তাদের চাকরির প্রমোশন ও পরিবারের স্বজনদের চাকরি প্রদান এবং নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এ কারণে অনেকটা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেছেন দুর্নীতিবাজ এসব কর্মচারী। অভিযোগে আরো জানা গেছে, ওয়াসার কতিপয় কর্মচারী অবৈধ আয়ের মাধ্যমে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক বনে গেছেন। জোর তদন্ত করলে এসব বিষয়ে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।

 

পূর্বকোণ/আরডি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট