চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

এবারও মেলেনি চামড়ার ন্যায্য দাম

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

৩ জুলাই, ২০২৩ | ১১:২১ পূর্বাহ্ণ

গরিব-মিসকিনের হক নষ্ট হচ্ছে কোরবানির পশু চামড়ায়। মৌসুমী বেপারিরা এখন আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়ার জন্য হাঁকডাক দেন না। গরিব-মিসকিনরাও চামড়ার টাকার জন্য কোরবানিদাতাদের দুয়ারে দুয়ারে আসেন না। ক্রেতার অভাবে কোরবানিদাতারা চামড়া দান করে দিচ্ছেন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায়। আর যা বিক্রি হয়েছে তাও পানির দরে। তবে গত দুই বছর ধরে চামড়ায় নৈরাজ্য কমলেও মিলছে না ন্যায্যদাম।

 

আড়তদাররা জানান, চলতি বছর কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছে প্রায় তিন লাখ ১৯ হাজার। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৫ হাজার কম। শুধু কোরবানির পশুর চামড়া কম সংগ্রহ হয়েছে তা নয়, কোরবানিদাতার সংখ্যাও গত বছরের তুলনায় কমেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় কোরবানির সংখ্যা কমেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

 

চামড়া সংগ্রহ:

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম মনিটরিং টিমের প্রধান ও চা বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও বাণিজ্য) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী জানান, চলতি বছর চট্টগ্রামে তিন লাখ ১৮ হাজার ৮০০ পিস চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এরমধ্যে গরুর চামড়া দুই লাখ ৫৮ হাজার ৫০০ পিস। মহিষের চামড়া ৬ হাজার ৫শ এবং ছাগল- ভেড়ার চামড়া ৫৩ হাজার ৮০০ পিস। তিনি বলেন, সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল।

 

গত বছর (২০২২ সাল) চট্টগ্রামে চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল তিন লাখ ৪৩ হাজার ২৫০ পিস। এরমধ্যে গরুর চামড়া তিন লাখ ১৬ হাজার ৪৫০ ও ছাগলের চামড়া ২৮ হাজার ৮০০ পিস।

 

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি ছিল আড়তদারদের। গরু, ছাগল ও মহিষ মিলে তিন লাখ ১৯ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছেন আড়তদার, ব্যবসায়ীরা।

 

তিনি বলেন, কোরবানির পশুর বাড়তি দাম ও মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকায় কোরবানির সংখ্যা কমেছে। তাই চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।

 

পশু লক্ষ্যমাত্রা ও কোরবানি:

জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস কোরবানির পশুর লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে আট লাখ ৭৯ হাজার ৭১৩টি। কিন্তু কোরবানি হয়েছে ৮ লাখ ১৭ হাজার ১২৯টি। যা গত বছরের তুলনায় ২৪ হাজার ৪৫০টি কম। এরমধ্যে গরু ও মহিষ রয়েছে ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৭টি। ছাগল ও ভেড়া দুই লাখ ৮২ হাজার ৫৭০টি।

 

চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আলমগীর পূর্বকোণকে বলেন, মানুষের অর্থনৈতিক কারণে কোরবানির সংখ্যা কিছুটা কমেছে।

 

কোরবানির পশু ও চামড়া সংগ্রহে বড় ফারাক:

সরকারি সংস্থা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এবার কোরবানির পশু ও চামড়া সংগ্রহ নিয়ে বিশাল তফাৎ রয়েছে। কোরবানির পশুর তুলনায় প্রায় চার লাখ ৯৮ হাজার ৩২৯ পিস চামড়ার হিসাব মিলছে না। তবে ২০১৮ সালে চার থেকে সাড়ে চার লাখ চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে চামড়ার বাজারে বড় ধস নেমেছিল। বিক্রি করতে না পারায় লক্ষাধিক চামড়া রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। সেই থেকে কোরবানির সংখ্যা কমে আসছে।

 

প্রান্তিক চামড়া সংগ্রহকারী ও কোরবানিদাতার সঙ্গে কথা হয় পূর্বকোণের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মৌসুমী ব্যবসায়ী জানান, ক্রেতা না পেয়ে অনেক চামড়া বিক্রি করতে না পেরে পুঁতে ফেলেছেন কোরবানিদাতারা। এছাড়াও মানুষের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে অনেকেই ভাগে (অংশীদারিত্ব) কোরবানি দিয়েছেন। চামড়া পাচারের সংশয়-সন্দেহ থাকলেও এ বিষয়ে কথা বলেননি সংশ্লিষ্টরা।

 

নৈরাজ্য ঠেকাতে গাউসিয়া কমিটি:

২০১৯ সালে চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে বড় ধরনের ধস নেমেছিল। চামড়া বিক্রি করতে না পারায় নগরীর বিভিন্ন স্থানে চামড়া ফেলে দিয়েছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, চামড়া সংগ্রহকারী বিভিন্ন মাদ্রাসা, এতিমখানায় চামড়া বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিতে হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন রাস্তা থেকে দেড় লক্ষাধিক চামড়া কুড়িয়ে নিয়ে ডাম্পিংয়ে ফেলে দেয়।

 

গাউসিয়া কমিটির যুগ্ম মহাসচিব এডভোকেট মুছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার পূর্বকোণকে বলেন, গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা ঘরে ঘরে গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করেছেন। মানুষ সওয়াবের উদ্দেশ্যে ডেকে ডেকে ফ্রিতে এসব চামড়া দান করেছেন। মানুষের দান করা এসব চামড়ার টাকা শরিয়ত অনুমোদিতভাবে আঞ্জুমানের রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট পরিচালিত দেশের ২৫০টি মাদ্রাসা, এতিমখানায় ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গরিব শিক্ষার্থীদের কল্যাণে দান করা হয়। চামড়ার বিপর্যয় ঠেকাতে দুই বছর ধরে এ উদ্যোগ নিয়েছে গাউসিয়া কমিটি।

 

দুই বছর ধরে গাউসিয়া কমিটির সংগ্রহ করা চামড়া কিনেন আড়তদার মোহাম্মদ আলী। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, গাউসিয়া কমিটি জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা মাঠে সংগ্রহ করা ২২ হাজার চামড়া প্রক্রিয়াজাত করেছে। গতবছরও ২৪-২৫ হাজার পিস চামড়া কিনেছেন তিনি। গাউসিয়া কমিটিসহ তার তিন গুদামে প্রায় ৩৫ হাজার চামড়া সংগ্রহ করেছেন বলে জানান তিনি।

 

নেই মৌসুমী বেপারিদের দৌরাত্ম্য:

দেশের চামড়ার চাহিদার ৮০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় কোরবানির পশু থেকে। মৌসুমী ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ করেন। কোরবানির পশুর সংগৃহীত এসব চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের হাত ঘুরে যায় ট্যানারি মালিকদের কাছে। ব্যবসায়ী শামসুল আলম বলেন, চার বছর ধরে লোকসান গুনতে গুনতে ফতুর হয়ে গেছে মৌসুমী বেপারি ও আড়তদাররা।

 

আড়তদার সমিতির সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, ঢাকা ট্যানারি মালিকদের কাছে আড়তদার ও বেপারিদের পাওনা রয়েছে ২০-২২ কোটি টাকা। চেক বা আইনিভিত্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা না থাকায় টাকা পরিশোধ করছেন না। পুঁজি হারিয়ে অনেকেই দেউলিয়া হয়ে গেছে। একই কথা বললেন আড়তদার মোহাম্মদ আলীও। এখনো প্রায় ৮ কোটি টাকা অনাদায়ি রয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়াও গত বছরের বকেয়া রয়েছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। কোরবানির আগে পরিশোধের আশ্বাস দিলেও টাকা মিলেনি।

 

চামড়া বিক্রি এক- দুই শ টাকায়:

প্রান্তিক বেপারি, মৌসুমী ব্যবসায়ী ও আড়তদার জানান, সরকারি ঘোষিত দরে চামড়া বিক্রি হয়নি চট্টগ্রামে। কোরবানিরা এক- দুই শ টাকায় চামড়া বিক্রি করেছেন। মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিন থেকে পাঁচ শ টাকায় চামড়া কিনেছেন আড়তদাররা। তবে আড়তদার সমিতির সভাপতি মুসলিম উদ্দিন দাবি করেন, চামড়াভেদে সর্বোচ্চ ৭-৮শ টাকায় কিনেছেন।

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট