চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

বসিয়ে বসিয়ে ‘হাতি পুষছে’ সরকার

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ১:৫৪ অপরাহ্ণ

প্রতি মাসে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন গুনতে হচ্ছে ৪০ লাখ টাকার উপরে। পুরোনো স্ক্র্যাপ বিক্রি, ক্লাব-ক্যান্টিন ভাড়া ও সরকার থেকে টানাটানি করে বেতনের টাকা জোগাড় করতে হচ্ছে। আমিন জুট মিল বন্ধ হওয়ার তিন বছর ধরে এভাবে টানাপোড়নের সংসার চলে আসছে। সোজা কথা হচ্ছে, মিলটি বন্ধ করে এখন হাতি পুষছে সরকার।

আমিন জুট মিলের মহাব্যবস্থাপক এএইচএম কামরুল হাসান গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘গুদামসহ কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিয়ে চলছে হচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত অনেক তরুণ এখন কর্মস্থল নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে কর্মদক্ষ এসব কর্মকর্তাদের আত্মীকরণের সুযোগ রয়েছে। এখন বসে বসে বেতন দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। অলস সময় কাটানো, বেতন নিতে যেমন তাদের ভালো লাগছে না, অন্যদিকে লোকসান গুনতে হচ্ছে সরকারকেও।

২০২০ সালের ১ জুলাই সরকার পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করে। এসময় বন্ধ হয়ে যায় দেশের পুরোনো পাটকল আমিন জুট মিলও। গোল্ডেন হ্যান্ডসেকের মাধ্যমে শ্রমিকদের অবসর দেওয়া হয়। এরপর থেকে অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছেন শ্রমিকেরা।  আমিন জুট মিল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আরিফুর রহমান বলেন, ‘সীমিত আকারে মিল চালু করার দাবি রয়েছে কর্মচারীদের। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারিভাবে চালু হলে সরকার ও শ্রমিক উভয়ই লাভবান হবেন।’ তিনি বলেন, দেশ-বিদেশে পাটজাতীয় পণ্যের কদর বাড়ছে। মিল ও দক্ষ শ্রমিক থাকায় কারখানা চালু করতে বড় ধরনের বেগ পেতে হবে না সরকারকে। পাটকলগুলো চালু থাকলে অনেক পণ্য রপ্তানি করার সুযোগ ছিল। এতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হতো।’

১৯৫৪ সালে আমিন জুট মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। ৮১ একর জমির উপর পাটশিল্পটি গড়ে ওঠে। পাকিস্তানের নাগরিক ‘আমিন সাহেব’ মিলটি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয় আমিন জুট মিলকে। শ্রমিকেরা জানান, স্বাধীনতার পরও প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। ৯০ দশকেও স্থায়ী আর অস্থায়ী মিলে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক ছিলেন। বন্ধ হওয়ার আগেও প্রায় চার হাজার শ্রমিক ছিলেন।

শ্রমিকেরা জানান, পাকিস্তান আমলের বেশিরভাগ মেশিনই পুরোনো। প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় অনেক যন্ত্রাংশ মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। একাধিক শ্রমিক বলেন, সরকার- বেসরকারিভাবে মিল চালু হবে সেই আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন শ্রমিকেরা। অন্যথায় দক্ষ শ্রমিক হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাটকলের জন্য শ্রমিক খোঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে। একই সঙ্গে দেশের সোনালি ঐতিহ্য পাটশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।

শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আরিফুর রহমান বলেন, ‘পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাটচাষিরাও বেকায়দায় রয়েছে। দেশের সোনালি আঁশ ধ্বংসের পথে বসেছে। পাটচাষিরাও পাটকল চালুর দাবি করে আসছে।’

আমিন জুট মিলের মহাব্যবস্থাপক এ এইচ এম কামরুল হাসান বলেন, ‘বেসরকারি খাতে দেওয়ার আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

শ্রমিকেরা জানান, ৯০ এর দশকেও হাজারো শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে জমজমাট ছিল মিলটি। ৯২-৯৩ সালের পর থেকে শুরু হয় দৈন্যদশা। শ্রমিকদের দাবি, তৎকালীন সরকারের উদাসীনতায় লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি রহস্যজনক কারণে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। লোকসানের ঘানি টানতে টানতে জৌলুসপূর্ণ শিল্প প্রতিষ্ঠানটি মৃত্যুকূপে চলে গেছে।

শ্রমিকেরা জানান, আমিন জুট মিলে উৎপাদিত কার্পেট, জায়নামাজ, চর্টের বস্তা বিখ্যাত ছিল। বড় ক্রেতা ছিল ইরান। আমিন জুট মিলের কার্পেটেই ঢাকা-বাগদাদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল মধুর। ইরাক-ইরান যুদ্ধের পর সেই বাজার হারিয়ে যায়। নতুন কোনো বাজার আর সৃষ্টি করা যায়নি। এছাড়াও আমিন জুট মিলে তৈরি কম্বল ও কাপড়ও বিদেশে রপ্তানি করা হতো। ২০১৮ সালে পাটের বস্তায় প্লাস্টিকের আবরণ (লেমিনেশন) করা শুরু হয়। বাজারে এই ধরনের বস্তার ভালো চাহিদা রয়েছে।

আমিন জুট মিল সিবিএ’র সভাপতি আরিফুর রহমান বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত জুট মিলগুলোর উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত ও রপ্তানিতে যুগোপযোগী উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিলে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের ধারা বজায় রাখতে পারতো।

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন