চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস

‘১৭-এ’ নম্বর কক্ষ টর্চারসেল?

ইমাম হোসাইন রাজু

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:০৬ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) প্রধান ছাত্রাবাসের তৃতীয় তলার ‘১৭-এ’ নম্বর কক্ষটি কলেজ কর্তৃপক্ষ কাউকে বরাদ্দ না দিলেও দীর্ঘদিন ধরেই সেটি দখলে রেখেছেন চমেক ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়দানকারী রিয়াজুল ইসলাম জয় ও অভিজিৎ দাশ। তারা এই কক্ষটিকে ব্যবহার করছেন ‘টর্চারসেল’ হিসেবে। যেখানে সম্প্রতি শুধু চার সাধারণ শিক্ষার্থীকেই নয়, এর আগেও একাধিক শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠেছে এ দু’জনের বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্গ দিতেন আরও বেশ কয়েকজন।

 

কলেজ প্রশাসনের নাকের ডগায় জোর দখল করে কক্ষ ব্যবহার করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। শুধু তাই নয়, কক্ষের মধ্যে বহিরাগতদের নিয়ে ‘মাদকের’ আসর বসানোর অভিযোগ থাকলেও এসব বিষয়ে কোন কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হতো না বলেও অভিযোগ সাধারণ ছাত্রদের। বরং কেউ এসব নিয়ে মুখ খুললেই কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে নির্যাতন করা হতো বলে অভিযোগ ছাত্রদের। এমন অবস্থায় উদ্বিগ্ন অভিভাবকসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরাও।

 

চমেক সূত্রে জানা গেছে, দেড় বছর আগে আধিপত্যের কারণে ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনার জেরে মাহাদি জে আকিব নামে এক শিক্ষার্থীর মাথার খুলি ফেটে যাওয়ার ঘটনায় ৩২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। যে তালিকায় আছে রিয়াজুল ইসলাম জয় ও অভিজিৎ দাশও। বহিষ্কার হওয়ার পর ছাত্রাবাস থেকে তাদের কক্ষ বাতিল করা হলেও মাস ছয়েক পরপরই রাতের আঁধারে তালা ভেঙে ১৭-এ ও ১৮-বি নম্বর কক্ষটি দখলে নেয় জয় ও অভিজিৎ।

 

অভিযোগ রয়েছে, গত ১৭ জানুয়ারি চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পাশে অবস্থিত ন্যাযমূল্যের ফার্মেসিতে অভিজিৎ দাশের নেতৃত্বে জনি নামে এক দোকান কর্মচারীকে মারধর করে ছাত্রলীগের একাংশ। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর দোকান ম্যানেজার ঝুটন নাথ ও পিন্টু দাশকে তুলে নিয়ে যায় তারা। তাদেরও ছাত্রাবাসের ১৭-এ নম্বর কক্ষে বেঁধে রেখে নির্যাতন করা হয়। চলতি মাসে ছাত্রবাসের আরও দু’জনকে একই কক্ষে নিয়ে মারধরের অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে।

 

ওরা ১৬ জন : ৮ ফেব্রুয়ারি চার শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় ১৬ জন জড়িত ছিল বলে অভিযোগ দায়ের করেছেন নির্যাতনের শিকার দুই শিক্ষার্থী। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ৫৯ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রিয়াজুল ইসলাম জয় ও ৬০ তম ব্যাচের অভিজিৎ দাশ। গতকাল পৃথক দুটি অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার।

 

অভিযোগে বলা হয়, ‘৮ ফেব্রুয়ারি রাত ১টার দিকে প্রথমে সাকিবকে নিচ তলার রুম থেকে ডেকে নিয়ে যায় ৬২ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন সায়েল, ইব্রাহিম সাকিব, মাহিন, সাজু দাশ, সৌরভ দেবনাথ। এরপর তৃতীয় তলায় অবস্থিত ১৭-এ রুমে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে ৫৯ ব্যাচের রিয়াজুল ইসলাম জয়, ৬০ তম ব্যাচের অভিজিৎ দাশ, আকাশ, ৬১ তম ব্যাচের সায়েদুল ইসলাম হৃদয়, মো. হাবিব, ইমতিয়াজ আলম, নিবরাজ, ৬২তম ব্যাচের উল্লেখিতরা ছাড়াও শোয়েব, চমন দাশ, ফাহিমসহ আরও ৪-৫ জন উপস্থিত ছিল। তারপরই শুরু হয় নির্যাতন। তারপরই ডেকে আনা হয় জাহিদ হোসেন ওয়াকিল, আবু রাইয়াত ও মোবাশ্বির হোসেনকে। তাদেরকেও একই কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়।

 

নির্যাতনের বর্ণনায় সাকিব ও ওয়াকিল উল্লেখ করেন, ‘প্লাস্টিকের পাইপ, ক্রিকেট স্ট্যাম্প, কাঠ দিয়ে মাথায় ও পাসহ বিভিন্ন অঙ্গে মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে মুখ বেঁধে মুখে অনর্গল পানি ঢালতে থাকে ইমতিয়াজ আলমসহ অন্যরা। রাতভর মারধর করার পর পরদিন (৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রুমে পাঠানো হয়। তবে এ ঘটনায় কাউকে কিছু বললে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হয়।’

 

বর্বরতম এমন নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন ইসলাম শিমুল বলেন, ‘একসময় দেশের বড় বড় মেডিকেল কলেজগুলো চমেক ছাত্রলীগের কার্যক্রম দেখে ইর্ষান্বিত হতো। তাতে আমাদের গর্ব হতো। আর এখন কিছু ছাত্রলীগ নামধারীর কারণে আমাদের লজ্জা হয়। কক্ষে আটকে রেখে সাধারণ ছাত্রদের সন্ত্রাসী কায়দায় মরধরের মতো এমন ঘটনা ইতিহাসেও ঘটেনি। এ দায় ছাত্রলীগ কোনভাবেই নিবে না। বরং যারা এ ঘটনার সাথে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’

 

অভিযুক্তরা কী বলছেন : অভিযোগের বিষয়ে জানতে রিয়াজুল ইসলাম জয়ের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অভিযোগে নাম আসা শোয়েবের বক্তব্য জানতে ফোন করা হলে তিনি পরিচয় পেয়ে ব্যস্ত আছেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। ঘটনার পর থেকে মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য গ্রহণ করা যায়নি অভিযুক্ত অভিজিৎ দাশেরও। তবে তিনি ঘটনার পর পূর্বকোণকে দেয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘সরকারবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে ক্যাম্পাসে অস্থিরতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিল তারা। বিষয়টি জিজ্ঞাসাবাদ করতেই তাদের ডাকা হয়। তবে তাদের কোন মারধর করা হয়নি।

 

একাডেমিক কাউন্সিল সভা আজ : চার শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে আজ মঙ্গলবার কলেজের সর্বোচ্চ বৈঠক একাডেমিক কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে আলোচনাসহ এমন কার্যক্রম ঠেকাতে করণীয়সহ সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কথা রয়েছে।

 

বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার বলেন, ‘চিকিৎসাধীন দুই ছাত্রের অভিভাবক এসে লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল করেছেন। অভিযোগে পত্র-পত্রিকায় নাম আসা বেশ কয়েকজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার (আজ) একাডেমিক কাউন্সিল সভায় উপস্থাপন করা হবে। সভার সম্মতিক্রমে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট