চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাতিল মেশিন ‘গছিয়ে’ দিতে ফের তোড়জোড়

ইমাম হোসাইন রাজু

৬ মে, ২০২৩ | ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ

যুক্তরাষ্ট্রের (ইউএসএ) তৈরি বলে দুই বছর আগে যুক্তরাজ্যের (ইউকে) হৃদরোগীর রিং পড়ানোর আধুনিক আইভাস মেশিন চমেকে সরবরাহের চেষ্টা করে একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ফাঁকি ধরা পড়ার পর সেই যাত্রায় আর মেশিনটি গ্রহণ করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দুই বছর পর একই মেশিনটি আবারও সরবরাহ করার জোর চেষ্টা চলছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে, বাক্সবন্দী হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকা মেশিনটি গ্রহণের বিষয়ে সম্প্রতি একটি সভা করেছে নবগঠিত হাসপাতালের সার্ভে কমিটি। যদিও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন সার্ভে কমিটির সভাপতি। অন্যদিকে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ থাকায় সভার আয়োজন করা হলেও সার্ভে কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক।
এর আগে ২০২১ সালের ৫ জুন কান্ট্রি অব অরিজিন ও কান্ট্রি অপ শিপমেন্টের কাগজে গড়মিল পাওয়ায় হৃদরোগীদের রিং পড়ানোর কাজে ব্যবহৃত আধুনিক এ মেশিনটি গ্রহণ করেননি চমেক হাসপাতালের তৎকালীন সার্ভে কমিটি। কার্যাদেশ অনুযায়ী কথা ছিল- যুক্তরাষ্ট্র থেকে তৈরি করা হৃদরোগীদের রিং পড়ানো কাজে ব্যবহৃত ‘ইন্ট্রা-ভাসকুলার আল্ট্রাসাউন্ড সিস্টেম (আইভাস)’ মেশিনটি সরাসরি একই রাষ্ট্র থেকে চমেক হাসপাতালে সরবরাহ করার। কিন্তু মেশিনটি সরবরাহ করা হয় ইউকে থেকে। এছাড়াও মেশিনটির শিপমেন্টও একই রাষ্ট্র থেকে হওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয় নেদারল্যান্ড থেকে।
সার্ভে কমিটি আইভাস মেশিনটি পর্যবেক্ষণ এবং কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে মন্তব্য করেন ‘কার্যাদেশ এ কোম্পানি অর্জিন এবং শিপমেন্ট দুটোই ইউএসএ উল্লেখ করা হলেও মেশিনের গায়ে লাগানো স্টিকার থেকে বারকোড অনুসারে কান্ট্রি অর্জিন হিসেবে ইউকে এবং শিপমেন্ট দলিল অনুসারে শিপমেন্ট নেদারল্যান্ড থেকে হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। যার কারণে সার্বে কমিটি যন্ত্রটি গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন।’
এছাড়াও একই দিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ এন্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিইউ এন্ড টিসি) সহকারী প্রকৌশলী এম এ নাশিদ রহমানও উল্লেখ করেন, ‘ডিএইচএল’র শিপমেন্ট ডকুমেন্ট অনুযায়ী কান্ট্রি অফ অর্জিন এন্ড কান্ট্রি অফ শিপমেন্ট এ গড়মিল রয়েছে।’
এ নিয়ে ২০২১ সালের ৬ জুন চমেক হাসপাতালে ‘যন্ত্র সরবরাহে জালিয়াতি’ শিরোনামে দৈনিক পূর্বকোণকে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এরপর মেশিনটি আর গ্রহণ করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ৮ এপ্রিল ‘লেজার জেনারেশন ইন্ট্রা ভাসকুলার আল্ট্রাসাউন্ড সিস্টেম (আইভাস) মেশিন এবং এফএফআর যন্ত্র’ সরবরাহের জন্য ঢাকার মেসার্স মেডি গ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেডকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। কার্যাদেশের শর্তে উল্লেখ করা হয়, ‘সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতির কান্ট্রি অব অরিজিন ও কান্ট্রি অব শিপমেন্ট অথবা কান্ট্রি অব এসোম্বলিং ও কান্ট্রি অব শিপমেন্ট অবশ্যই এক দেশ থেকে হতে হবে।’ সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি সার্ভে কমিটি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলে তাৎক্ষণিকভাবে নিজ দায়িত্বে ফেরৎ নিতে হবে। এ জন্য অত্র অফিস কোনভাবেই দায়ী থাকবে না। কিন্তু দুই বছর ধরে চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে মেশিনটি বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে।
সূত্র জানায়, দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা মূল্যের মেশিনটি সরবরাহ করতে না পারায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগে দৌড়ঝাঁপ করেন। কার্যাদেশের শর্ত পূরণ ব্যর্থ হলেও মেশিনটি গ্রহণে বিভিন্ন স্থানে তদবিরও করেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। এছাড়াও পুরনো সার্ভে কমিটি মেশিনটি গ্রহণ করতে অপরাগতা প্রকাশ করায় নতুন করে সার্ভে কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও হাসপাতালজুড়ে আলোচনার ঝড় ওঠেছে। নতুন সার্ভে কমিটিতে পুরানো কমিটির কোন সদস্যকেও রাখা হয়নি।
চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ১ এপ্রিল চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে আইভাস মেশিনটি গ্রহণের বিষয়ে সার্ভে কমিটির মতামত প্রয়োজন উল্লেখ করে ১৭ এপ্রিল সভার ডাক দেয়া হয়। সভায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে কাগজ-পত্র সরবরাহ করতেও বলা হয়। তবে এ দিন সভা অনুষ্ঠিত হলেও এ মেশিন গ্রহণের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন সার্ভে কমিটির সভাপতি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. জসিম উদ্দিন। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমরা একটা মিটিং করেছি, তবে আইভাস মেশিন গ্রহণের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়নি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে তাদের কাগজপত্র দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিটির আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া আমাদের কমিটিও নতুন, সবকিছু যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, ‘মেশিনটি গ্রহণের জন্য একবার মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি আসে। তখন আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছে আরেকটি চিঠি প্রেরণ করি, কেননা মেশিনটি গ্রহণ করলে টাকা পরিশোধ কীভাবে করা হবে, তখন বাজেটও ছিল না। সর্বশেষ মন্ত্রণালয় আবার চিঠি পাঠিয়ে বলেছে- কেন মেশিনটি গ্রহণ করা হয়নি। এরপরই বিষয়টি সার্ভে কমিটিকে অবহিত করা হয়। সার্ভে কমিটি এ নিয়ে একবার মিটিংয়ে বসেছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত আমার কাছে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসেনি। এখন সার্ভে কমিটি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, সে ব্যাপারেই পরবর্তী করণীয় নির্ধারিত হবে।’
অন্যদিকে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য জানতে মেডিওগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেড চট্টগ্রাম ব্রাঞ্চের ম্যানেজার মো. কামাল আহমেদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। যদিও মো. কামাল আহমেদ এক চিঠিতে পূর্বকোণকে জানিয়েছিলেন, ‘বোস্টন সাইন্টিফিক বিশ্বব্যাপী কার্ডিওলজির মেশিন ও কনজুমেবর প্রস্তুতের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। আইভাস মেশিন শুধুমাত্র ইউএসএ-তেই উৎপাদন হয়। বাংলাদেশসহ অত্র অঞ্চলে বোস্টন সাইন্টিফিক এর মেশিন নেদারল্যান্ড এ অবস্থিত ওয়্যার হাউস থেকে সরবরাহ করা হয়।’

পূর্বকোণ/এ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট