শিশুসন্তানকে জামিকে নিয়ে সাতকানিয়ার বাসিন্দা উম্মে হানিফা এসেছিলেন নগরীর আগ্রাবাদের বিশেষায়িত কেন্দ্রীয় চর্ম ও সামাজিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে (আমেরিকান হাসপাতাল)। ৫ বছর বয়সী শিশুর শরীরে দীর্ঘদিন ধরে চুলকানির পাশাপাশি হাত, পায়ে ঘা হয়ে যাচ্ছে। নিকটস্থ ফার্মেসির দোকানে গিয়ে ওষুধ নিলেও সারছে না চুলকানির যন্ত্রণা। হানিফা জানান, শিশুকে নিয়ে একবার সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে চর্মরোগের কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। যার কারণে বাধ্য হয়েই এতদূর পাড়ি দিয়ে ছুটে আসেন আগ্রাবাদের বিশেষায়িত এ হাসপাতালে।
চর্মরোগীর এ স্বজনের কথার সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শুধু সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই নয়, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার মধ্যে ৯ উপজেলায় নেই চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। এজন্য গ্রামের রোগীদের কয়েক কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে ছুটতে হয় নগরে চর্মরোগের বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্র আগ্রাবাদে কিংবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রামে ১৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও তারমধ্যে শুধুমাত্র ১০টি উপজেলায় চর্মরোগের জুনিয়র কনসালটেন্ট বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ রয়েছে মাত্র একজন করে। বাকি পাঁচটি উপজেলাতে কোন পদই নেই। ১০ উপজেলার জন্য দশজনের পদ থাকলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬ জন। এরমধ্যে সন্দ্বীপ, রাউজান, ফটিকছড়ি, কর্ণফুলী, সাতকানিয়া উপজেলায় কোন পদই নেই। বাকি উপজেলাগুলোতে পদ থাকলেও লোহাগাড়া, পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া ও মিরসরাই এ চার উপজেলায় কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই নেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ এর জনশুমারির তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় বর্তমানে জনসংখ্যা রয়েছে ৪২ লাখ ৮২ হাজার ৭৫৫ জন। যদিও বাস্তবে এ সংখ্যা অর্ধকোটি ছাড়ানোর কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। সে তুলনায় ৫০ লাখ মানুষের চর্মরোগের চিকিৎসায় মাত্র ৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োজিত রয়েছেন।
চমেক এবং বিশেষায়িত চর্ম ও সামাজিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুই হাসপাতালে আসা রোগীদের অর্ধেককে স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব। এসব রোগীরা যে সকল সমস্যা নিয়ে হাসপাতাল দুটিতে ভিড় করেন, তাদের যদি উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা প্রদান করা যেত, তাহলে এতদূর পাড়ি দিতে হত না। আবার অনেক রোগী পাওয়া যাচ্ছে- যাদের সমস্যা ছোট হলেও ফার্মেসির দোকান থেকে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করে রোগের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছেন। পড়ছেন বড় সমস্যাতেও। তাই স্থানীয় পর্যায়ে এ রোগের চিকিৎসা প্রদানের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বিকল্প নেই।
চট্টগ্রাম বিভাগের একমাত্র বিশেষায়িত কেন্দ্রীয় চর্ম ও সামাজিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের (আমেরিকান হাসপাতাল) ইনচার্জ সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. লুৎফুর রহমান রাহাত বলেন, ‘দূর- দূরান্ত থেকে হাসপাতালটিতে গড়ে প্রতিদিন সহস্রাধিক রোগী সেবা নিতে আসেন। অনেকেই যে সমস্যা নিয়ে আসেন, তা স্থানীয় পর্যায়ের চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেও সমাধান সম্ভব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের উপজেলা বা গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র থাকলেও এসব হাসপাতালে চর্মরোগের পৃথক কোন ইউনিট কিংবা বিশেষ সেবা কেন্দ্র নেই। যার দরুন চর্মরোগীরা পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের একটি মাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল কেন্দ্রীয় চর্ম ও সামাজিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে (আমেরিকান হাসপাতাল) এবং চমেক হাসপাতালে ভিড় করে থাকেন। এতে করে রোগী ও স্বজনদের কষ্টের পাশাপাশি অতিরিক্ত অর্থও ব্যয় করতে হয়।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, ‘জনবল সংকট বহুদিনের। তবে হাসপাতালগুলোতে চর্মরোগের তেমন একটা রোগী আসেন না। যারা আসেন তাদের চিকিৎসা মেডিকেল অফিসাররা দিতে পারেন। এছাড়াও সরকারিভাবে যথেষ্ট পরিমাণের ওষুধও হাসপাতালগুলোতে রয়েছে। এর বাইরে জটিল কোন রোগী পেলে তাকে বিশেষায়িত হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়ে থাকে। যদিও উপজেলা পর্যায়ে আরও চিকিৎসকের প্রয়োজন আছে।’
স্থানীয় পর্যায়ে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগের পাশাপাশি চর্মরোগের আলাদা ইউনিট করার বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে নজর রাখার পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ ডার্মাটোলজিক্যাল সোসাইটির সদ্য বিদায়ী সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কম করে হলেও দু’জন বিশেষজ্ঞ থাকা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে চর্মরোগ হচ্ছে ছোঁয়াছে রোগ। অনেকেই না বুঝে বা ডাক্তার না পেয়ে ফার্মেসির দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন, কিন্তু তাতে রোগ তো সারছেই না, উল্টো মারাত্মক সমস্যায় পড়ছেন। আবার যেসব রোগী বিশেষায়িত হাসপাতাল বা চেম্বারগুলোতে আসেন, তাদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ রোগীর সমস্যা স্থানীয় পর্যায়েই করা যায়। এ জন্য অবশ্যই উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসক দরকার। বিষয়টি সরকারের নজরে রাখা উচিত।’
পূর্বকোণ/আরডি