চট্টগ্রাম সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

মধ্যযুগের মুসলিম মহিলা কবি রহিমুন্নিসা

শাহানা ইসলাম

৩১ জানুয়ারি, ২০২০ | ৭:৩৫ পূর্বাহ্ণ

চিরায়ত বাংলার ষড়ঋতুর পালা-বদলের খেলায় যেমন করে প্রকৃতির অঙ্গের রূপ বদলায় তেমন করে বদল হয় মানব কুলের স্থান-কাল-পাত্র, বদল হয় মানব মনের সূক্ষ্ম রেণু-অনুরেণুর। কোন কোন শিল্পের আলোক ধারায় বয়ে আনে পরিবর্তনের বারতা। মূর্ত হয়ে ওঠে মানব জীবনের চলমান বাঁক। যে যুগে নারীরা ছিল পর্দার অন্তরালে, জীবনের বাঁকে বাঁকে ছিল বঞ্চনা, কুসংস্কারের বেড়াজালে নারী সমাজ ছিল শিকলবন্দিÑসে যুগে নিজের অন্তঃগভীরের দুঃখ-সুখের অনুভূতি প্রকাশ করার লক্ষ্যে হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন মধ্যযুগের প্রথম মুসলিম মহিলা কবি রহিমুন্নিসা। যুগ হতে যুগান্তরে আলোচিত প্রেম কাহিনী নিয়ে রচিত দৌলত উজির বাহরাম খাঁ’র লাইলী মজনু, মহাকবি আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য অনুবাদ করেছিলেন এই প্রতিথযশা মহিলা কবি। কবির বিয়ের আগেই লাইলী ‘মজনু’র অনুলেখন শেষ করেছিলেন। লাইলী মজনু পা-ুলিপি সংযুক্ত আত্মবিবরণীতে কবি বলেছেনÑ
“শুন এবে নিবেদন করি অনুপম
হেরিআ লেখিলাম পৌস্তক মনুরম । ”
একজন নারীর ভিতরকার অনুভূতি কতটুকু সুকুমার ভিত্তিক হলে কুমারী বয়সে বিরল প্রেমকাহিনী ভিত্তিক গ্রন্থের অনুলিখনে প্রবৃত্ত হতে পারে তা কবির লেখনীতে প্রমাণ মেলে। বিয়ের পর কবি তার স্বামীর অনুপ্রেরণাতেই আলাওলের ‘পদ্মাবতী’র পা-ুলিপিটি তৈরী করেছিলেন। পা-ুলিপি শেষে অনুলেখিকা তার চমৎকার একটা আত্মবিবরণী দিয়েছিলেনÑ
“শুন গুণি গণ, হই এক মন,
লেখিকার নিবেদন।
অক্ষর পড়িলে, টুটাপদ হৈলে,
শুদরিঅ সর্বজন ।
পদ এই রাষ্ট, হেন মহা কষ্ট,
পুথি সতী পদ্মাবতী ।
আলাওল মণি, বুদ্ধি বলে গুণী,
বিরচিল এ ভারতী ।
পদের উকতি, বুঝি কি শকতি,
মুই হীন তিরী জাতি ।
স্বামীর আদেশ, মানিয়া বিশেষ,
সাহস করিলু গাথি…”
লেখিকার লঘু ত্রিপদী ছন্দের বর্ণনায় বুঝা যায় তিনি তার স্বামীর প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তার স্বামী ছিলেন সাহিত্যানুরাগী।
চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার মেখল গ্রামে কবির শ্বশুরালয় ছিল। তার স্বামীর নাম ছিল আহমদ আলি চৌধুরী। হাটহাজারীর বিখ্যাত জমিদার জান আলি চৌধুরীর প্রথম পুত্র ছিল আহমদ আলি চৌধুরী। দাদা শ্বশুরের নাম ছিল গোলাম হোচন। বলাবাহুল্য যে, চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার অন্তর্গত মেখল গ্রামের “জান আলী” চৌধুরীর বাড়ি একটি প্রাচীন অভিজাত বংশের বাড়ি। শিক্ষায়-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এই বংশের মর্যাদা সমুন্নত। কবি জমিদার বংশের বউ হয়ে শ্বশুর বাড়ি যাবার পর তার সাহিত্যর কৃপাণকে আরো বেশি শান দিয়েছিলেন তার স্বামীর সহযোগিতায় । শুধু তাই নয় ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তার স্বামী ছিলেন কোমল মনের সুমনাবৃত্তি সম্পন্ন একজন মানুষ। স্বামীর প্রতি প্রশংসা করে বলতে গিয়ে কবি বলেছেনÑ
“মোর প্রতি রস রাজ ।
রসিক সমাজ, ব্রত ধর্ম কাজ,
উপেক্ষা না করে চিত।”
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাই বেগম রোকেয়ার পাশে যেমন ছিলেন তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন, সতীদাহ প্রথা রোধে যেমন এগিয়ে এসেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। বিধবা বিবাহ আইন প্রচলনে ছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর তেমন যুগ হতে যুগান্তরে নারী পুরুষের বিবাদ-বিভাজনের মধ্যে দেবতাতুল্য একশ্রেণীর এই পুুরুষরা সেই হতে আজ অবধি নারীদের দিয়ে গেছেনÑযাচ্ছেন প্রেম-ভালোবাসা আর অধিকার আদায়ের অমিয়তা। কবি রহিমুন্নিসার স্বামী আহমদ আলী চৌধুরীও ছিলেন তেমন একজন সুমনা বৃত্তি সম্পন্ন সুপুরুষ। কবি তার সুখের দাম্পত্য জীবনের শুভ কামনায় লিখেছিলেনÑ
“গুণীদের পদ, করিএ ভকত,
কর মোরে আশীর্বাদ
স্বামীর সঙ্গতি, থাকিতে পিরীতি,
না হৌক যে বিসংবাদ।।
প্রভু করতারে, মুই অভাগীরে
করুনা রহে সতত
আন ভাব মতি, নৌক আন পত,
না করৌক লজ্জাগত।। ”
বাল্যবয়সে কবি তার পিতা আবদুল কাদির শাহ্কে হারিয়েছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মাতা আলিমন্নিচার তত্ত্বাবধানে আবুল হোসেন নামের পটিয়া নিবাসী এক প-িতের কাছ হতে আরবী ফার্সী এবং সাহিত্যে শিক্ষা অর্জন করেন ।
কবি রহিমুন্নিসার পিতৃকুল চট্টগ্রামের ছিলেন না। তার পিতামহ ছিল বিহার প্রদেশের অন্তর্গত মুঙ্গের নিবাসী। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আবিষ্কৃত কবি দৌলত উজির বাহরাম খাঁ বিরচিত লাইলী মজনু কাব্যের পা-ুলিপি শেষে অনুলেখিকা রহিমুন্নিসার যে আত্মপরিচয় প্রকাশ পায় তা থেকে বুঝা যায় যে কবি রহিমুন্নিসার পূর্বপুরুষ ছিলেন কুরাইশ বংশোদ্ভূত। কবি তার আত্মপরিচিতি বর্ণনায় বলেছেনÑ
“পীর হই রহে চট্টগ্রামেতে আসিআ ।।
সেক কোরসের বংশে জনম হইআ ।
বহু সিস্ব করিলেক এথাতে রহিআ ।।
তাহান মুরব্বীগণ দুক্ষিত হইআ ।
মক্কা দেশ হন্তে এথা রহিল আসিয়া ।।
সুকে যদি কথ দিন কাটিলেক কাল ।
দান ধর্ম পুণ্য কর্ম করিল বিসাল।।
জম হন্তে বলবন্ত কারে না দেখিআ।
স্বোর্গ পুরে জাই দেহ রহিলেক গিআ ।।
মুই হত অভাগিনী দেখ বোদ লোক।
বুদ্ধি স্হিত না হইতে পিতা পরলোক।।”
কারবালা যুদ্ধের পর কবি রহিমুন্নিসার আদি পুরুষ বাগদাদ হতে এসে বিহারের মুঙ্গেরে বসতি স্থাপন করেন। পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লার পরাজয়ের পর বাংলার বুক যখন ইংরেজদের করাল চাবুকে জর্জরিত তখন নবাব মীর কাশিম তার রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স্থানান্তর করেন। নবাব মীর কাশিমের সাথে ইংরেজদের পর পর কয়েকটা যুদ্ধ হয়, ঘেরিয়া, কাটোয়া, উদয়নালা, বক্সার। নবাব মীর কাশিম পরাজিত হয়ে পালিয়ে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। নবাবের পরাজয়ের পর ইংরেজদের হাতে যখন মুঙ্গেরবাসী মুসলিমরা অত্যাচারিত হয়েছিল তখন কবি রহিমুন্নিসার বংশধরেরা মুঙ্গের হতে চট্টগ্রামে আগমন করেন। যা কবি পয়ারÑ খর্বছন্দে উল্লেখ করেন-
“নাম গোত্র বিরচিয়া করিমু বর্ণন ।
কর্ণগতে শুন মন দিয়া কবিগণ ।।
জংলী শাহা নাম করি গুণে অনুপাম ।
আহালে কোরেশ বংশে উৎপত্তি তাহান ।।
যখনে ইমাম-সঙ্গে দাসীর নন্দন ।
ধর্ম ছাড়ি সজ্জ হৈল করিবারে রণ ।।
হোচেনের সেনাপতি মিলি কত লোক ।
ঈশ্বর স্মরিয়া মনে জানি কর্ম ভোগ ।।
কত কত বহিত্র যে পূর্ণ সাজ করি ।
বাগদাদে আসিলা ইমাম আজ্ঞা ধরি ।।
তথা হস্তে আর কত মুঙ্গেরে আসিল ।
সে মুলুক নৃপ সঙ্গে বহুযুদ্ধ হৈল ।।
অগ্রগামী হইয়া ইংরাজে যুদ্ধ দিল ।
দৈবদশা ফিরিঙ্গীর বিজয় হইল ।।
মুখ্য মুখ্য সবের বহুল রতœ ধন ।
লুটিয়া করিল খয় যত পাপিগণ ।।
অনেক লাঘবে নিজ জম্মভূমি ছাড়ি ।
চট্টগ্রামে আসিয়া রহিলা বাস করি ।।
পির হই শিষ্য কৈলা কত কত গ্রাম ।
প্রকাশ হইল তান যশ কৃতি নাম ।।”
কবি রহিমুন্নিসার পিতামহ জংলী শাহা ইসলামাবাদ খ্যাত চট্টগ্রামে আগমন করেন। এবং শুলকবহরে বসতি স্থাপন করেন। জঙ্গী শাহ নাম ধারণ করে পীর হিসেবে অসংখ্য লোককে মুরীদ করে দ্বীনের পথে এনে নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করে চট্টগ্রামে বিখ্যাত হন। কবির জন্ম চট্টগ্রামের শুলকবহরে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে। কবির বাল্যকাল কেটেছে শুলকবহরে তার পিত্রালয়ে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আবিষ্কৃত কবি দৌলত উজির বাহরাম খাঁ বিরচিত লায়লী মজনু কাব্যের পা-ুলিপি শেষে অনুলেখিকা রহিমুন্নিসা তার আত্মপরিচিতি এভাবেই তুলে ধরেনÑ
“শুন এবে নিবেদন করি অনুপাম ।
হেরিআ লেখিলুম পৌস্তক মনুরম।।
যদি সে য়ক্ষর ভুল হৈলে কদাচন।
তাকে শুদজ্জিতে মুই করি নিবেদন।।
গুনিনের চরণেতে করি পরিহার।
অপবাদ ক্ষেমিবারে আরতি আমার।।
মুই অতি খিনমতি দুক্ষিত তাপিত।
বংশ গ্রাম কহি কিছু শুনহনি নিচিত।।
ছিরিমতি ক্ষুদ্র অতি রহিমন্নিচা নাম ।
শুলকবহর নামে গ্রাম অনুপাম।।
পীতায়তি শুদ্ধমতি আবদুল কাদের।
ছুপি খান্দানে তাঁই আছিল শুধির…”
কবির পিতা আবদুল কাদির শাহ তার পিতা জংলী শাহের উত্তরসূরী হিসেবে পিতার অধ্যাত্ম-উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করিয়াছিলেন এবং ‘শাহ’ উপাধি ধারণ করে পৈতৃক পীরি-মুরীদী-কার্যে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কবি তার পিতা সম্পর্কে বলেছেনÑ
“ গুণজ্ঞাত শুদ্ধমতি আওল ফকির।
ছুফী খান্দানেতে পীর আছিল সুধীর ।।
করিল বহুল শিষ্য তত্ত্বজ্ঞান দিয়া।
সগৌরবে করে শিষ্য আপন চিনিয়া।। “
“অল্প বয়সে কবি তার পিতাকে হারিয়ে অন্তর্দাহে লিখেছিলেনÑ
পূর্ব জম্মে কৈলু পাপ, সে দোষে ফলিল তাপ,
আশাভ্রষ্ট হৈলুম অনাথ।”
কবির লেখনীতে প্রমাণ মেলে তিনি অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছিলেন। পূর্ব জম্মে’র কথাটি মূলত হিন্দু-প্রভাবজাত। কবি তার ভিতরকার অনুভূতির কথা প্রকাশ করতে গিয়ে জাতধর্ম নির্বিশেষে সম্প্রীতির ভাবধারা তুলে ধরেছিলেন।
বাংলার আদি অধিবাসীদের ভাষা ছিল অস্ট্রিক। আর্যদের আগমনের পর ধীরে ধীরে এই ভাষা হারিয়ে যায়। আর্যদের আদি ভাষার নাম ছিল প্রাচীন বৈদিক ভাষা। পরবর্তীকালে এই ভাষাকে সংস্কার করা হয়। পুরনো ভাষাকে সংস্কার করা হয়েছে বলেই এই ভাষাকে সংস্কৃত ভাষা বলা হয় তবে সাহিত্যের জম্ম চর্যাপদ হতেই বলে ধারণা করা হয়। মধ্যযুগের কবি রহিমুন্নিসার লিখন পদ্ধতিতে প্রাচীন শৈলীলিপির চাপ দেখা যায়। যা তার পা-িত্যের পরিচয় বহন করে। কবির ছিল তিন ভাই, আবদুল গফুর শাহ, আবদুল জব্বার শাহ, আবদুস সাত্তার শাহ। আবদুল গফুর শাহ মারা যাবার পর ভাইয়ের শোকে কবি রচনা করেন ভ্রাতৃবিলাপ। নিজের ভিতরকার অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে কবি লিখেছিলেন,
“মিত্রের প্রাণের প্রাণ, ভ্রাতৃ মোর রূপবান, নাম তার আবদুল গফুর
আঘ্রানের পক্ষ দিন, শুক্রবার শুভ চিন, ভ্রাতৃ মোর গেল স্বর্গপুর ।।
ফেলি মাও ভাই বোন ভ্রাতা মোর সুখ মন,
স্বর্গপুরে গেলা মনোরঙ্গ ।”
সাহিত্য জীবনের কথা বলে, যাপিত-জীবনের ক্লান্তি-ক্লেশ, দুঃখ-বিরহ, সুখ-স্বপ্নের মনোভাব কালির আঁচড়ে ফুটে ওঠে। বিরহ-বেদনা ভরা মন যখন আঁতি-পাঁতি করে খুঁজে সুখের আলো তখন কালি-কলমে, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে অন্তঃদাহের দাগগুলো রূপান্তরিত হয় শিল্পকর্মে। কবি রহিমুন্নিসা ও তেমন তার যাপিত-জীবনের সুখ-দুঃখের অনুভূতির কথা ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর কাব্য গ্রন্থে। কবি রহিমুন্নিসার ছিল দুই মেয়ে এক ছেলে। সায়েমান খাতুন, দোরদানা খাতুন। ছেলে সিদ্দিক আহমদ চৌধুরী। ছেলে সিদ্দিক আহমদ চৌধুরীর ছিল চারপুত্র ও তিন কন্যা। মেয়ে দোরদানা খাতুনের বিয়ে হয় চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়। বিবাহের কিছুদিন পর দোরদানা খাতুন তার স্বামীর হাতে শহীদ হন। কন্যার মৃত্যু শোকে কবি রহিমুন্নিসা রচনা করেন দোরদানা বিলাপ। গাথাটির কোন নাম পাওয়া যায়নি। ডক্টর এনামুল হকের মতে, ইহা কতকগুলি বিলাপের সমষ্টি বলিয়া, ইহাকে “দোরদানা বিলাপ” আখ্যায় অভিহিত করা চলে। কন্যা শোকে কবি লিখেছিলেনÑ
“মোর কন্যা তোর হস্তে শহীদ হইল।।
আপনার তিরী বলি না কৈলা বিচার।
কি উত্তর দিবি যাই গোচরে আল্লার।।
স্বর্গবাসী হুর সব হরষিত হৈয়া ।
কন্যা মোর নিল আসি আগু বাড়াইয়া।।
পিতায়ে কান্দন করে আর্তনাদ ছাড়ি।
কোথা লুকাইল মোর দোরদানা সুন্দরী…”
কবি তার লেখনীর মাধ্যমে তার অন্তরের যে বিলাপ-আকুতি প্রকাশ করেছেন তাতে বুঝা যায় যে, বাল্যকাল হতেই কবিকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হতে হয়েছে। পিতৃস্নেহ হতে অল্পবয়সে বঞ্চিত হলে ও কবির মাতা তার অন্তরে যে দীপশিখা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তার আলো কবি বিকশিত করে গেছেন মধ্যযুগের সাহিত্যের পাতায়Ñ পাতায়।
কবি রহিমুন্নিসা তার আত্ম বিবরণীকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। প্রথম ভাগ ‘লঘু-ত্রিপদীতে’ রচিত। দ্বিতীয় ভাগ ‘খর্বছন্দে’ রচিত। সেকালে অনেকে অনুলিপি করতে গিয়ে ভণিতায় নিজের নাম বসিয়ে দিয়ে নিজেকে কবি হিসেবে পরিচয় দিতেন। কিন্তু রহিমুন্নিসা তা করেননি। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, ‘কবির দু’টি অনুলিপি সংশ্লিষ্ট দীর্ঘ আত্মবিবরণী বেশ কবিত্বপূর্ণ। ছন্দের বৈচিত্র্যে, ভাষা ও ভাবানুভূতির বৈদগ্ধ্যে নিটোল।’ রমণী হ্নদয়ের আশা- আকাক্সক্ষা, বিনয়-ভক্তি, মাধুর্য ও স্নিগ্ধতায় মেদুর।’
বাংলাসাহিত্যের কালবিচারে বাংলাসাহিত্যকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ। মধ্যযুগে সাহিত্যচর্চা পুঁথির মাধ্যমে হত। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ছিল মূলত কাব্য সাহিত্য। যা লেখা হত তালপাতা, ধাতুর পাত, কাঠ, পাথর, তুলট কাগজে। কবি রহিমুন্নিসা তার কাব্য লিখেছিলেন তুলট কাগজে । মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে শাহ মুহম্মদ সগীর, সারিবিদ খান, দৌলত উজির বাহরাম খান যেভাবে বাংলাসাহিত্যে নিজেদের কৃতিত্ব রেখে গেছেনÑকবি রহিমুন্নিসা পর্দার অন্তরালে থেকেও নিজের প্রতিভাকে প্রকাশ করে গেছেন তার আপন যোগ্যতায়। যে যুগে সতীদাহ প্রথায় পুড়েছিল বঙ্গ নারীরা সে যুগে একজন মুসলিম নারী কুসংস্কারের বেড়াজালের ভিতর থেকে নিজ প্রতিভাকে প্রকাশ করার মত যে যোগ্যতা দেখিয়েছিলেন তা বাংলার ইতিহাসে বিরল। কবি রহিমুন্নিসা বাংলা সাহিত্যের যে পথ ধরে হেঁটেছিলেন সে পথের উত্তরসূরীরা পরবর্তী সময়ে বাংলার ইতিহাসে নিজ নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম হতে আরো অনেকে। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে কবির স্বামী আহমদ আলী মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর কবি তার সাহিত্য চর্চার পরিসমাপ্তি ঘটায়। তখন তার বয়স ছিল বায়ান্ন বছর । নাত-নাতনী নিয়ে তিনি ছিলেন তার পুত্রের সংসারে। গবেষক লেখক আবদুল হক চৌধুরী, ডক্টর এনামুল হক, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর বদিউজ্জামানসহ যারা রহিমুন্নিসাকে নিয়ে লিখে গেছেন তাতে বুঝা যায় কবি রহিমুন্নিসা সংসার ধর্মে যেমন একজন সুশীল রমণী ছিলেন তেমনি তিনি ছিলেন, সংস্কৃতিমনা বিদুষী একজন নারী । খোদাভীরু এই কবি তার নিজের হাতে কোরান শরীফ লিখেছিলেন যা তার মা আলিমন্নিচা পাঠ করতেন। তিনি নিজের হাতে লিখেছিলেন কায়দা আমপারা। সংসার জীবনের প্রাত্যহিক কাজ করার পাশাপাশি তিনি যেমন সাহিত্যচর্চা করতেন তেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়তেন। কবির পিতামহ জংলী শাহের মাজার জঙ্গী শাহের মাজার নামে আজো অক্ষয় হয়ে আছে চট্টগ্রামের শুলকবহরে। প্রতিদিন মাজার জিয়ারতের জন্য শুভাগমন করেন পুণ্যার্থীরা। মাজারের সামান্য দক্ষিণ পূর্বে কবির বংশধরগণের বাড়ি অবস্থিত। কবির পিতামহ জংলী শাহের হাতে তৈরি করা তাবিজ তার বংশধরেরা আজো রক্ষাণাবেক্ষণ করে যাচ্ছেন বংশ পরাক্রমানুসারে। মাজারের গিলাফের পাশে রাখা আছে জংলী শাহের ঐতিহ্যবাহী পাগড়ি। যা দেখে বুঝা যায় যে, কবির পিতামহ ছিলেন উচ্চবংশীয় সুফী-সাধক শ্রেণির লোক। জংলী শাহা যে স্থানে বসে ধ্যান করেছিলেন সে স্থান তার বংশধরেরা এখনো অক্ষত রেখেছেন।
মধ্যযুগের এই মহিলা কবির পিতৃকুল যতই প্রতিকূলতার অবসান করুক না কেন বংশ পরিক্রমা অনুসারে এই কবির পিতৃকূল আর শ্বশুরকুল দুই’ই যে উচ্চবংশীয় তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রমাণিত।
আজ বাংলাসাহিত্য আধুনিকতায় পরিপুষ্ট। আজকের বাংলা সাহিত্য আধুনিক ভাবধারায় যতই পুষ্ট হোক না কেন সেই আদি সাহিত্য যেন আজকের আধুনিক সাহিত্যের প্রেরণার উৎস। মধ্যযুগের কবি রহিমুন্নিসা আজকের বাংলার মুসলিম নারীর সাহিত্য রচনার যে শেকড় প্রোথিত করে গেছেন তার পথ ধরে বাংলার মুসলিম নারীরা আজ নিজ নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জুড়ে। বাংলা সাহিত্যের আলোক ধারাকে সমুজ্জ্বলিত করে তোলার লক্ষ্যে কবি রহিমুন্নিসা যে ভূমিকা রেখে গেছেন তা আজম্ম অক্ষয় হয়ে থাকবে বাংলার ইতিহাসে ।
তথ্যপঞ্জি
১ । ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকÑমধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের একমাত্র মুসলিম মহিলা কবি, বাংলা একাডেমি পত্রিকা, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, পৌষ ১৩৬১ বাংলা, পৃষ্ঠা ৫৩ – ৭৯ ।
২ । মনীষা মঞ্জুষা, প্রথম খ-, ১৯৭৫ পৃষ্ঠা ১৫৭ – ১৬১ ।
৩ । ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহÑ কবি শ্রী রহিমন্নিসার আত্মপরিচিতি, বাংলা একাডেমি পত্রিকা, ৫ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, মাঘ, ১৩৬৮ বাংলা, পৃষ্ঠা ১২৬ – ১২৮ ।
৪ । আবদুল হক চৌধুরীÑ চট্টগ্রামের চরিতাভিধান, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৮২। আবদুল হক চৌধুরী রচনাবলি, পৃষ্ঠা-১৪৪-১৬২।
৫ । আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদÑ আবদুল হক চৌধুরী ও তার গবেষণা কর্ম, পৃষ্ঠা-৬৫-৭০।
৬ । মজির উদ্দিনÑ বাংলা সাহিত্য প্রথম মুসলিম মহিলা, পৃষ্ঠা -১১ – ২০ ।
৭ । বাংলা একাডেমি চরিতাভিধাÑ পৃষ্ঠা – ৪৭৮ ।
৮ । সংসদ বাঙালি চরিতাভিধানÑপৃষ্ঠা – ৪৬৪ ।
৯ । ডক্টর সুনীতিভূষণ কানুনগোÑচট্টগ্রাম চরিতাভিধান-পৃষ্ঠা-২৬৪ ।
১০ । মুহম্মদ মজলুম খানÑদ্যা মুসলিম হেরিটেজ অফ বেঙ্গল-পৃষ্ঠা-৭৩-৭৯।
১১ । ডক্টর বদিউজ্জামানÑকবি রহিমন্নিসা, বাংলা একাডেমি পত্রিকা, মাঘ ১৩৮৩, আষাঢ় ১৩৮৪।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট