রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট মো. জহিরুল ইসলাম। ২০০২ সালে সহকারী কমান্ড্যান্ট হিসেবে রেলের নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার মাত্র চার বছরের মাথায় পদোন্নতি পেয়ে হন কমান্ড্যান্ট। এরপর পেছনে আর তাকাতে হয়নি তাকে। পদোন্নতি পাওয়ার সাথে সাথে পেয়ে যান ‘আলাদিনের চেরাগ’। যা ঘষে কয়েকবছরের মাথায় গড়ে তোলেন ‘সম্পদের পাহাড়’।
চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছে- শুধু তিনি নিজেই নন, ‘চেরাগে’র মাধ্যমে তার স্ত্রীও হয়ে যান ‘কোটি টাকার সম্পদের মালিক’। অথচ চিফ কমান্ড্যান্টের স্ত্রী কাজী জিন্নাতুন নাহার একজন গৃহিনী। যা নিয়ে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী কাজী জিন্নাতুন নাহারের নামে প্রায় সোয়া ৪ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ঢাকা-কুমিল্লায় কোটি টাকা মূল্যের বিলাশবহুল ফ্ল্যাট-প্লটের তথ্য মিলেছে।
জানা যায়, ২০১৭ সালে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীতে (আরএনবি) ১৮৫ জন সিপাহী নিয়োগের অনিয়ম হওয়ার পর অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধান শেষে নিয়োগে অনিয়ম হওয়ায় ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলামসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এরমধ্যে জহিরুল ইসলামের সম্পদের অনুসন্ধানও শুরু হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের নামে অস্বাভাবিক সম্পদের তথ্য পায় দুদক। জহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যসহ নানান আনিয়মের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৪ সালে ঢাকার মিরপুরের সেনপাড়া মৌজায় জহিরুল ইসলামসহ ৩৫ জন দুই কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি ক্রয় করেন। দলিল মূল্যে দুই কোটি টাকা হলেও বর্তমান বাজারমূল্য কয়েকগুণ বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ঢাকার শহীদবাগে এ এন জেড প্রোপার্টিজ লিমিটেডর নয়তলা বিশিষ্ট ‘সিপ্রিং ডেল’ নামে একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় নিজ নামে প্রায় ৮০ লাখ টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন তিনি। যার বর্তমান বাজারমূল্য দ্বিগুণেরও বেশি।
উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরের ‘এ’ ব্লকে রাজউক উত্তরা এপার্টমেন্ট প্রকল্পে ১৬৫৪ বর্গফুট আয়তনের ১১ ডি ভবনের প্রায় ৬৫ লাখ টাকার ফ্ল্যাট রয়েছে তার। এরমধ্যে চিফ কমান্ড্যান্ট পদে পদোন্নতি পাওয়ার পরপরই ক্রয় করেন প্রায় ৩৫ লাখ টাকা মূল্যের (ঢাকা-মেট্রো- গ-৪২-০৮৭১) গাড়িও।
অন্যদিকে, স্ত্রী কাজী জিন্নাতুন নাহারের নামে ২০১২ সালে কুমিল্লার আদর্শ সদর থানাধীন কান্দিরপাড় প্রকাশ্য ঝাউতলা মৌজায় ‘রহমান লজ’ নামে পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলায় প্রায় ২০ লাখ টাকার ফ্ল্যাট এবং ২০১৮ সালে একই মৌজায় জয়েন্ট লাইফ রিয়েল এস্টেট এন্ড ডেভেলপারস লিমিটেডের ‘জয়েন্ট লাইফ এস এস গার্ডেন’ নামের ১০ তলা ভবনের চতুর্থ তলায় প্রায় ২০ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট ক্রয় করা হয়।
এছাড়াও ঢাকার রমনা থানার কাকরাইলের সার্কিট হাউস রোডের ‘কনকর্ড গ্র্যান্ড রুবি’ নামীয় ১৪ তলা আবাসিক এপার্টমেন্ট ভবনের চতুর্থ তলায় ১৭৫০ বর্গফুট আয়তনে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ক্রয় করেন তিনি। যেখানে বর্তমানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন তারা। যদিও এসব সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য কয়েকগুণ বেশি বলে ধারণা দুদক কর্মকর্তাদের।
জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত পূর্বকোণকে বলেন, অবৈধ সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত অনুসন্ধান চলামান রয়েছে।
এদিকে, এসব সম্পদের বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট মো. জহিরুল ইসলামের কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। নম্বরে ক্ষুদেবার্তা দেওয়া হলেও তার উত্তর পাওয়া যায়নি। যার কারণে এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, জহিরুল ইসলাম ১৯৯০ সালে সাঁট মুদ্রাক্ষরিক-কাম টাইপিস্ট পদে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে যোগদান করেন। ২০০০ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পদে পদোন্নতি পান। পরবর্তীতে তিনি ২০০২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিসিএস নন-ক্যাডারে (২১ তম ব্যাচ) সহকারী কমান্ড্যান্ট পদে, ২০০৬ সালে কমান্ড্যান্ট এবং ২০২০ সালে চিফ কমান্ড্যান্ট পদে বাংলাদেশ রেলওয়ে নিরাপত্ত বাহিনীতে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন।
১৯৯২ সালে কাজী জিন্নাতুন নাহারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জহিরুল ইসলাম। কাজী জিন্নাতুন নাহার কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বাতাবাড়ীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। তবে তিনি ২০১৩ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে চলে যান। তাদের ঘরে এক কন্যাসন্তান রয়েছে। বর্তমানে সে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যয়নরত।
পূর্বকোণ/পিআর