
পানি সংকটে থমকে আছে সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ের ৩৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকার জনজীবন। এ দুই উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষের এখন বড় সমস্যা কৃষি ও গৃহস্থালির ব্যবহারের পানি। অন্যতম উৎস পাহাড়ি ছড়া ও গভীর নলকূপে পানি না পাওয়ায় এ সমস্যা তৈরি হয়েছে।
শুষ্ক মওসুম এলে এ দুই উপজেলার বিশাল এলাকাজুড়ে শুরু হয় পানির হাহাকার। পানির অভাবে শিল্পাঞ্চলের উৎপাদন যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি চাষ হয় না কৃষি জমিতে। এমন কি গভীর নলকূপে পানি না থাকায় ব্যাঘাত ঘটে গৃহস্থালি কাজকর্মেও। কিন্তু বর্ষা মওসুমে ঠিক উল্টো চিত্র। এ সময় পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকার রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি।
সীতাকু- ও মিরসরাই উপজেলার পূর্বপাশে পাহাড় ও সমতলবেষ্টিত বিশাল এলাকায় প্রায় এক যুগ ধরে পানি সংকটের এ দুর্ভোগ চলে আসছে। সীতাকু- উপজেলার কুমিরা, সোনাইছড়ি ও বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন এবং মিরসরাই উপজেলার মিরসরাই পৌরসভা, সদর ইউনিয়ন, খৈয়াছড়া, দুর্গাপুর, জোরারগঞ্জ, ওয়াহেদপুর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ পাহাড়ি ছড়া ও গভীর নলকূপের পানির উপর নির্ভরশীল। এখানকার মানুষের অন্যতম পেশা কৃষি। বংশ পরম্পরায় কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে মানুষ। কিন্তু শিল্পায়নের গোড়াপত্তনের সাথে সাথে ছেদ পড়ে মানুষের জীবিকায়। এসব শিল্প কারখানায় উৎপাদনের জন্য বসানো হয় অসংখ্য গভীর নলকূপ। প্রতিদিন এসব নলকূপের মাধ্যমে তুলে নেওয়া হচ্ছে পানি। তাতেই সংকটে পড়ে স্থানীয় মানুষ। আন্ডারগ্রাউন্ড পানির স্তর নেমে যাওয়ায় তাদের নলকূপে পানি মেলে না। তাতে ক্ষুব্ধ স্থানীয় লোকজন। এ নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কাছে নালিশ দেন তারা। এ নিয়ে কিছু কিছু শিল্প-মালিকদের সাথে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে প্রায়শঃ বচসাসহ নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বৃষ্টিনির্ভর সীতাকু- ও মিরসরাই উপজেলার প্রায় ৩৬০ বর্গকিলোমিটার পাহাড় ও সমতলবেষ্টিত এলাকার পানির প্রধান উৎস ২৪টি পাহাড়িছড়া ও খাল। বর্ষাকালে এসব ছড়া ও খালে পর্যাপ্ত পরিমাণের পানি থাকলেও শুষ্ক মওসুমে তেমন একটা পানি পাওয়া যায় না। শিল্প কারখানাগুলো ছড়া ও গভীর নলকূপ দিয়ে পানি তুলে নেওয়ার কারণে এ সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠে। তাতে একদিকে চাষাবাদে যেমন ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে, অপরদিকে গৃহস্থালি কাজকর্মেও সমস্যা তৈরি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন চৌধুরী দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘শিল্প জোনের গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর নেমে গেছে। এ কারণে শুষ্ক মওসুমে কোথাও পানি মেলে না। তাতে ব্যাহত হয় চাষাবাদ ও গৃহস্থালি কাজকর্ম।’ মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক জুনু দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘শুষ্ক মওসুমে পানির অভাবে খৈয়াছড়া ইউনিয়নের সম্ভাবনাময় রবিশস্যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তাতে বছরে কমপক্ষে ২৫ কোটি টাকার রবিশস্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষকরা।’
গোভানিয়া ছড়ায় রাবার ড্যাম হলে পূরণ হবে কৃষিসহ মানুষের পানির চাহিদা
মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন, মেয়র, মিরসরাই পৌরসভা
মিরসরাই পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন- বর্ষা মওসুমে মিরসরাই পৌর এলাকা, ৯নং সদর ইউনিয়ন, ১০নং মিঠানালা, ১১নং মগাদিয়া ও ১২নং খৈয়াছড়া ইউনিয়ন পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়। জলাবদ্ধতায় নষ্ট হয় আউশ, আমনসহ নানা শাকসবজির ক্ষেত। এমন কি পানির তোড়ে ভেঙ্গে যায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট। তাতে জনজীবন অনেকটা ¯’বির হয়ে পড়ে। কিš‘ শুষ্ক মওসুমে ঘটে বর্ষা মওসুমের ঠিক উল্টো চিত্র। গোভানিয়া ছড়ায় পাওয়া যায় না পানি। এমন কি গভীর নলকূপেও মেলে না পানি। পানির অভাবে মরে যায় রবি শস্য। সেচের পানি না থাকায় বিশাল এলাকা চাষহীন পড়ে থাকে। মেয়র মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, এ অব¯’ায় গোভানিয়া ছড়ায় রাবার ড্যাম তৈরি করা হলে সৃষ্টি হবে বিশাল লেক। তাতে কৃষিসহ প্রচুর মানুষের সারাবছরের পানির চাহিদা পূরণ হবে।
পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সরকারিভাবে গভীর নলকূপ বসানোর বরাদ্দ হয় না
মোরশেদ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারম্যান, কুমিরা ইউপি
সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন চৌধুরী দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, শিল্প জোনের গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এ কারণে শুষ্ক মওসুমে কোথাও পানি মিলে না। তাতে ব্যাহত হয় চাষাবাদ ও গৃহস্থালির কাজকর্ম। বছরের পর বছর ধরে সীতাকু-ে এ অবস্থা চলে আসছে। এমন কি আমার ইউনিয়নের ত্রিপুরা পাড়ার ৩০০ পরিবার, গাড়োর ৫০ পরিবার এবং রহমতপুর ও মোহাম্মদপুরের ৩০০ পরিবার শুষ্ক মওসুম এলে ব্যাপক পানি সংকটে পড়ে। পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নেমে যাওয়ার কারণে দেশের অন্য জায়গায় এক হাজার ফুট গভীরতার নলকূপ সরকারিভাবে বরাদ্দ থাকলেও সিটি গেট থেকে বাঁশবাড়িয়া পর্যন্ত কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয় না। শুধুমাত্র রিং ডিউব বরাদ্দ দেওয়া হয়। ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলে পানির অভাবে কুমিরাসহ আশপাশের এলাকায় শুষ্ক মওসুমে তেমন একটা সবজি চাষাবাদ করা যায় না। এমন কি চাহিদা অনুযায়ী গৃহস্থালি পানিও মেলে না। এ অবস্থায় পানি সংকট নিরসনে সরকারিভাবে গৃহিত প্রকল্পটি যত দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন হবে ততই উপকৃত হবে জনগণ।
গোভানিয়া-খৈয়া-নাপিতের ছড়া নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করলে বছরে ২৫ কোটি টাকার রবিশস্য হবে
মাহফুজুল হক ঝুনু, চেয়ারম্যান, খৈয়াছাড়া ইউপি
মিরসরাই ১২ নম্বর খৈয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক জুনু দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন- বর্ষা মওসুমে জলাবদ্ধতা বন্ধ এবং শুকনো মওসুমে চাষাবাদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারিভাবে গোভানিয়া ছড়া ও খৈয়াছড়াকে নিয়ে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আলোচ্য দুইটিসহ নাপিতের ছড়াকে নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করলে এলাকার মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। তাতে বছরে কমপক্ষে ২৫ কোটি টাকার রবি শস্য উৎপাদন হবে। বর্ষাকালে জলাবদ্ধতায় ফসলহানিও বন্ধ হবে। প্রকল্পের মাধ্যমে লেক তৈরি হলে পূর্বপাশে সবুজ বনায়ন হবে। একইসাথে বাড়বে আবাসন ব্যবস্থাও। তাতে মিরসরাই ইকোনমিক জোনের লোকজনের আবাসন সমস্যাও কিছুটা লাঘব হবে।
শিল্পকারখানা গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলে নেওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে
মুনীর আহমেদ, চেয়ারম্যান, সোনাইছড়ি ইউপি
সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুনীর আহমেদ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, আমার ইউনিয়নে পানি সংকট প্রকট। গভীর নলকূপ বসিয়ে শিল্পকারখানাগুলো পানি তোলে নেওয়ার কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছে। পানির অভাবে শুকনো মওসুমে চাষাবাদ করা যায় না। ব্যাঘাত ঘটে গৃহস্থালির কামকর্মে। এ অবস্থায় পানি সংকট নিরসনে সরকারের প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন হলে একদিকে এলাকার পানি সংকট নিরসন হবে, অপরদিকে বর্ষা মওসুমে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে মানুষ। শুধু জোরামতল খাল নয়, এলাকার গুরুত্বপূর্ণ বারআউলিয়া, মদনহাট খাল ও আশেপাশে খালগুলো নিয়ে প্রকল্প তৈরি করলে পানি সংকট নিরসন হবে।
পূর্বকোণ/পিআর