
রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখলেও বিদেশে মৃত্যু হলে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মরদেহ পাঠাতে দায়িত্ব নেয় না সরকার। শেষমেষ ব্যক্তি কিংবা সংগঠনের উদ্যোগে মরদেহ দেশে পাঠায় প্রবাসীরা। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলে আসলেও মরদেহ পাঠাতে সরকারের উদ্যোগ না থাকায় হতাশ প্রবাসীরা বলছেন- ‘রেমিটেন্সে অংশীদার হয় সরকার, কিন্তু দায় নেয় না মরদেহের।
অভিবাসী ও প্রবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে এ বছর ১৮ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ও জাতীয় প্রবাসী দিবস-২০২৫। এবারে দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ‘দক্ষতা নিয়ে যাবো বিদেশে, রেমিট্যান্স দিয়ে গড়বো স্বদেশ’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর পৃথিবীর ১৭৬টি দেশে এ পর্যন্ত বাংলাদেশি প্রবাসী গেছেন প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী গেছেন মধ্যপ্রচ্যের দেশসমূহে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছেন অর্ধ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ সৌদি আরবে, ১৫ লাখ সংযুক্ত আরব আমিরাতে, ৮ লাখ ওমানে, ৫ লাখ কুয়েতে, সাড়ে ৪ লাখ কাতারে এবং প্রায় ৪ লাখ বাহরাইনে। অপরদিকে আমেরিকায় রয়েছেন প্রায় ৮ লাখ প্রবাসী। তাদের কেউ প্রবাসে মারা গেলে মরদেহ দেশে পাঠাতে দায়িত্ব নেয় না সরকার। এ নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ও প্রবাসীদের কাছ থেকে জানা গেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যুবরণের কারণে বছরে প্রায় ৬ হাজার প্রবাসীর মরদেহ দেশে আসে। কিন্তু এসব প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠাতে খরচের দায়িত্ব নেয় না সরকার। প্রবাসে কাজ করা প্রবাসীদের মানবিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং স্বচ্ছল ব্যক্তি নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে দেশে স্বজনদের কাছে মরদেহ পাঠান। এ ক্ষেত্রে তাদের বিমানের ভাড়া গুণতে হয় স্বাভাবিক একজন যাত্রীর তুলনায় দ্বিগুণ। এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ দূতাবাসে বছরের পর বছর ধরে ধর্ণা দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না প্রবাসীরা। তাতে ক্ষোভ ঝড়ছে প্রবাসীদের।
প্রবাসী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, অসহায় কোন প্রবাসী রোগাক্রান্ত হয়ে বিদেশে মারা গেলে মরদেহ দেশে পাঠাতে দায়িত্ব নেয় না সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস। এ অবস্থায় রেমিটেন্স যোদ্ধার মরদেহ পড়ে থাকে বিদেশের হাসপাতালের হিমঘরে। নিরুপায় হয়ে চাঁদা তুলে মরদেহ দেশে পাঠাতে বাধ্য হন প্রবাসী সংগঠন ও প্রবাসীরা। যদিও এক সময় বাংলাদেশ বিমান ফ্রি’তে রেমিটেন্স যোদ্ধার মরদেহ বহন করতো। কিন্তু লোকসানের অজুহাত তুলে ২০১৯ সালের দিকে মরদেহ পরিবহন বন্ধ করে দেয় বিমান সংস্থাটি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের (ইউএই) প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন দুবাই এর প্রথম সহ সভাপতি ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশ বিজনেস এসোসিয়েশন আল আউয়ির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াকুব সুনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘প্রবাসীরা পরিবার-পরিজন ছেড়ে বহু বছর ধরে আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন। সে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণের রেমিটেন্স যায় বাংলাদেশে। কিন্তু প্রবাসীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হলেও প্রবাসে কোন প্রবাসী মারা গেলে তার মরদেহ দেশে পাঠাতে সরকারের কোন বরাদ্দ নেই। তাই চাঁদা তুলে দ্বিগুণ বিমান ভাড়া দিয়ে স্বজনের কাছে মরদেহ পাঠায় প্রবাসীরা। এ কারণে ক্ষোভ বাড়ছে প্রবাসীদের।
প্রবাসীরা জানায়, প্রবাসীরা জীবন যৌবন কাটিয়ে দেন বিদেশে। রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেন। কিন্তু কোন কারণে প্রবাসে মৃত্যু হলে তাদের দায়িত্ব নেন না কেউ। এতে একদিকে দেশে স্বজনরা শোক ছাপিয়ে থাকেন উৎকণ্ঠিত, অপরদিকে প্রবাসীরা নিজের কাজ ফেলে চাঁদা তুলতে মাঠে নেমে পড়েন। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলে আসলেও প্রতিকারে এগিয়ে আসেনি সরকারের কোন মন্ত্রণালয়।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য মতে- প্রবাসে মৃত কর্মীর প্রতি পরিবারকে তিন লাখ টাকা করে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। মরদেহ দেশে আসার পর পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। সেই হিসেবে সরকারি সংস্থাটি ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ হাজার ৯১৮ কর্মীর পরিবারকে ১৯৭ কোটি ৫৩ লাখ ১৯ হাজার ৮৫৮ টাকা, ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৬ হাজার ৫৫ কর্মীর পরিবারকে ১৮০ কোটি ১১ লাখ ৮২ হাজার ৮৯২ টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ হাজার ১৮৯ কর্মীর পরিবারকে ১৮৩ কোটি ৫৩ লাখ ৭৭ হাজার ২৮৮ টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৮৮ কর্মীর পরিবারকে ১২৭ কোটি ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ২৯৭ টাকা, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪ হাজার ৭৭ কর্মীর পরিবারকে ১২০ কোটি ৩৯ লাখ ৭২ হাজার ২৬৩ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মাহেন্দ্র চাকমা পূর্বকোণকে বলেন, ‘পৃথিবীর ১৭৬টি দেশে এ পর্যন্ত বাংলাদেশি প্রবাসী গেছেন এক কোটি ৭০ লাখের বেশি। এর মধ্যে বছরে ৫ থেকে ৬ হাজার প্রবাসীর মরদেহ দেশে আসে। কিন্তু এসব প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠাতে খরচ না দিলেও অন্য খাতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী পরিবারকে এককালীন অনুদান দিচ্ছে সরকার। কোন প্রবাসীর মৃত্যু হলে তার পরিবারকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় দুই মাসের মধ্যে এককালীন তিন লাখ টাকা এবং মরদেহ দেশে আসলে ৩৫ হাজার টাকার চেক বিমান বন্দরে স্বজনের হাতে তুলে দিচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা।’
পূর্বকোণ/ইবনুর