মিরসরাইয়ের বিস্তীর্ণ জনপদ রক্ষায় বঙ্গোপসাগার উপকূলে নির্মিত সিডিএসপি বাঁধ ভাঙনের মুখে। সাড়ে ১১ কিলোমিটারের এ বাঁধ ভাঙলে নেমে আসবে চরম বিপর্যয়। বিস্তীর্ণ জনপদ, শত শত মৎস্য ঘেরের পাশাপাশি ব্যাহত হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের উন্নয়ন কাজ। এছাড়া কার্যত অচল হয়ে পড়বে ‘মুহুরি’ সেচ প্রকল্প।
সিডিএসপি বাঁধ ভাঙলে বিপর্যয় : মিরসরাইয়ের বিস্তীর্ণ জনপদ বঙ্গোপসাগর থেকে রক্ষায় ১৯৯৪ সালে চর ডেভেলপমেন্ট এন্ড সেটেলমেন্ট প্রকল্পের (সিডিএসপি) ১১.৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ফলে এখানকার বাঁশখালী ও ইছাখালী এলাকায় গড়ে ওঠে হাজার হাজার একর মৎস্য ঘের। যা থেকে চট্টগ্রামের মৎস্য খাদ্য চাহিদার ৭০ ভাগ উৎপাদিত হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন বলছে, চলতি বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙে গেলে এখানে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিবে। পাশ্ববর্তী এলাকার মানুষ হারাবে ভিটেবাড়ি, কৃষক হারাবে জমি, নদী গর্ভে বিলীন হবে শত শত মৎস্য ঘের। ব্যাহত হবে এ এলাকায় বাস্তবায়ন হতে যাওয়া দেশের সর্ববৃহৎ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের উন্নয়ন কাজ। সরেজমিন সিডিএসপি বাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের উত্তর অংশের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা ফেনী নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। বাকি অংশটুকু বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগর অববাহিকায়। স্থানীয়দের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, একসময় নদী ও সাগর থেকে বাঁধের দূরত্ব ছিল প্রায় ৭শ মিটার। বর্তমানে কোথাও ১০ মিটার আবার কোথাও ১৫ মিটার দূরত্ব রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের বর্ষা মৌসুমে গুরুত্বপূর্ণ এ বাঁধ ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়বে। দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় ভাঙন রোধে সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সুরক্ষার জন্য সিসি ব্লক বসালেও বর্তমানে তা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আমি সরেজমিন গিয়ে দেখেছি সেখানে ভয়ঙ্কর অবস্থা। যে কোন সময় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ২০২১ সালে পানি সম্পদ মন্ত্রী ও সচিব বরাবরে ই-মেইলে করেছিলাম। কিন্তু কার্যত কিছুই হয়নি।’
ব্যাহত হবে শিল্পনগর উন্নয়ন : বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিব শিল্পনগরের উত্তরাংশের পুরোটাজুড়ে প্রতিরক্ষার কাজ করছে সিডিএসপি বাঁধ। এটিতে ভাঙন দেখা দিলে শিল্প নগরের উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হবে শঙ্কা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের। মিরসরাইয়ের ইউএনও মাহফুজা জেরিন পূর্বকোণকে বলেন, ‘খুব সহসা পাউবো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিবে। জনবসতি, মৎস্য প্রকল্প ও বাস্তবায়নাধীন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন কাজ ক্ষতির মুখে পড়বে। আমি বিষয়টি দেখছি এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে কথা বলবো।’ মিরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ এ ধরণের প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে যোগাযোগ করেছি তবে এখনো কিছুই হয়নি। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর এলাকার কর্মকর্তারা বলছেন, সিডিএসপি বাঁধ ভাঙনের বিষয়টি তাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড আশ^স্থ করেছে অর্থনৈতিক অঞ্চল সুরক্ষায় নির্মিত সুপার ডাইকের সঙ্গে যুক্ত করে সহসা এটি পুননির্মাণ করা হবে। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন পূর্বকোণকে বলেন, ‘এ বিষয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত উদ্যোগ নিয়ে বিষয়টি বাস্তবায়ন করবো।’ ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমান চৌধুরী পূর্বকোণকে জানান, নদীর ভাটি এলাকায় জমে থাকা পলি ড্রেজিংয়ে আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তবে এ বিষয়ে আর কোন অগ্রগতি নেই।
কার্যকারিতা হারাবে সেচ প্রকল্প : ফেনী, মুহুরী ও কালিদাস নদীর সম্মিলিত পানি প্রবাহকে সেচ কাজে লাগাতে এবং ফেনী, সোনাগাজী ও মিরসরাই এলাকার বিস্তীর্ণ জনপদকে বন্যা ও ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে বাস্তবায়ন করা হয় মুহুরি সেচ প্রকল্প। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্পের ভাটিতে প্রায় ৭শ বর্গমিটার এলাকা পলি জমে ৭৫ ভাগ ভরাট হয়ে গেছে। এতে নদীর একদিকে চর জেগে উঠছে অন্যদিকে ভাঙন দেখা দিয়েছে। আবার সেচ প্রকল্পের বেশ কিছু স্লুইস গেট পলি জমায় ইতোমধ্যে কার্যকারিতা হারিয়েছে।
মিরসরাইয়ের ওচমানপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা দুখু মিয়া জানান, ২০১৯ সালের শুকনো মৌসুমে প্রকল্পের মুখে বালি ও মাটি জমে। বর্ষায় ভাঙন দেখা দেয়, যা গত ৩৫ বছরেও এখানকার মানুষ দেখেনি। ইতোমধ্যে শতাধিক মৎস্য ঘের নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। মিরসরাইয়ের ওচমানপুর ইউনিয়নের আজমপুর গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ হোসেন পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমরা নদীর আচরণ বুঝি। জমা হওয়া বালু মাটি খনন করলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। গত ৩৫ বছর এখানে আমরা ভাঙন দেখিনি। এখন বালু জমার কারণে ভাঙন হচ্ছে।’
পূর্বকোণ/পিআর