কর্ণফুলীর বুকে জেগে রয়েছে বিস্তীর্ণ দ্বীপ। দ্বীপের উত্তরে রাউজান, দক্ষিণে বোয়ালখালী। উজানের দিকে একটু এগোলে দেখবেন নদীর কূল-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি সুউচ্চ পাহাড়। নদী আর পাহাড় যেন প্রেমিক-যুগলের মতো জড়িয়ে রয়েছে। প্রকৃতি যেন অকৃপণ হাতে রাঙিয়েছে। কর্ণফুলীর এ অপরূপ সৌন্দর্য আস্বাদনে নৌ-ভ্রমণে ছুটে যান পর্যটনপ্রেমীরা। কিন্তু এখানে গড়ে উঠেনি কোনো পর্যটনকেন্দ্র। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সমীক্ষায়ও তা উঠে এসেছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সমীক্ষা বলছে, রাঙামাটি ও কাপ্তাই ভ্রমণের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। এখানে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতি নিদর্শন পাওয়া যায়। পাহাড়, নদী, লেক ও পাহাড়ি ছড়া-ঝর্ণা থাকায় পর্যটকদের পরিভ্রমণে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি পর্যটক ও ভ্রমণপিপাসুরা।
জাতীয় নদীর রক্ষা কমিশনের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কর্ণফুলী (কাপ্তাই হ্রদ) ঘিরে ব্যাপক পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। কাপ্তাই বাঁধকে ঘিরে নদীর তীরে গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদীর কাপ্তাই এলাকায় সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি উদ্যোগ অন্তত ১০টি পর্যটন জোন বা পিকনিট স্পট গড়ে ওঠেছে। শীত মৌসুমে জমজমাট থাকে এসব পর্যটনকেন্দ্র কেন্দ্রগুলো।
কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে রাঙামাটি ও কাপ্তাই এলাকায় পর্যটনশিল্প গড়ে উঠলেও অন্য কোনো উপজেলায় সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও পর্যটনকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। নদীকে ঘিরে নেই কৃষ্টি, সংস্কৃতিও।
সমীক্ষাটি বলছে, পানি সম্পদ কাজে লাগিয়ে মানুষ কৃষি আবাদ করে আসছে স্মরণাতীত কাল থেকে। তার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি ও সভ্যতা। সব সভ্যতার গোড়াতেই পানি ও কৃষির অবদান অস্বীকার্য। এ অঞ্চলেও যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের গোড়পত্তন ঘটে এ নদীকে ঘিরে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো পানিসম্পদকে সুষ্ঠু ব্যবহার করেই অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছাড়াও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পানির চাহিদা পূরণে পৃথিবীর সব দেশেই এখন পানি সংরক্ষণের মনোযোগী হয়েছে।
কর্ণফুলী নদী থেকে পানি ব্যবস্থাপনা করে আসছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বোয়ালখালীর জ্যৈষ্ঠপুরায় গড়ে তোলা হয়েছে ভাণ্ডলজুড়ি পানি শোধনাগার প্রকল্প। এ প্রকল্প থেকে পানি যাবে দক্ষিণ চট্টগ্রামে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাহাড়ে পাদদেশে কর্ণফুলীর তীরে গড়ে উঠেছে ওয়াসার পানি শোধনাগার প্রকল্প। প্রকল্পের উজানের দিকে সারি সারি সুউচ্চ পাহাড় আর পাহাড়। নদীর স্বচ্ছ জলরাশিতে পানকৌড়ির খেলা, জেলেদের মাছ ধরা ও নদী-পাহাড়ের মিতালি বিমোহিত করে ভ্রমণকারীদের। এর অদূরে রয়েছে বিস্তীর্ণ দ্বীপ। স্থানীয়রা যাকে নাজিরচর বলে। কথিত রয়েছে, মোগল সম্রাট আকবর নাজিরের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে চরটি নাজিরকে দান করেছিল। সেই থেকে চরের নাম হয়েছে নাজিরচর।
নদী কমিশনের সমীক্ষা বলছে, রাঙ্গুনীয়ার ঘাটচেক, বোয়ালখালীর খরণদ্বীপের বেতাগী, পটিয়ার কোলাগাঁও এলাকায় ডুবোচর রয়েছে। এসব চরকে ঘিরে পর্যটনের অপরা সম্ভাবনা রয়েছে।
চট্টগ্রাম-৮ আসনের সাবেদ সংসদ সদস্য প্রয়াত মইনউদ্দিন খান বাদল নাজিরচর ও জ্যৈষ্ঠপুরা পাহাড়কে ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও আইটি ভিলেজ গড়ে তোলা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বোয়ালখালীবাসীকে। নদী ও জ্যৈষ্ঠপুরা পাহাড়কে ঘিরে বিশ্বমানের আইটি ভিলেজ গড়ে তোলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সংসদ সদস্য বাদলের মৃত্যুর পর অপমৃত্যু ঘটে আইটি ভিলেজ ও অর্থনৈতিক জোনের।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চাষি মোজাম্মেল হক বকুল বলেন, কর্ণফুলী নদীর তীরে জ্যৈষ্ঠপুরা ও রাঙ্গুনিয়ায় অসংখ্য পাহাড় রয়েছে। ফলমূল, সবজি চাষে ভরপুর থাকে এসব পাহাড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন সংযোজন হয়েছে পাহাড়ি ছড়ায় মৎস্য চাষ। তিনি বলেন, পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা পথ বেয়ে জ্যৈষ্ঠপুরা থেকে রাঙ্গুনিয়ায় সড়কপথেও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে। নদী-পাহাড়কে ঘিরে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। কিন্তু উদ্যোগের অভাবে গড়ে উঠেনি পর্যটনকেন্দ্র।
পর্যটনের নতুন দিগন্ত
কর্ণফুলী নদীর তীরে ‘কর্ণফুলী লুকআউট’ নামে শিশুপার্ক ও খেলার মাঠ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে জেলা প্রশাসক এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কর্ণফুলী নদীর তীরঘেঁষে সদরঘাট এলাকায় প্রায় সাড়ে ১৪ একর সরকারি খাস জায়গার উপর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এতে লন্ডন আইয়ের আদলে সংযোজন করা হবে ফেরিস হুইল। এছাড়াও চিত্ত বিনোদন ছাড়াও পিকনিক স্পট, ওয়ার্কওয়ে নির্মাণ করা হবে। ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
১২ জুলাই শিশুপার্ক ও খেলার মাঠ নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শন গিয়ে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছিলেন, জেলা প্রশাসনের খাস জমিতে কর্ণফুলী নদী সুরক্ষিত রেখে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ এবং শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে সবুজ পার্ক ও খেলার মাঠ গড়ে তোলা হবে।
সমীক্ষাটি বলছে, কৃষিকাজে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার ৪০ শতাংশ, ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার ৬০ শতাংশ। মূলত কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষাবাদ হয়ে আসছে। এতে কর্ণফুলীর অবদান অস্বীকার করার জো নেই।
পূর্বকোণ/মাহমুদ