চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫

দিল্লিতে যেভাবে রাতারাতি পাল্টাল ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের দৃশ্যপট

অনলাইন ডেস্ক

১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ১০:১৬ অপরাহ্ণ

ভারতের রাজধানীর বুকে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই এক রাতের মধ্যে বদলে গেল দিল্লি ও ঢাকার সম্পর্কের রূপরেখা।

মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেও যেখানে দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণে ভারতের বর্তমান ও সাবেক কূটনীতিকরা, সেনা কর্মকর্তা বা থিংকট্যাংক ফেলো-রা দু’দেশের ঐতিহাসিক মৈত্রীর উদযাপনে ব্যস্ত ছিলেন, পরদিন (বুধবার) সকালে সেই রাষ্ট্রদূতকেই সাউথ ব্লকে তলব করে একগুচ্ছ প্রতিবাদ জানিয়ে রাখল দিল্লি।

যদিও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘ঢাকায় কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী’ যেভাবে ভারতীয় দূতাবাসকে ঘিরে নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করেছে সেটাই রাষ্ট্রদূতকে তলব করার প্রধান উদ্দেশ্য – তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ যেভাবে প্রকাশ্য ভারত-বিরোধী মন্তব্য করেছেন সেই সব ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানোটাও ছিল এই সমন পাঠানোর আর একটা বড় কারণ।

এর আগে চাণক্যপুরীর বাংলাদেশ হাই কমিশন প্রাঙ্গণে গত রাতের বিজয় দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ মন্তব্য করেছিলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আসলে অত্যন্ত গভীর ও বহুমাত্রিক, অতি সমৃদ্ধ একটি অতীতের পটভূমিতে এর পারস্পরিক নির্ভরশীলতাও অনুধাবন করা প্রয়োজন।

এই সম্পর্ককে তিনি বর্ণনা করেছিলেন ‘অর্গানিক রিলেশনশিপ’ হিসেবে, একাত্তরের যুদ্ধে যে ১৬৬৮জন ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের ভূখন্ডে চরম আত্মত্যাগ করেছিলেন, প্রগাঢ় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছিলেন তাদের কথাও।

সেই অনুষ্ঠানে তখন হাজির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া একাধিক ভারতীয় সেনানী, ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জেনারেল রাকেশ কাপুর, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার বিভাগের প্রধান বি শ্যাম, ভারতের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মণিশংকর আইয়ার, ঢাকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা অন্তত চারজন সাবেক কূটনীতিবিদ, ওআরএফ-ব্রুকিংস-আইডিএসএর মতো বহু থিংকট্যাংকের অজস্র গবেষক ও দিল্লির প্রথম সারির সাংবাদিকরা।

অনুষ্ঠানের ঠিক পর রিয়াজ হামিদুল্লাহ একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে লেখেন, পারস্পরিক আস্থা, মর্যাদা, প্রগতিশীলতা, সুফল ভাগাভাগি আর অভিন্ন মূল্যবোধের ভিত্তিতেই দুদেশের মানুষের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব। ওই পোস্টে তিনি ট্যাগ করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও।

রাত পোহাতেই সেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই সাউথ ব্লকে ডেকে পাঠায় হাই কমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে।

ভারত যে মনে করছে বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিবেশের দ্রুত অবনতি হচ্ছে এবং এই পরিস্থিতিতে তারা উদ্বিগ্ন ও বিচলিত, সেটাও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে জানিয়ে দেওয়া হয়।

বিশেষ করে, ভারতের ভাষায় ‘কোনো কোনো চরমপন্থী গোষ্ঠী’ যে ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসকে নিরাপত্তা হুমকি তৈরির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, সে দিকেও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।

সাউথ ব্লকে ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দিল্লিতে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও মন্তব্য করা হয়নি।

তবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বিবিসি বাংলাকে আভাস দিয়েছেন, গত সপ্তাহান্তে দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে ‘বিবৃতির লড়াই’য়ের পর এই তলব তাদের কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল না।

এর আগে গত রোববার ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মাকে তলব করেছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর। দেশটির ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করে ‘বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উসকানির সুযোগ দেওয়া এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টার অভিযোগে’ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় রাষ্ট্রদূতের কাছে।

বস্তুত গত বছর দেড়েকের মধ্যে বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ও ভারতে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের মধ্যে নানা ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি রাষ্ট্রদূত তলব, পারস্পরিক দোষারোপ ও বিবৃতি জারির অজস্র ঘটনা ঘটেছে – বুধবারের ঘটনাপ্রবাহ তাতে সবশেষ সংযোজন।

দিল্লি কেন তলব করল হাই কমিশনারকে?

বাংলাদেশে ‘জুলাই ঐক্য’ নামে একটি সংগঠনের ডাকে বুধবার বিকেলে ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস অভিমুখে ‘মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাই কমিশন’ নামে একটি বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল দূতাবাসের সামনে গিয়ে ‘প্রতিবাদ সমাবেশ’ করা।

যদিও এদিন স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ বাংলাদেশের পুলিশ ঢাকার উত্তর বাড্ডাতে ব্যারিকেড দিয়ে মাঝপথেই বিক্ষোভকারীদের আটকে দেয়।

তা ছাড়া বিজয় দিবসে (১৬ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নাম প্রায় ১৫ বছর আগে বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী খাতুনের স্মরণে ‘ফেলানী এভিনিউ’ রাখার কথা ঘোষণা করে।

দেশের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান সেই অনুষ্ঠানে বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ সীমান্ত হত্যা বন্ধ চায়। আমাদের বোন ফেলানী কাটাতারে ঝুলন্ত অবস্থায় জীবন দিয়েছিল। ভারতের এই নৃশংসতা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা এই সড়কের নাম করেছি ফেলানী সড়ক।”

এর ক’দিন আগেই ঢাকায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি চালানো বন্দুকধারীরা ভারতে পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারে, সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই ধরনের এক অভিযোগের ভিত্তিতে এনসিপি-র শীর্ষস্থানীয় নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ মন্তব্য করেছিলেন, ভারত যদি বাংলাদেশের শত্রুদের তাদের ভূখন্ডে আশ্রয় দেয় তাহলে বাংলাদেশও ভারত-বিরোধী শক্তিগুলোকে আশ্রয় দিয়ে ‘সেভেন সিস্টার্স’কে (ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল) ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইবে।

উত্তর-পূর্ব ভারত জাতীয় নিরাপত্তার জন্য দিল্লির চোখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল একটি ইস্যু – সেই আঙ্গিকে হাসনাত আবদুল্লাহ-র এই মন্তব্যকে ভারত খুবই ‘প্ররোচনামূলক’ বলে মনে করেছে।

বিশেষ করে ভারত যেহেতু মনে করে, অতীতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বহু সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় পেয়েছে এবং সে দেশের বিগত কিছু কিছু সরকার তাদের প্রশ্রয়ও দিয়েছে – তাই হাসনাত আবদুল্লাহর এই মন্তব্যকে হালকা করে নেওয়ার সুযোগ নেই বলেই দিল্লিতে কর্মকর্তাদের অভিমত।

সাউথ ব্লকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, আজ (১৭ ডিসেম্বর) সকালে দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছিল, তার পেছনে এই সবগুলো কারণই দায়ী।

পরে ভারতের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতেও বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো চরমপন্থী গোষ্ঠী একটি ‘মিথ্যা বয়ান’ (ফলস ন্যারেটিভ) তৈরি করতে চাইছে – ভারত যা সম্পূর্ণ রূপে প্রত্যাখ্যান করে।”

আরও বলা হয়, “এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে সে দেশের অন্তর্বর্তী সরকার এই সব ঘটনার কোনো যথাযথ তদন্তও করেনি, ভারতের সঙ্গেও কোনও অর্থবহ সাক্ষ্যপ্রমাণ শেয়ার করেনি!”

বাংলাদেশে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’র স্বার্থেই ভারত যে সেখানে একটি ‘সুষ্ঠু, অবাধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন’ চায় – দিল্লির এই পুরনো অবস্থানের কথাও রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ্-কে এদিন আরও একবার বলা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে মৈত্রীর আবহে যেভাবে তালভঙ্গ

অথচ ঠিক এর আগের সন্ধ্যাতেই দিল্লি সাক্ষী থেকেছে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর এক অসাধারণ মুহুর্তের, যেখানে একাত্তরের স্মৃতিচারণায় নানা মধুর প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল দু’দেশের বক্তাদের কন্ঠেই।

বাংলাদেশ দূতাবাসের বিজয় দিবস উদযাপনের সেই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল ভারতের ফরেন পলিসির জীবন্ত কিংবদন্তি, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এম কে রাসগোত্রারও।

এম কে রাসগোত্রার বয়স এখন ১০১ পেরিয়ে গেছে, সেই শতবর্ষী লেজেন্ডকে তার দিল্লির বাসভবনে গিয়ে নিজে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ।

এম কে রাসগোত্রা কথাও দিয়েছিলেন আসবেন, এবং ‘৭১-র ১৬ই ডিসেম্বর কীভাবে দিল্লিতে একের পর এক ঘটনাগুলো ঘটছিল সেই স্মৃতি ভাগ করে নেবেন বলেও জানিয়েছিলেন। সে সময় মি রাসগোত্রা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা।

যদিও শেষ মুহুর্তে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় মি রাসগোত্রা গতকালের অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি, তবে রাষ্ট্রদূত তাঁর বদান্যতার কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছেন।

বস্তুত ভারতে অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন, বাংলাদেশে গত বছর দেড়েক ধরে মুক্তিযুদ্ধে ভারত-বাংলাদেশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ার গৌরবময় ইতিহাসকে ম্লান করার একটা সচেতন প্রচেষ্টা চলছে।

সেই আবহে গত সন্ধ্যায় বাংলাদেশ দূতাবাসের বিজয় দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানকে তারা একটি খুব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ হিসেবেই দেখেছেন – এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য খুব ইতিবাচক লক্ষণ বলেই মনে করেছেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত একজন সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার বিবিসিকে বলছিলেন, “ঢাকায় যেখানে অন্তর্বর্তী সরকার পরপর দু’বছর বিজয় দিবসের প্যারেডই বাতিল করে দিল, আমি তো ভাবতেই পারিনি এখানে তাদের হাই কমিশন এতো ধূমধামের সঙ্গে বিজয় দিবস পালন করবে।”

কিন্তু এই মৈত্রীর আবহে তালভঙ্গ হতেও বেশি সময় লাগেনি।

ওই অনুষ্ঠানের কয়েক ঘন্টা পরেই আজ সকালে যখন ভারতে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের পর্দায় লাগাতার দেখানো শুরু হল ‘সাউথ ব্লকে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতকে জরুরি তলব’ – তখনই আবার সবাই অনুধাবন করলেন সম্পর্ক মেরামতের যত যা-ই চেষ্টা হোক, দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে সব কিছু মোটেও ঠিকঠাক চলছে না! সূত্র” বিবিসি বাংলা

পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট