
সুমন শাহ্
স্ত্রীকে ভালোবেসে তাজমহল গড়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। টেকনাফের জমিদারকন্যা মাথিন আর পুলিশ অফিসার ধীরাজের প্রেমগাঁথা আছে ‘মাথিনের কূপে’। আমাদের চারপাশে এরকম কতশত প্রেমের নিদর্শন। কিন্তু ভালোবেসে মসজিদ কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের শোলকাটা গ্রামেই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ছুরুত বিবি মসজিদ।
সতেরশ শতকের এই মসজিদকে ঘিরে এলাকায় রয়েছে নানা জনশ্রুতি। ১৫৭৫ সালে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে গৌড় রাজ্য ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলে গৌড় রাজ্যের সেনাপতি শেখ মোহাম্মদ আদম গৌড়ী গৌড়রাজ্য ত্যাগ করে দেয়াঙ রাজ্যের অন্তর্গত শোলকাটা গ্রামে সপরিবারে বসতি স্থাপন করেন। এ বংশের একজন জমিদার ছিলেন শেখ আমির মুহাম্মদ চৌধুরী। ১০৫১ মঘী সনের এক ‘একরারনামা’ মূলে জানা যায় আমীর মুহাম্মদ চৌধুরীর ওপর জমিদারির ভার ছিল। ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিনের ‘দেয়াঙ পরগনার ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আরাকান রাজসভার মহাকবি আলাওলের দ্বিতীয় কন্যা ছুরুত বিবির বিয়ে হয় দেয়াঙ পরগনার মুঘল অংশের দেওয়ান পরিবারের এক জমিদার বাড়ির ছেলে দেওয়ান আমির মোহাম্মদ চৌধুরীর সাথে।
মহাকবি আলাওলের দুই কন্যার মধ্যে ছুরুত বিবি ওরফে শুক্কুর বিবি ছিলেন দ্বিতীয় কন্যা। বিয়ের পর আমীর মুহাম্মদ চৌধুরী স্ত্রীর নামেই এ ছুরুত বিবি মসজিদ নির্মাণ করেন। ধারণা করা হচ্ছে মুঘল শাসনামলে (১৭১৩-১৭১৮) এ মসজিদ নির্মিত হয়। প্রাচীনতম এ মসজিদটি ঘিরে স্থানীয়দের মনে রয়েছে নানা কথা। এক সময় এ মসজিদে নামাজ পড়তে আসতেন না কোনো মানুষ। তাদের ধারণা ছিল জিনেরা এ মসজিদে নামাজ পড়ে, তাই ভয়ে কেউ নামাজ পড়তেন না।
১৯৬০ সালে সর্ব প্রথম এ মসজিদে নামাজ পড়েন আনোয়ারা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক মৌলানা ইদ্রিছ আহমদ। এর আগে পুরাতন একটি পাকা মসজিদ থাকলেও কোন লোক নামাজ পড়তে আসতেন না বলে জানিয়েছেন বর্তমান মসজিদ কমিটির সদস্য মো.নাজিম উদ্দিন। তবে মসজিদের মোতাওয়াল্লি ও কমিটির সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কাশেম বলেন, আমার পূর্ব পুরুষেরা ধারাবাহিকভাবে একজন করে এ মসজিদের মোতওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করে আসছে। দলিল পত্রাদি সূত্রে বংশ পরম্পরায় আমি ৫ম মোতাওয়াল্লি।
এ মসজিদে মানত করলে মনের আশা পূরণ হয়, তাই প্রতি শুক্রবার দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন বিভিন্ন ধর্মের হাজারো মানুষ। মসজিদটির স্থাপত্য শৈলীতে রয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম শিল্পধারা। ৩ টি ছোট বড় গম্বুজ আর ৩০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি মিনার। মসজিদের খিলান, আর সু-উচ্চ মিনার বাড়িয়ে দিয়েছে নান্দনিকতা। এখানে এক সাথে প্রায় দেড় হাজার মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে পারে। মসজিদের দক্ষিণ ও পশ্চিমে রয়েছে বিশাল দুটি দিঘি। দক্ষিণের দিঘিটি ছুরুত বিবি দিঘি আর পশ্চিমের দীঘিটি আমীর খাঁ দিঘি নামে পরিচিত।
পূর্বকোণ/এস