বাবা ও মামার হাত ধরে কর্ণফুলীতে গোসল করতে গিয়েছিল সাড়ে আট বছরের শিশু সিয়াম। কিন্তু গোসল করে সিয়ামের আর ঘরে ফেরা হয়নি। বাবা-মামা’র অলক্ষ্যে নদীতে ভেসে গেল সিয়াম। সলিল সমাধি ঘটল শিশুটির।
শুধু শিশু সিয়াম নয়। সাতকানিয়া, বাঁশখালীতেও কোরবানির ঈদের দিন পরিবার-পরিজনের অলক্ষ্যে-অবহেলায় পানিতে ডুবে মারা যায় আরও দুই শিশু। সাতকানিয়ায় একমাত্র শিশুসন্তানকে হারিয়ে অসুস্থ মা-বাবার বিলাপ থামানো যাচ্ছে না। অসুস্থ মা বিছানায় শুয়ে ছেলের জন্য বিলাপ করে যাচ্ছেন। আরও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে বাঁশখালীতে। কোরবানির ঈদে বাড়ির সবাই গরু জবেহ ও মাংস কাটাকাটিতে ব্যস্ত। সবার ব্যস্ততার মধ্যে ও বাড়ির উঠানে খেলতে গিয়ে পুকুরে পড়ে মারা যায় শিশুটি।
অভিভাবকদের নজরদারি ও সচেতনতার অভাবে প্রতিনিয়ত এভাবেই পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে শিশুরা। শুধুমাত্র কোরবানির ঈদের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত অর্থাৎ এই ২৪ দিন চট্টগ্রাম জেলার নয় উপজেলায় ১১ শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। যাদের বয়স ছিলো ৩ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।
‘মা, ভাইয়া কোথায়? কবে আসবে?’
পূজন সেন, বোয়ালখালী
মা, ভাইয়া কোথায়? কবে আসবে? মায়ের কাছে এই সহজ-সরল প্রশ্ন ৫ বছরের শিশু জান্নাতের। খেলার সাথী ৮ বছর ৫ মাস বয়সী ভাই ওমায়েদ হোসেন সিয়ামকে ঘরে না দেখে মায়ের কাছে এমন প্রশ্ন ছিল শিশুটির। কিন্তু কতো কঠিন, কতো হৃদয়বিদারক প্রশ্ন তা কীভাবে বোঝাবে সন্তানহারা মা। ভাই সিয়াম আর যে কখনো ফিরে আসবে না, মা কীভাবে বুঝাবে তার অবুঝ জান্নাতকে।
গত ৩ জুলাই দুপুরে গোসল করতে গিয়ে কর্ণফুলী নদীতে ডুবে মারা যায় সিয়াম। সিয়ামের কথা উঠতেই চোখের পানি আঁচলে মুছেন মা। নির্বাক-বিমূঢ় তিনি। সিয়ামের সাথে সাথে যেন মায়ের মুখের কথাও যেন হারিয়ে গেছে।
খেলার সাথী ভাই ওমায়েদ হোসেন সিয়ামকে ঘরে না দেখে বার বার খুঁজে ফিরছে বোন জান্নাত। মা-বাবা বলেছে সিয়াম মদিনা শরীফে গেছে। তাই জান্নাত প্রতিদিন দোয়া করে তার বাবাকে যেন মদিনা শরীফে যাওয়ার তৌফিক দেন। ভাই ফিরে আসার প্রহর গুনছে অবুঝ জান্নাত। সে জানে খেলা সাথী ভাই সিয়াম ফিরে আসবে। মেতে উঠবে ভাই-বোনের খুনসুটিতে।
ওমায়েদ হোসেন সিয়াম বোয়ালখালী উপজেলার খরণদ্বীপ শেখ পাড়ার মাওলানা আবদুল মাবুদের ছেলে। সে স্থানীয় জৈষ্ঠ্যপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত।
সিয়ামের মা শামীম আকতার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ছেলেটা তেমন কোনো দুরন্তপনা করতো না। শুধু একটা সাইকেল চেয়েছিল। অভাবের কারণে ছেলেটাকে সাইকেল কিনে দিতে পারিনি।’
মা বলেন, ‘মানুষ করতে চেয়েছিলাম ছেলেকে। সেজন্য বাড়িতে দুইবেলা প্রাইভেট শিক্ষক রেখেছিলাম। ছেলেটা নিয়মিত স্কুলে যেতো। সিয়ামের হরমোনজনিত সমস্যা ছিল। সেই কারণে চিকিৎসা চলছিল।’
বাবা আবদুল মাবুদ একটি মসজিদের ইমাম। তিনি বলেন, ‘সেইদিন সিয়াম, আমি ও সিয়ামের মামা একসাথে গোসল করার জন্য নদীতে যাই। কোনো এক ফাঁকে সিয়াম পানিতে ডুবে গেল তা বুঝতে পারিনি। সাঁতার না জানার কারণে সিয়াম ভেসে গেল।’
অশ্রুসিক্ত আবদুল মাবুদ বলেন ‘সিয়াম যে নেই তা কি করে বলি মেয়েটাকে। শুধু জানতে চায়, ‘ভাইয়া কোথায়।’ সিয়ামের কাপড়-চোপড় সব আগের মতোই পড়ে আছে। সিয়াম বলতো, সে আমার মতো হুজুর হবে। কখনো বলতো মদিনা শরীফ যাবে। তাই জান্নাতের ধারণা সিয়াম মদিনা শরীফে গেছে।’
সিয়ামদের মাটির ছোট ঘরটিতে এখন হাহাকার। সিয়ামের সব স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে মা-বাবা ও বোনের কাছে। পাড়া প্রতিবেশীরা, খেলার সাথীরাও সিয়ামের জন্য শোকে কাতর।
শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের সাবেক সদস্য মো. ইব্রাহীম বলেন, ‘পাড়া-গাঁয়ে দুই-একটি পুকুর থাকলেও তা এখন মজা পুকুরে পরিণত হয়েছে। ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তাই পাড়ার অনেকেই নদীতে গোসল করতে যায়। সিয়ামের মতো আর কারও সন্তানের যেন সলিল-সমাধি না ঘটে, সেই বিষয়ে সবাইকে সচেতন ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
অসুস্থ মা বিছানায় শুয়ে খুঁজছে মেয়েকে
ইকবাল মুন্না, সাতকানিয়া
‘মা-মনি কোথায় চলে গেলে তুমি! আমার কাছে আস। তোমাকে ছাড়া আমি যে থাকতে পারছি না। না হয় আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে যাও।’ ছোট্ট ফারিয়া জান্নাত আইরার (৩) মা মুন্নী আক্তার অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানায় কাতরাতে কাতরাতে মোবাইলে মেয়ের ছবি দেখে এভাবেই বিলাপ করেই যাচ্ছেন।
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আইরা। ছোট্ট আইরাকে নিয়েই তাদের যত হাসি আনন্দ ছিল। কিন্তু আজ সেই আইরা শুধু একটা ছবি। যে ছবি দেখে বাবা-মা দুইজনেই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
গত ১ জুলাই সাতকানিয়ার ছদাহা ফকির পাড়ায় নানার বাড়িতে বাড়ির পাশে পুকুরে ডুবে মারা যায় আইরা।
আইরার বাবা জাহেদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ঈদুর আজহার দু’দিন আগে আমার স্ত্রী মুন্নি আক্তারের অপারেশন হওয়ায় সে আমার শ্বশুর বাড়িতে যায়। তাকে দেখাশোনা করতে সেখানে রেখে আসি। কোরবানের দু’দিন পর সবার চোখের আড়ালে আইরা পুকুরে পড়ে যায়। সে আমার একমাত্র সন্তান। তাকে হারিয়ে জীবনটা আমাদের এলোমেলো হয়ে গেছে। এখন আমার অসুস্থ স্ত্রী বিছানায় শুয়ে শুধু মেয়েকে খুঁজছে। প্রতিটি পিতা-মাতাকে বলবো, তাদের সন্তানকে যেন চোখে চোখে রাখে। সন্তান হারানোর বেদনা যে কত কষ্ট সেটি যে হারিয়েছে সেই জানে।
কোরবানিতে কোরবান হল আদরের সন্তান
অনুপম কুমার অভি, বাঁশখালী
‘আল্লাহ! কীভাবে তুমি ঈদের দিনে গরু কোরবানির সাথে কোরবানি করলে আমার ছেলেকে। কেন তুমি আমার কোল খালি করলে। এমন ঈদ কেন দিলে আল্লাহ আমাকে।’
তিন বছরের শিশু সামিটকে হারিয়ে দিশেহারা মা। সন্তানের কাপড় ও খেলনা বুকে জড়িয়ে বিলাপ করে কান্না করেই যাচ্ছে মা। সেই কান্না থামে না মিথ্যা কোনো সান্ত্বনায়। আত্মীয়-স্বজনরাও যেন ভাষা হারিয়ে পেলেছেন সন্তানহারা মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার।
গত ৩০ জুন শুক্রবার ঈদের দিন বিকেলে ঈদের আনন্দ মাটি করে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যায় সামিট। খানখানাবাদ ইউনিয়নের ডোংরা গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে সামিট বিকেল ৫টার দিকে মা এবং পরিবারের অন্যদের ব্যস্ততার ফাঁকে বাড়ির উঠানে খেলতে গিয়ে পুকুরের পানিতে পড়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন।
শুধু সামিট নয়, ঈদের দিন একই সময়ে শেখেরখীল ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের এহছানুল কবিরের ছেলে মোস্তানির বিল্লাহ (৩) পানিতে ডুবে মারা যায়। ২৮ জুন উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নে ইলশা গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে মোহাম্মদ আবিদ (৩) পানিতে ডুবে মারা যায়।
বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্যমতে, গত ১৭ ও ১৮ জুলাই গন্ডামারা ও শীলকূপে ইউনিয়নে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়। প্রতিমাসে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত ১০-১৫ জন।
বাঁশখালী হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মনির উল্লাহ বলেন, শিশুরা জন্মের পর যখন হামাগুঁড়ি দিয়ে চলতে থাকে তখন অভিভাবকদের সচেতন হতে হয়। সচেতনতার অভাবে শিশু মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে।
পূর্বকোণ/মাহমুদ