
রাঙামাটি শহর হচ্ছে দ্বীপের মতো। চারদিকে ছড়া, হ্রদ, নদ-নদী অক্টোপাসের মতো আগলে রেখেছে। পর্যটননগরী রাঙামাটিকে রাঙাতে ১৩৫৫ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছির পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পটি কাটছাঁট করে নেমে এসেছে ৬৮৭ কোটি টাকায়। গতকাল একনেক সভায় অনুমোদন পেয়েছে প্রকল্পটি। প্রকল্পের বড় অংশ ব্যয় হবে কাপ্তাই লেক, কর্ণফুলী ও ইছামতিসহ বিভিন্ন নদ-নদী খননে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী স্বপন কুমার বড়–য়া পূর্বকোণকে বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পর্যটনশিল্পের বিকাশ, কৃষিজপণ্য বাজারজাত সহজ, নৌ-যোগাযোগব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটবে।
গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ২২টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এরমধ্যে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কর্ণফুলী নদী এবং সংযুক্ত নদ-নদীর টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটিও অনুমোদন পায়।
পাউবো সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে প্রকল্পটির ডিপিপি প্রস্তুতি করা হয়। প্রকল্পে রাঙামাটি জেলার কর্ণফুলী নদী, সংযুক্ত নদী-খালের ভাঙনরোধে প্রতিরক্ষা বাঁধ এবং কাচালং ও রাইখিয়ং নদীর ড্রেজিং করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই সময়ে প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩৫৫ কোটি ৩৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। জেলার নানিয়ার চর, বরকল, বাঘাইছড়ি, লংগদু, কাউখালী, কাপ্তাই, রাজস্থলী, রাঙামাটি সদর ও বিলাইছড়ি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ উপকৃত হবে। প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয় ২০২৩ সালের ১ জুন থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পাউবো সূত্র জানায়, রাঙামাটি জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে মেগাপ্রকল্প। তবে দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পটি থমকে ছিল। কয়েক মাস আগে প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখে। শেষপর্যন্ত কাটছাঁট হয়ে ১৩৫৫ কোটি টাকা থেকে নেমে আসে ৬৮৭ কোটি টাকায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী প্রকাশন চাকমা বলেন, ৬৮৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন হয়। প্রকল্পে কাপ্তাই হ্রদ, কর্ণফুলী, ইছামতি নদী ও সংযুক্ত নদ-নদীর প্রতিরক্ষা এবং ড্রেজিং করা হবে। তিনি বলেন, প্রকল্পে ৪০ স্থানে ১৩ দশমিক ৭২ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাঁধ দেওয়া হবে। কাচালং নদীতে ৪৬ দশমিক ৯০ কিলোমিটার খনন করা হবে। এছাড়াও রাইখিয়ং নদীতে ১০ দশমিক ২৫০ কিলোমিটার ও শলক নদীতে ৮ দশমিক ৫৫০ কিলোমিটার খনন করা হবে। নদ-নদী সংলগ্ন বিভিন্ন খালের ২৫ দশমিক ৮৫০ কিলোমিটার পুনর্খনন করা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর রাঙামাটি বিভাগ) তয়ন কুমার ত্রিপুরা পূর্বকোণকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে রাঙামাটিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বড় প্রকল্প নেয়া হয়নি। প্রকল্পটির মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদে ওয়ার্কওয়ে, রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণ করে পর্যটনবান্ধব করা হবে। হ্রদের সৌন্দর্যবর্ধনে লেকের উভয় তীরে প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এতে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের ফলে অবৈধ দখল রোধ করা যাবে।’
১৯৫৬ সালে কাপ্তাই লেকে বাঁধ নির্মাণের পর থেকে আর খনন করা হয়নি। হ্রদটি দেশের সম্পদ। হ্রদ খনন ও প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হলে নৌ-যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও মৎস্য উৎপাদন বাড়বে বলে জানান স্থানীয়রা।
প্রকল্পে যা থাকছে : প্রকল্পে কাপ্তাই লেকের এসপি বাংলো থেকে ডিসি বাংলো, ডিসি বাংলো থেকে পর্যটন ঝুলন্ত ব্রিজ পর্যন্ত লেকের উভয় তীরে প্রায় ১৩ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে। কর্ণফুলী নদীর উভয় তীরে প্রতিরক্ষা বাঁধ, বাঘাইছড়িতে কাচালং নদীর উভয় তীরে প্রতিরক্ষা বাঁধ, লংগদুতে মাইনি নদীর উভয় তীরে, বিলাইছড়িতে রাইখ্যং নদীর উভয় তীরে, কাউখালীতে ইছামতি নদীর উভয় তীরে প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এছাড়াও রাজস্থলী, কাউখালী, কাপ্তাই, রাঙামাটি সদরের কাপ্তাই খাল, মনাই খাল, ইছামতি খাল, বগাছড়া খাল, ঘাগড়া খাল এবং বাঙালহালিয়া খালের প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
ড্রেজিং : শুষ্ক মৌসুমে মাইনি, কাচালং, রাইখ্যং, ইছামতি, শলক নদীর বিভিন্ন অংশ শুকিয়ে যায়। নৌ-চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি হয়। পানি প্রবাহ বাড়াতে কাচালং, রাইখিয়ং, শলক, কর্ণফুলী ও শাখা খাল খনন করা হবে। কাচালং নদীর বাঘাইছড়ি থেকে মাইনি মুখ, রাইখিয়ং নদীর টেংরাছড়ি থেকে বিলাইছড়ি, শলক নদীর বাঘাইছড়ি থেকে মাইনি মুখ এবং কর্ণফুলী সংযুক্ত নদী-খাল, কাপ্তাই লেকের চর অপসারণে ড্রেজিং করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ি অঞ্চলের কয়েকশ কোটি টাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। পাহাড়ি জনপদের আমূল পরিবর্তন এনে দেবে।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, কাপ্তাই হ্রদ কুরে খাচ্ছে অবৈধ দখলদার। হ্রদের পাড় দখল করে গড়ে ওঠেছে শত শত বহুতল ভবন। দখল-দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সৌন্দর্যের রাণী-অপার আধার এ হ্রদটি। ক্ষত-বিক্ষত রাঙামাটি শহরকে সুরক্ষা ও হ্রদকে ঘিরে পর্যটক-কৃষিবান্ধব প্রকল্প নিচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
পূর্বকোণ/ইবনুর