আসেফ বিন তাকি। প্রায় এক বছর আগেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) থেকে এমবিবিএস পরীক্ষায় পাস করার পর শুরু করেন ইন্টার্নি। নিয়ম অনুযায়ী পাস করার পরপরই ছাত্রাবাস ছাড়ার কথা। কিন্তু কক্ষ তো ছাড়েননি, বরং বছর ধরে হোস্টেলের রুম দখল করে চালিয়ে যাচ্ছেন ‘নেতাগিরি’।
অভিযোগ আছে- ছাত্রলীগের রাজনীতির দাপট দেখিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থিত ক্যান্টিনে খেয়ে টাকা না দেয়া, চাঁদা দাবি করা, কর্মচারীদের মারধর, দালালদের রক্ষায় তদবির করেন তিনি। তার দাপটে অনেকটাই তটস্থ চমেকের শিক্ষক-চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যা নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষকে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগও দিয়েছেন ভুক্তোভোগীরা।
যদিও অভিযোগগুলো সত্য নয় দাবি করে তাকি বলেন, ছাত্রদের অভিভাবক হিসেবে আমি সব কাজে এগিয়ে আসি, যার কারণে অনেকেই সহ্য করতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই ছাত্রাবাসের মেস ব্যবস্থাপককে মারধর করে আবার আলোচনায় আসেন ছাত্রলীগের এ নেতা। নানা অভিযোগ পেয়ে চমেক প্রশাসন পুলিশের সহায়তায় যৌথ অভিযান চালিয়ে গতকাল তাকিকে হল থেকে বের করে দেয়।
আসেফ বিন তাকি ৫৯তম ব্যাচের এমবিবিএসের শিক্ষার্থী। তিনি বর্তমানে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের একাংশের সংগঠন ইন্টার্ন ডক্টরস এসোসিয়েশনের (আইডিএ) সভাপতি। তাকি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী বলে জানা গেছে।
বাকি খেয়ে দিতেন না টাকা, উল্টো নিতেন চাঁদা, করতেন মারধরও : গত ৩১ জুলাই চাঁদা না দেয়ায় প্রধান ছাত্রাবাসের মেস ব্যবস্থাপক মো. রফিকুল ইসালমকে দু’দফায় মারধর করেন তাকি। যার জেরে বর্তমানে হোস্টেলের মেস/ডাইনিং বন্ধও রয়েছে। এ বিষয়ে রফিক লিখিতভাবে কলেজ অধ্যক্ষকে অভিযোগ জানিয়েছেন।
রফিকের অভিযোগ- চাঁদা না দেয়ায় মারধর করেন তাকি। দু’দফার মরধরের সময় তার দাঁড়ি টেনে ছিড়ে ফেলা হয়। যার ছবিও জমা দেয়া হয় অভিযোগের সাথে। এর আগেও চলতি বছরের শুরুতে এক দফায় মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ করেন মেস ব্যবস্থাপক।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, খাবার খেয়ে টাকা না দেয়াসহ দুই ধাপে ১৪ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করেন তাকি। পুনরায় চাঁদা না দেয়ায় বেধড়ক মারধর করা হয়। এছাড়াও বিভিন্নভাবে হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। যার কারণে হোস্টেলের মেস/ডাইনিং চালানো সম্ভব নয় বলেও লিখিতভাবে জানান রফিক।
এদিকে, গত দুইদিন ধরে প্রধান ছাত্রাবাসের ডাইনিং/মেস বন্ধ রেখেছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি তাকির ভয়ে ছাত্রাবাসও ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানিয়েছেন সাধারণ ছাত্ররা। মেস বন্ধ থাকায় খাওয়া নিয়ে অনেকটাই বিপাকে সাধারণ ছাত্ররা। এ নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
অভিযোগের বিষয়ে আসেফ বিন তাকি বলেন, ‘রফিক ছাত্রদের অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ান। ছাত্ররা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমি যেহেতু ছাত্রদের অভিভাবক, তাই এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে গেলে রফিক আমার উপর চড়াও হয়ে উচ্চবাক্য করতে থাকে। এজন্য প্রতিবাদ করি। তবে তাকে মারধর করা হয়নি।’
এছাড়াও চলতি বছরের রমজানে পূর্বে প্রধান ছাত্রাবাসের সামনে অবস্থিত ‘লতিফ হোটেল’র ম্যানেজার বোরহানকে রুমে ডেকে নিয়ে বেদড়ক মারধর করেন তাকি। বিষয়টি জানতে পেরে লতিফের ভাই চমেক অধ্যক্ষ কার্যালয়ের কর্মচারী মোতালেব ছাত্রাবাসে যান। এ সময় তাকি মোতালেবকেও চড় থাপ্পড় দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কর্মচারীরা অভিযোগ করে বলেন, ‘লতিফ হোটেলে বাকি খেলেও টাকা দিতেন না তাকি। দীর্ঘদিনের বাকি টাকা চাওয়ায় হোটেলের ম্যানেজারকে মারধর করা হয়। হুমকি দেয়ায় লতিফ হোটেলে ম্যানেজার চাকরি ছেড়ে চলে যান।’
এ বিষয়ে তাকি বলেন, ‘মারধরের অভিযোগ সত্য নয়। বরং তারাও খাবারের দাম বাড়ানোর কারণে সেখানে গিয়ে দাম কমানো হয়।’
এর বাইরে চমেকে অবস্থিত মেডিকপস সুপার শপেও বাকি খেয়ে টাকা না দেয়া এবং নগদ টাকা গ্রহণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাকির একটি লিস্টে দেখা যায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে মেডিকপস। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মালামাল নিয়ে গেলেও একটি টাকাও দিতেন না তাকি।
এ প্রসঙ্গে আসেফ বিন তাকি বলেন, ‘একসঙ্গে বহু জুনিয়র গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে। হয়তো তাৎক্ষণিক বিল দিতে পারে না। তবে পরে আমি দিয়ে দেই। হয়তো সামান্য কিছু পেতে পারে। একদম দেই না এটি সঠিক নয়।’
মেডিকপস’র পরিচালক মো. মহিন উদ্দিন বলেন, ‘একটি টাকাও দেয়নি। টাকা চাইলে বলত লিখে রাখতে। যেহেতু মেডিকেলে ব্যবসা করি, অনেক কিছুই বলতে পারি না।’
দালাল ধরায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টকে মারধর : চলতি বছরের ২৮ মার্চ এক রোগীকে ভাগিয়ে নেয়ার সময় স্পেশাল ওয়ার্ড বয়কে হাতেনাতে ধরেন সোহানুর রহমান সোহান নামে এক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। এর জেরে ৩০ মার্চ সোহানকে মারধর করেন তাকিসহ আরও কয়েকজন। এ বিষয়ে সোহান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করেছেন।
অভিযোগে বলা হয়, দায়িত্ব পালন অবস্থায় সন্ধ্যায় হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির পাশে চা পান করা অবস্থায় আসেফ বিন তাকিসহ কয়েকজন এসে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি ও চড় থাপ্পড় মারতে থাকে সোহানকে। এ সময় তাকি সোহানের উদ্দেশ্যে বলেন- ‘রোগী কোথায় পরীক্ষা করাবে তা দিয়ে তোর কাজ কী?’
এ অভিযোগের বিষয়ে তাকি বলেন, ‘একদিন সন্ধ্যায় সোহান আমাদের সামনে সিগারেট খাচ্ছিল। তাকে ফেলে দিতে বললে সে তা ফেলে দেয়নি। তাই মুখ থেকে নিয়ে আমি ফেলে দিয়েছি। তাকে মারধর করা হয়নি।’
আটক দালালদের ছাড়াতে করতেন তদবির : সাম্প্রতিক সময়ে দালাল নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নিয়েছে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এজন্য নিয়মিতই অভিযান অব্যাহত রেখেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে অভিযোগ আছে- দালালকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিলে তাদের ছেড়ে দেয়ার জন্য জোর তদবির করতেন তাকি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক সদস্য বলেন, ‘দালালদের ধরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। আবার অনেক সময় আমরাও তাদের ধরে থাকি। কিন্তু তাদের ছাড়ার জন্য তদবির করতেন তাকি। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’
ছাড়ার সুপারিশ করা হয়েছে স্বীকার করে আসেফ বিন তাকি বলেন, ‘অনেক সময় গরীব অসহায়কেও দালাল বলে ধরে ফেলেন। মানবিক বিবেচনায় আমি একদিন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জকে কল দিয়েছিলাম, যেন ছেড়ে দেয়।’
নাম প্রকাশ না করা শর্তে হাসপাতালেরও ঊর্ধ্বতন এক কর্মচারী বলেন, ‘পরিচালকের নির্দেশে বহুসংখ্যক দালালকে হাতেনাতে আটক করেছি। কিন্তু তাদের ধরার পরপরই তিনি (তাকি) ফোন দিয়ে ছেড়ে দিতে বলতেন। বিষয়টি আমি পরিচালককেও জানিয়েছি।’
ঘুষের দরকষাকষির অডিও ফাঁস : সম্প্রতি এক কর্মচারীকে চাকরি পাইয়ে দেয়ার জন্য টাকা নিয়ে দরকষাকষির একটি অডিও ফাঁস হয়েছে তাকির। যা প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। অডিওতে তাকি ওই কর্মচারীকে চাহিদা মতো টাকা দিলে চাকরিতে প্রবেশ করিয়ে দিবেন বলতে শোনা যায়। অডিওতে তাকি ৫০ হাজার টাকা দাবি করলেও ওই কর্মচারী ৭ হাজার টাকা ছাড়া বেশি টাকা দিতে পারবেন না বলে বারবার বলতে শোনা যায়। পরবর্তীতে ১০ হাজার টাকা দিতে বলেন তাকি। যা বিকাশ নম্বরে পাঠাতে বলেন।
অডিওটি এডিট করা উল্লেখ করে তাকি বলেন, ‘বিষয়টি আমার নজরে আসলে আমি নাছির ভাইয়ের নির্দেশে চকবাজার থানায় একটি জিডি করি। এ কথপোকথন আমার নয়।’
করেন না ইন্টার্নিও : দীর্ঘ কয়েকমাস ধরে ইন্টার্নি করছেন না আসেফ বিন তাকি। কিন্তু নিয়মিতই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন চমেক ক্যাম্পাস। দখল করে আছেন ইন্টার্ন হোস্টেলের কক্ষও। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী ইন্টার্ন না করলে ব্যবস্থা নেয়ার নিয়ম থাকলেও তাতেও অনেকটাই নিশ্চুপ কর্তৃপক্ষ। যদিও গত প্রায় ৮ মাস ধরে বেতন গ্রহণ করছেন না তিনি। তবে সূত্র জানিয়েছে- বিভিন্ন অভিযোগের কারণে তার বেতন বন্ধ রাখা হয়েছে।
অবশ্য ইন্টার্নি না করার বিষয়টি স্বীকার করে তাকি বলেন, ‘পারিবারিক অসুবিধার কারণে আমি গত ৩ মাস ধরে ইন্টার্ন করছি না। যার কারণে বেতনও বন্ধ রয়েছে।’
যা বললেন কর্তৃপক্ষ : সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ পেয়েছি। কিছু অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। অন্যগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হয়েছে তারা যেন খতিয়ে দেখে। ইতোমধ্যে বুধবার অভিযান চালিয়ে হোস্টেল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশকেও অবহিত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তার কোন দায় কলেজ কর্তৃপক্ষ নেবে না।’
পূর্বকোণ/মাহমুদ