চট্টগ্রাম শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ:

দুই দশকেও নিশ্চিত হয়নি অর্থায়ন

সারোয়ার আহমদ

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ

লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও রেলের মাধ্যমে পণ্যপরিবহন শুরু থেকেই অবহেলিত। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি-রপ্তানি পণ্য ঢাকা কমলাপুর আইসিডিতে পরিবহন করে লাভবান হয় রেল কর্তৃপক্ষ। তবে নানা কারণে অচিরেই কমলাপুর আইসিডি তার সক্ষমতা হারাবে। যা ২০ বছর আগেই আঁচ করতে পেরে গাজীপুরের কয়েকগুণ বড় ধীরাশ্রমে নতুন আইসিডি করার প্রস্তাব দেয় বন্দর। সেই থেকে রেল প্রকল্প নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়ন ছাড়া মূল আইসিডির অবকাঠামোর কিছুই করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। যার অন্যতম কারণ প্রকল্পের অর্থের জোগান।

 

দেশে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেলের মতো বৃহৎ সব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করা কমলাপুর আইসিডি গাজীপুরের ধীরাশ্রমে স্থানান্তরের কাজটি করা সম্ভব হয়নি দুই দশকেও। নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও গত ২০ বছরে দৃশ্যমান হয়নি ধীরাশ্রম আইসিডি। সংশ্লিষ্টরা বলছে, এই প্রকল্পে অর্থায়ন না হওয়া ও বিদেশি দাতাসংস্থাদের অনাগ্রহের কারণেই প্রকল্পের কাজটি ঝুলে আছে।

 

যেভাবে প্রকল্পটি পার করেছে দুই দশক :

২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ধীরাশ্রম আইসিডি নির্মাণ প্রকল্পের জনবল নির্ধারণ-সংক্রান্ত কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে ২০০৪ সালের জুলাই মাসে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্তে পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা যাচাই করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর বিদেশি দুটি যৌথ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ২০০৭ সালের জুন মাসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। সব দিক থেকে প্রকল্পটি গ্রহণযোগ্য বলে সুপারিশ করা হয়। পরে তৎকালীন ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময় যোগাযোগ উপদেষ্টা প্রকল্পটি রেলওয়ে কতৃ‌র্ক বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়নের আগ্রহ দেখালেও তৎকালীন যোগাযোগ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় রেলওয়ে বিভাগ দ্বারা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হওয়ায় বন্দর কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পের সব ডকুমেন্ট রেলওয়েকে হস্তান্তর করে।

 

২০০৭ সালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা, যার বেশির ভাগ অর্থায়ন আইডিএ এম্পটাপ গ্র্যান্ড থেকে পাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রেলওয়ে বিভাগ প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং মাস্টারপ্ল্যানের অন্তর্ভু‌ক্ত করা হয়। এরপর প্রকল্পটি এডিবির অর্থায়নে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়।

 

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথমে চীন সরকার আগ্রহ দেখালেও পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে যুক্ত হয়ে যাওয়ার পর দেশটি আইসিডি নির্মাণে আর আগ্রহ দেখায়নি। এরপর জাপানের একটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত করা হয়। পরে তারাও জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) প্ল্যাটফর্মে ধীরাশ্রম আইসিডি নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। পরে আবার ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জিটুজি পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুবাই সরকারের ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং সরকারের পিপিপি কর্তৃক্ষের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সে অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর দুবাইয়ে ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং দুবাই চেম্বারের যৌথ উদ্যোগে প্ল্যাটফর্ম মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় বন্দরসংক্রান্ত আরও কয়েকটি প্রকল্পের ব্যাপারেও সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছিল। কিন্তু ধীরাশ্রম আইসিডি নির্মাণের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

 

যে কারণে ধীরাশ্রম আইসিডি অত্যন্ত জরুরি :

রাজধানী ঢাকার যানজট কমানো, বিপুল পরিমাণ কনটেইনার হ্যান্ডলিং এবং সারাদেশে পণ্য পরিবহন আরও সহজ করার লক্ষ্যে ঢাকার কমলাপুর থেকে ধীরাশ্রমে আইসিডি স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এছাড়া কমলাপুর স্টেশনে প্রস্তাবিত মাল্টি মোডাল ট্রানজিট হাব নির্মাণ এবং ঢাকা চট্টগ্রাম করিডোরে হাই-স্পিড ট্রেনের স্টার্টিং স্টেশন এবং পদ্মা রেল লিংক কমলাপুর আইসিডি থেকে শুরু হবে। ফলে বিদ্যমান কমলাপুর আইসিডি সংকুচিত হয়ে পড়েবে এবং পণ্য হ্যান্ডলিং ও পরিবহনে ধীরাশ্রমে আরো বড় একটি পূর্ণাঙ্গ আইসিডি স্থাপনের প্রয়োজনীতা অত্যাবশকীয়।

 

সময়ের সাথে সাথে বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ার কারণে খুব শিগগির কমলাপুর আইডিসির কনটেইনার ধারণ ক্ষমতা ছাড়িয়ে যাবে। এ কারণে কমলাপুর আইসিডি ধীরাশ্রমে স্থানান্তর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি নির্মিত হলে বছরে প্রায় ৩ লাখ ৬৮ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব হবে। যা কমলাপুর রেল স্টেশনের আইসিডিতে বছরে হ্যান্ডলিং হয় মাত্র ৯০ হাজার কনটেইনার।

 

প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা :

সর্বশেষ এখন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এই প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে আবার আশার আলো দেখা যাচ্ছে এই প্রকল্পে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আশা করছে এবার এডিবির অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালে ঋণচুক্তি হবে। তারপর ২০২৪ সালে আইসিডির মূল নির্মাণকাজ শুরু হবে।

 

যেভাবে হবে ধীরাশ্রম আইসিডির কাজ :

ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের আওতায় কারিগরি সহায়তা শীর্ষক প্রকল্পে ধীরাশ্রম আইসিডি নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং মূল নকশা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের দিকে এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নকশার কাজ শুরু করেন সংশ্লিষ্ট কনসালটেন্টরা। কাজ শেষে ২০২২ সালের জুন মাসে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

 

প্রকল্পটি দুই ভাগে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথমে ধীরাশ্রম রেল স্টেশনের কাছে নতুন ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও পুবাইলে ধীরাশ্রম সংযোগ ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হবে। আর দ্বিতীয় ভাগে হবে ধীরাশ্রম আইসিডির মূল নির্মাণকাজ।

 

সম্ভাব্যতা সমীক্ষার প্রতিবেদন অনুযায়ী আইসিডি নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে হবে ১৬৮ দশমিক ২১ একর এবং পুবাইল টেক অফ পয়েন্ট থেকে ধীরাশ্রম পর্যন্ত লিংক রেলপথ নির্মাণের জন্য ৫৪ দশমিক ৩৪ একরসহ মোট ২২২.৫৫ একর। পুবাইল টেক অফ পয়েন্ট থেকে ধীরাশ্রম পর্যন্ত ৬ দশমিক ০৯ কিলোমিটার সম্পূর্ণ নতুন রেললাইন নির্মাণ হবে। এতে ৫ দশমিক ৩২ কিলোমিটার হবে লুপ লাইন এবং সাইডিং, তিনটি কালভার্ট ও একটি সেতু, দুটি বি শ্রেণির এবং পাঁচটি সি শ্রেণির লেভেল ক্রসিং গেট। এ ছাড়া সিংগন্যালিংয়ের কাজসহ অন্যান্য কাজও করতে হবে। প্রকল্পটির আওতায় আইসিডির ভেতরে ব্যালাস্টলেস রেলপথ নির্মাণ, আইসিডির প্রয়োজনীয় অপারেশন ভবন নির্মাণ এবং পূর্ত কাজসহ অন্যান্য কাজ করতে ব্যয় হবে ৩ হাজার ৭৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট