পটিয়া থানা পুলিশ খাদ্য অধিদপ্তরের চাল আটকের পর আতঙ্কে রয়েছেন পরিবহন ঠিকাদাররা। ঠিকাদারদের দাবি, ডিও ব্যবসায়ীরা গুদাম কর্মকর্তা ও ট্রাক চালকদের সঙ্গে যোগসাজশে চাল পাচার করে দিচ্ছেন। তবে খাদ্য অধিদপ্তরের দাবি, চাল মানিকছড়ি খাদ্য গুদামে পৌঁছেছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত ১৭ মে মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে পটিয়ার কচুয়াই ইউনিয়ন পরিষদের সামনে থেকে খাদ্য বিভাগের এক ট্রাক চাল আটক করে পটিয়া থানা টহল পুলিশ। পাহাড়তলী চাল বাজারের ফারুক ট্রেডিংয়ের মালিক ওমর ফারুক নামে এক চাল ব্যবসায়ী থানায় এসে ডিও’র কাগজপত্র দেখানোর পর আটক করা চাল ছেড়ে দেয় পুলিশ।
২০২০ সালের এপ্রিলে পাহাড়তলী বাজার থেকে ২১ বস্তা সরকারি ত্রাণের চাল আটক করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মেসার্স ফারুক ট্রেডার্স থেকে তা উদ্ধার করা হয়েছিল। এছাড়াও ১৫শ খালি বস্তা ও ৯ হাজার চটের বস্তা উদ্ধার করা হয়। সরকারি চালের বস্তা পাল্টিয়ে নুরজাহান ব্যান্ডের বস্তায় ভরে বাজারজাত করার সময় জব্দ করেছিল পুলিশ।
ফারুক ট্রেডার্সের মালিক চাল ব্যবসায়ী ওমর ফারুক গতকাল রাতে পটিয়ায় চাল আটকের বিষয়ে পূর্বকোণকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। কত ওমর ফারুক আছে।’
পুলিশ, খাদ্য বিভাগ ও ঠিকাদার সমিতির নেতারা ডিও ব্যবসার আড়ালে চাল পাচারে ফারুক এবং আলমের নাম বলেছেন। এমন প্রশ্নের জবাবে ওমর ফারুক বলেন, ‘কে কী বলেছে, আমি জানি না। এসব বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারবো না।’
খাদ্য বিভাগ জানায়, হালিশহর কেন্দ্রীয় খাদ্য গুদাম থেকে ঢাকামেট্রো-ট-১৬-৩০৮০, চট্টমেট্রো-ট-০২-০৫৮২ ও চট্টমেট্রো-ট-১১-০৯৮১ এই তিনটি ট্রাক চাল খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি খাদ্য গুদামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু ঢাকামেট্রো-ট-১৬-৩০৮০ নাম্বারের ট্রাকটি সরকারি চালসহ আটক করে পটিয়া থানা পুলিশ।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এসএম কায়ছার আলী গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘মানিকছড়ি খাদ্য গুদামে চাল পৌঁছেছে। এ বিষয়ে আমাদের আর কোনো টেনশন নেই।’ পুলিশ খাদ্য বিভাগের চালবাহী ট্রাক আটকের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আটক করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অবহিত করা হলে আমরা গুদামে তদন্ত করে দেখতাম। আটকের পর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি আমার কাছে রহস্যজনক মনে হচ্ছে।’
ডিও ব্যবসায়ী ফারুক ও আলমের দ্বন্দ্ব রয়েছে উল্লেখ করে খাদ্য কর্মকর্তা এসএম কায়ছার আলী বলেন, ‘তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়ে কেন খাদ্য কর্মকর্তাদের টানা হচ্ছে, বিষয়টি আমার বোধগম্য হচ্ছে না।’
এ বিষয়ে কয়েক দিন কথা হয় খাদ্য অধিদপ্তরের একাধিক পরিবহন ঠিকাদারের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ডিও ব্যবসার আড়ালে প্রতিনিয়ত সরকারি খাদ্য বিভাগের চাল পাচার করা হয় খোলা বাজারে। পাহাড়তলী ও চাক্তাই চাল বাজারের তিনটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাল নিয়ে ছিনিমিনি করে আসছে। মাঝে-মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনার হাতে আটক হলেও অদৃশ্য থাকে কালোবাজারিরা। ট্রাক চালকদের ওপর দায় চাপিয়ে পার পেয়ে যায় চোরাকারবারিরা। এতে ফুলে-ফেঁপে উঠে চোরাকারবারিরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৪-৫ জন ঠিকাদার পূর্বকোণকে বলেন, গুদাম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে চাল পাচার হয়ে আসছে। তারা বলেন, হালিশহর ও দেওয়ানহাট কেন্দ্রীয় খাদ্য থেকে চালবাহী ট্রাক কোন খাদ্যগুদামে যাবে-তা ডিও ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে যায়। গুদাম কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ট্রাকচালকদের লোভের ফাঁদে ফেলে চালবাহী ট্রাক হাওয়া করে দেন ডিও ব্যবসায়ীরা। ক্ষেত্রবিশেষে গুটিকয়েক পরিবহন ঠিকাদারও জড়িত থাকার অভিযোগ করে তারা বলেন, চট্টগ্রাম থেকে একটি ট্রাক বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি বা কক্সবাজার যাওয়ার ভাড়া অন্তত ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু হালিশহর ও দেওয়ানহাট থেকে পাহাড়তলী ও চাক্তাই বাজারে পাচারকালে ট্রাকচালকের অনেক লাভ হয়। সেই লোভের ফাঁদে পড়ে পাচারে জড়িয়ে পড়েন চালকেরাও। তারা দাবি করেন, হালিশহর ও দেওয়ানহাট খাদ্য গুদাম থেকে পাঠানো এবং সংশ্লিষ্ট গুদামের সঙ্গে ইনভয়েস ঠিক রাখা হয়। অর্থাৎ খাতা-কলমে হিসাব ঠিক রেখে চাল পাচার করা।
গত বছরের ২৮ জুন নগরীর চাক্তাই রাজাখালীর মোশাররফ হোসেন রোডে সরকারি খাদ্যবান্ধব চাল পাচারকালে আটক করে পুলিশ। মেসার্স বেলাল ট্রেডিংয়ের মালিক মো. বেলাল উদ্দিনের গুদামে খালাসের সময় পুলিশ তা আটক করেছিল। ট্রাকচালক মো. কামরুল রানা মামলার আসামি হলেও পুলিশ ও খাদ্য বিভাগের তদন্তে রহস্যজনকভাবে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অদৃশ্য থেকে যায় পাচারকারীরা।
ডিও ব্যবসায়ীদের নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন উল্লেখ করে বাংলাদেশ খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার সমিতির সভাপতি সৈয়দ মাহমুদুল হক পূর্বকোণকে বলেন, ‘ঠিকাদাররা চান চাল যথাযথভাবে পৌঁছাতে। কিন্তু ডিও ব্যবসার আড়ালে পাচারকারীদের নিয়ে আতঙ্কে থাকি। এটা রোধ করাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। কারণ চোর থাকে চোরের খেয়ালে, আর গেরস্ত থাকে গেরস্তের খেয়ালে।’ ডিও ব্যবসা বন্ধ বা সংশ্লিষ্ট সংস্থা উদ্যোগ নিলে চাল পাচার রোধ করা যাবে বলে জানান তিনি।
পূর্বকোণ/পিআর