সমুদ্রের গর্জন আর শান্ত-শীতল পরিবেশের আড়ালে গড়ে উঠেছে একটি ভয়ঙ্কর চক্র। যেখানে সারা বছরই আনাগোনা থাকে দেশি-বিদেশি পর্যটকের। তাদের টার্গেট করেই এই চক্রের উত্থান। এটির নেপথ্যে আছেন পুলিশের সাবেক এক কর্মকর্তা। যিনি মাদক কারবারের সাথে জড়িত থাকার দায়ে কারাভোগ শেষে বাহিনী থেকে বরখাস্ত হন। তার নেতৃত্বে কক্সবাজার শহরের কলাতলী আবাসিক হোটেল-মোটেল এলাকায় গড়ে উঠে সক্রিয় এক অপহরণ চক্র। এদের রয়েছে একটি ভয়ঙ্কর টর্চার সেল। ধরে নিয়ে সেখানে আটকে রাখা হয়। মুক্তিপণ দেওয়ার পরও মেলে না মুক্তি। চলে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। ঢাকা থেকে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়ে নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধানে চক্রটির বিষয়ে জানতে পারে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
এই চক্রকে ধরতে শুক্রবার (১৯ মে) রাতভর র্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন শামীমের নেতৃত্বে অভিযান চলে। অভিযানে কক্সবাজার শহরের কলাতলী ও সুগন্ধা এলাকায় দুটি টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখান থেকে পাঁচজনকে উদ্ধার ও তিনজনকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার দু’জনের নাম প্রকাশ করেছে র্যাব। তারা হলেন শাহজাহান কবির ও মঞ্জুর আলম। অপর তিনজনের দু’জন রোহিঙ্গা দম্পতি। আরেকজনের নাম ও কোনো পরিচয় প্রকাশ করেনি র্যাব।
আটকরা হলেন, চক্রের মূলহোতা পুলিশের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইকবাল পারভেজ। তিনি চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলাধীন মাইতুল সরকারবাড়ি এলাকার মৃত এরশাদ আলমের ছেলে। তার সহযোগী অপর দু’জন হলেন, কক্সবাজার পৌরসভার নতুন বাহারছড়া এলাকার মো. ইউনুসের ছেলে এম.টি মুন্না ও একই এলাকার মৃত আবদুল করিমের ছেলে মো. ইউসুফ। এর মধ্যে মুন্না সম্পর্কে ইকবাল পারভেজের শ্যালক।
কক্সবাজার ঘুরতে গিয়ে নিখোঁজ :
ঢাকা থেকে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়ে ১৬ মে নিখোঁজ হন শাহজাহান কবির ও মঞ্জুর আলম। পরে পরিবারের সদস্যদের কাছে একটি নম্বর থেকে ফোন দিয়ে টাকা চাওয়া হয়। ১৫ লাখ টাকা দিলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে, ফোনে জানানো হয়। টাকা পরিশোধ করা হলেও তাদের মুক্তি মেলেনি। ১৯ মে শাহজাহানের বোন আমেনা বেগম কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেন। এটির ছায়াতদন্ত শুরু করে র্যাব। তদন্তে চক্রটির সন্ধান পাওয়া যায়।
শনিবার র্যাব-১৫-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবু সালাম চৌধুরী বলেন, ‘চক্রের প্রধান ইকবাল পারভেজ ২০২১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ইয়াবাসহ র্যাবের হাতে ধরা পড়েন। তখন তিনি পুলিশের চাকরিতে ছিলেন। এ ঘটনায় করা মামলায় কারাভোগ শেষে চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘চাকরি হারিয়ে তার শ্যালক মুন্নাকে সঙ্গে নিয়ে ৭-৮ জনের অপহরণ সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন পারভেজ। তাদের টার্গেট পর্যটকরা। অপহরণের পর টর্চার সেলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়সহ চলে নির্যাতন। নারীদের ওপর চালানো হয় যৌন নির্যাতন। কলাতলী ও সুগন্ধা এলাকায় তাদের দুটি টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া গেছে।’
সেল দুটির ঠিকানা প্রকাশ না করলেও আবাসিক হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস বলে নিশ্চিত করেছে র্যাব।
রোহিঙ্গা দম্পতির ওপর নির্যাতন : র্যাবের উদ্ধার করা রোহিঙ্গা দম্পতির ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। র্যাব কর্মকর্তা আবু সালাম চৌধুরী জানান, তারা কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা। অপহরণের পর দাবিকৃত টাকা মেলেনি। স্বজনরা বিকাশ করে দুই লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন। আরও টাকার জন্য স্বামীকে হাত-মুখ বেঁধে স্ত্রীর ওপর চলে যৌন নির্যাতন। তাদের স্বজনরা র্যাবকে বিষয়টি জানায়।
আবু সালাম জানান, উদ্ধার ও আটক ব্যক্তিদের কক্সবাজার সদর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
গত বছর আগস্ট মাসের শুরুতে কক্সবাজার শহরের হোটেল-মোটেল জোনে কটেজ এলাকায় এমন একটি ‘টর্চার সেলের’ সন্ধান পেয়েছিল ট্যুরিস্ট পুলিশ। সেখানে আটকে রাখা পর্যটকসহ চারজনকে উদ্ধার করে ১১ জনকে আটক করা হয়েছিল।
পূর্বকোণ/এ