কর্ণফুলী নদীর বোয়ালখালীর জৈষ্ঠ্যপুরা ভাণ্ডালজুড়ি খালের মোহনায় দাঁড়ালে দেখা যায়, খালের একপাড়ে ফেলা হয়েছে সিসি ব্লক। এতে রক্ষা পেয়েছে শত শত ঘরবাড়ি। এখন দেখা দিয়েছে নতুন বিপত্তি। ভাঙছে খালের অপর পাড়ে। ভাঙনের মুখে পড়েছে ঘরবাড়ি। নদী ও খালের মোহনা হওয়ায় এখানে ভাঙন তীব্র রূপ নেয়।
শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোকারম বলেন, ‘ভাণ্ডালজুড়ি খালের পূর্বপাড়ে ফতেরখালী উত্তরপাড়া, হাটখোলা, শ্রীপুরের ভারাম্ভা ও জৈষ্ঠ্যপুরা শেখপাড়ায় ভাঙন ধরেছে। তবে এসব এলাকায় ভাঙনরোধে সিসি ব্লক ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ মহোদয়।’
শুধু জৈষ্ঠ্যপুরার এ গ্রামটি নয়, কর্ণফুলীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও নানা ধরনের স্থাপনা। বর্ষা মৌসুমে ভাঙন তীব্র হয়। বোয়ালখালী ছাড়াও রাউজান, রাঙ্গুনীয়া, কাপ্তাই অংশে ভাঙছে কর্ণফুলী। কেড়ে নিচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি ও জমিজমা। অন্তত তিন দশক ধরে ভাঙছে কর্ণফুলী। ভাঙনরোধে কার্যকরী উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রতিনিয়ত ভাঙছে নদীটি। তবে রাঙ্গুনীয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাঙনরোধে বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশাল এলাকাজুড়ে সিসি ব্লক ফেলা হয়েছে।
কর্ণফুলীর গতি-প্রকৃতি নিয়ে সমীক্ষা করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, রাঙামাটি ও চট্টগ্রাম জেলার ৫ উপজেলায় নদী ভাঙনের মুখে রয়েছে ৭৭৫০ মিটার। এতে ৭০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অন্য জায়গায় স্থানান্তর হয়েছে। কাপ্তাই উপজেলার দুই ইউনিয়নের এক কিলোমিটার এলাকায় ভাঙনে ৫০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও রাঙ্গুনীয়া, বোয়ালখালী, রাউজান, সিটি করপোরেশনের ১৭ স্থানে নদী ভাঙনের শিকার ৬৭৫০ মিটার এলাকা। এতে ২০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে ভাঙন সৃষ্টি হয়।
সমীক্ষাটি বলছে, নদী ভাঙনে রাঙ্গুনীয়ার বেতাগীতে ভেঙেছে ৭০০ মিটার। প্রতিবার ভাঙছে এলাকাটি। কাউখালীতে তিন স্থানে ১৫০০ মিটার ভেঙেছে। ৫ বছরে কোথাও তিনবার, কোথাও দুইবার করে ভেঙেছে। কোলাদা এলাকায় ভেঙেছে ৮শ মিটার। এখানে প্রতি বছর ভাঙ্গে। শিলকের দুটি এলাকায় ৪শ মিটার ভেঙেছে। শরফভাটায় ২৫০-২৫০ মিটার ভেঙেছে। বোয়ালখালীর চরণদ্বীপে ৭৫০ মিটার ভেঙেছে। এখানকার বিভিন্ন স্থানে ভাঙনরোধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রতিবছর কর্ণফুলী কেড়ে নিচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। বোয়ালখালীতে ৯৫০ মিটার এলাকা ভেঙে গেছে। রাউজান নোয়াপাড়ায় ১৫০০ মি, বাগোয়ান ৩০০ মিটার ও ১৮ মিটার এলাকার কৃষি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নগরীর চান্দগাঁওয়ের চর মোহরা ২০০ মিটার ভেঙেছে।
নদী ভাঙনরোধে পাউবো :
নদী ভাঙনরোধে বড় প্রকল্প হয়েছে রাঙ্গুনীয় উপজেলায়। এছাড়াও রাউজান ও বোয়ালখালীতে ভাঙনরোধে সিসি ব্লক ফেলা হয়েছে। ২০১৩ সালে ভাঙনরোধে বোয়ালখালীতে ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে সিসি ব্লক ফেলা হয়েছে। ২০১৮ সালে ৩৯৬ কোটি নয় লাখ ৭৭ হাজার টাকার এই প্রকল্প নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। রাঙ্গুনীয়া অংশে প্রকল্পটি নেয়া হয়। ড্রেজিং ও নদীর তীর রক্ষায় প্রকল্পটি থেকে ৯৭ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। মূলত ইছামতি নদীর ড্রেজিং করতে না পারায় এই টাকা সাশ্রয় হয়েছে। এখন সেই সাশ্রয়ী টাকাসহ ১৩৫ কোটি টাকা দিয়ে রাঙ্গুনীয়া ও বোয়ালখালী অংশে ভাঙনরোধে নতুন প্রকল্প নিয়েছে পাউবো।
ভাঙনরোধে ফাইলবন্দী প্রকল্প :
২০১৮ সালের এপ্রিলে কর্ণফুলী নদীর ভাঙনরোধে ৩৫১ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। বোয়ালখালী অংশে কর্ণফুলী ও নদী সংলগ্ন খালের ভাঙনরোধে প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। ২০২২ সালে তা কাটছাঁট করে ১৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়। এক বছর ধরে প্রকল্পটি পড়ে রয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। রাঙ্গুনীয়া ও বোয়ালখালী অংশে ভাঙনরোধে ১৩৫ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
কর্ণফুলী নদী ও কাপ্তাই হৃদের উন্নয়নে এক হাজার ৩৫৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প জমা দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পর্যটনশিল্পের বিকাশ, কৃষিজপণ্যের বাজারজাত সহজীকরণ, নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও কাপ্তাই হ্রদের পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রকল্পটি নেয়া হয়। প্রকল্পে কর্ণফুলী নদীর উভয় তীরে ৮ দশমিক ১৫৫ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
ড্রেজিং :
২০১৮ সালে নদীর ভাঙনরোধ ও ড্রেজিং করার লক্ষ্যে ৩৫১ কোটি টাকার প্রকল্প প্রায় শেষপর্যায়ে। প্রকল্পে কর্ণফুলী ও ইছামতি নদীর ১৬ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং করার কথা ছিল। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের নকশা প্রণয়নের ভুলে ইছামতি নদী ড্রেজিং অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট থেকে নাজিরচর এলাকা পর্যন্ত ড্রেজিং করা হয়। প্রকল্পটি প্রায় শেষপর্যায়ে। এছাড়াও কাপ্তাই হৃদ ও কর্ণফুলী খনন নিয়ে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পটিতে কর্ণফুলী নদী ও সংযুক্ত নদী-খাল, কাপ্তাই লেকের ১০ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হবে।
নাব্যতা :
কর্ণফুলী নদীর রাঙামাটি ও চট্টগ্রাম জেলার ১০ উপজেলার ৩৭ ইউনিয়নের ৭৭ টি মৌজায় প্রবাহিত হয়েছে। পানি প্রবাহের ধরণ বারোমাসি ও সারাবছর নাব্য থাকে। নদীতে জোয়ার-ভাটা হয়। নদীটি সর্পিল এবং নদীর গতি পরিবর্তন হয়নি। বড় হরিণা, বরকল, শুভলং, বালুখালীসহ রাঙামাটির বিভিন্ন ইউনিয়নে জোয়ার-ভাটা হয়। নদীর গতি পরিবহন হয়নি। নদীর নৌপথ ব্যবহৃত হয়। যাত্রীবাহী, তেলবাহী, বালুবাহী জলযান চলাচল করে।
অবৈধ বালু উত্তোলন :
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চপর্যায়ের এক প্রকৌশলী বলেন, কর্ণফুলী থেকে অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদীর তীরে ভাঙন ধরেছে। এতে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও নানা স্থাপনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী মহল-সরকারিদলের নেতারা বোয়ালখালী ও রাঙ্গুনীয়া অংশ থেকে প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করছে। ক্ষমতার দাপটের কাছে যেন প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড অনেকটা অসহায়। নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনেও অবৈধ বালু উত্তোলন ও নদী ভাঙন চিত্র উঠে এসেছে। স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী মহলের জড়িত থাকার কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সুপারিশ :
পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরিভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলে আপদকালীন ভাঙনরোধ ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে সিসি ব্লক দিয়ে স্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজ করতে হবে। অধিক ভাঙন এলাকায় প্রতিরক্ষা ও ড্রেজিং করার পরামর্শ দিয়েছে সমীক্ষাদল। এজন্য হাইড্রো মরফোলজিক্যাল ও পরিবেশগত সমীক্ষাতে বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এছাড়াও সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নদীর তীর থেকে দূরে প্রতিস্থাপন করে খাল-বিলের সাথে সংযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। নদীর প্লাবনভূমি চিহ্নিত, দখলমুক্ত ও সংরক্ষরণ করে বন্যার পানি পরিবহন ও ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। নদীতে অপরিসর সেতু, কালভার্টসহ অপরিকল্পিত অবকাঠামো অপসারণ করতে হবে।
পূর্বকোণ/মাহমুদ