আলিকদমের গভীর অরণ্য থেকে বন্যপ্রাণী পাচার থামছে না। এবার পুলিশের হাতে ধরা পড়লো বিপন্ন প্রজাতির চশমা পরা হনুমান। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কলেজ গেট এলাকায় চট্টগ্রামমুখী এস আলম পরিবহণের একটি বাস থেকে গত বৃহস্পতিবার সকালে হনুমানটি উদ্ধার করা হয়। বাসচালক জসিম নিজেই হনুমানটি পাচার করছিলেন। জসিমকে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
চন্দনাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনোয়ার হোসেন জানান, বেশ কিছুদিন ধরে বিরল প্রজাতির বিভিন্ন দুর্লভ বন্যপ্রাণী পাচার হচ্ছে। গোপন সংবাদে জানতে পারি, এস আলম পরিবহনের একটি বাসে হনুমানটি পাচার হচ্ছিলো। গত বৃহস্পতিবার গাছবাড়িয়া কলেজ গেট এলাকায় বাসটি থামিয়ে তল্লাশি করা হয়। এক পর্যায়ে বাসের ব্যাটারি বক্সের ভেতর থেকে খাঁচায় বন্দী হনুমানটি উদ্ধার করা হয়। এ সময় বাসচালক জসিম উদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি হনুমান পাচারের বিষয়টি স্বীকার করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বাসচালক জসিম জানান, হনুমানটি আলিকদম থেকে এক ব্যক্তি চকরিয়ায় এনে তার কাছে দেয়। এটি ঢাকা নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
বাসচালক জসিম এর আগেও বন্যপ্রাণী পাচার করেছেন। হনুমান উদ্ধারের দিনই তাকে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন চন্দনাইশ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিমরান মোহাম্মদ সায়েকের নেতৃত্বে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত। হনুমানটি চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
আনোয়ারা সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) কামরুল ইসলাম বলেন, এর আগে বিরল রাজধনেশ উদ্ধার করেছিলাম আমরা। পাচারে অভিযুক্তরা জানিয়েছেন- বান্দরবানের আলিকদমের গহীণ অরণ্য থেকে প্রাণীগুলো পাচার হচ্ছে। চট্টগ্রাম-ঢাকা হয়ে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে প্রাণীগুলো পাশের দেশে পাচার হচ্ছে। এসব প্রাণী পাচারে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট রয়েছে।
জানা যায়, চশমাপরা হনুমানের ইংরেজি নাম ফেয়ার্স লিফ মানকি। ফেয়ার্স ল্যাঙ্গুর নামেও এটি পরিচিত। বাংলায় এদেরকে কালো হনুমানও বলে। দুই চোখের চারপাশে গোলাকার বৃত্তের মতো সাদা রং থাকে বলে এদের চশমা পরা হনুমান বলে। এদের শরীরের বেশিরভাগ অংশই কালো। এটি বিপন্ন তালিকাভুক্ত প্রাণী। চশমা পরা হনুমান পাতা, ফুল ও ফল খায়। মাঝেমধ্যে পোকা-মাকড়, পাখির ডিমও খায়। মূলত এরা নিরামিষভোজী। অন্য হনুমানের চেয়ে এরা লাজুক প্রকৃতির। দিনের বেলায় ঘন বনের ছায়াযুক্ত স্থানে বিচরণ করতে পছন্দ করে। সহজে এরা মাটিতে নামে না। দলবেঁধে চলাফেরা করলেও সহসা এদের চোখে পড়ে না।
এর আগে গত ২৮ মে মধ্যরাতে ঢাকাগামী শ্যামলী পরিবহন থেকে একজোড়া রাজধনেশ উদ্ধার করে চন্দনাইশ থানা পুলিশ। এ সময় মিজানুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। একজোড়া রাজধনেশ দুই লাখ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন আটক মিজান।
গত ২৫ মে বাঁশখালীর গুনাগরি বাজারে একটি সিএনজিচালিত ট্যাক্সি থেকে চারটি রাজধনেশের বাচ্চা উদ্ধার করেছিল বাঁশখালী থানা পুলিশ। ওই সময় ট্যাক্সিচালক সেলিম জানিয়েছিলেন এর আগেও তিনি চার-পাঁচ জোড়া ধনেশ একই পথে পাচার করেছেন। সেলিমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ধনেশ নিতে ঢাকা থেকে আসা মিজানুর রহমান নামে একজন প্রাইভেটকার চালককে আটক করা হয়। পরে দুইজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গত বছরের ৮ অক্টোবর রাতে লোহাগাড়ার চুনতি রেঞ্জ অফিসের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে বিলুপ্তপ্রায় একটি উল্লুক উদ্ধার করা হয়। এ সময় দুই পাচারকারীকে আটক করা হয়। উল্লুকটি আলিকদম থেকে তারা ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। ২৭ অক্টোবর আমিরাবাদ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিপন্ন প্রজাতির একটি চিতা বিড়াল, তিনটি মেছো বিড়াল ও একটি বন মোরগ উদ্ধার করে লোহাগাড়া থানা পুলিশ। এ সময় এমরান ও আবদুল আলীম নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়।
১০ নভেম্বর কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাসে তল্লাশি করে একটি সজারু, একটি পেঁচা ও দুটি লজ্জাবতী বানর উদ্ধার করা হয়। আটক করা হয় এরশাদ নামে এক যুবককে।
চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকার জানান, আলিকদম থেকে চকরিয়া-বাঁশখালী, থানচি-বান্দরবান-কাপ্তাই-রাঙ্গুনিয়া-রাউজান, চকরিয়া-চট্টগ্রাম এ তিন রুটে বিপন্ন প্রাণী পাচার হচ্ছে ঢাকায়। পরে সীমান্ত পার হয়ে এসব প্রাণী যাচ্ছে পাশের দেশে।
বন্যপ্রাণী পাচাররোধে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট নামে বন বিভাগের একটি স্বতন্ত্র ইউনিট থাকলেও তাদের কার্যক্রম তেমন একটা নেই বললেই চলে। অথচ আলিকদম থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সড়ক পথে বনবিভাগের একাধিক চেকপোস্ট রয়েছে। এসব বিপন্ন প্রাণী পাচার হলেও অনেকটা নীরব বন বিভাগ। তবে কাঠ পাচারকারীদের সাথে যোগাযোগ ঠিকই রয়েছে এসব চেকপোস্টের কর্মকর্তাদের।
পূর্বকোণ/মাহমুদ