
মো. আলমগীরের জীবন চলছিল ঠিকঠাক। বয়স তখনও খুব বেশি হয়নি। বিদেশে থাকতেন, আয়ও ছিল ভালো। একটু একটু করে গড়ে উঠছিল ভবিষ্যতের সঞ্চয়। স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখার নিরন্তর চেষ্টায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেই চলছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালে হঠাৎ করেই আলমগীরের চোখে দুঃস্বপ্ন নেমে এলো। কিডনির রোগ তাকে দেশে ফিরতে বাধ্য করে। শুরু হয় দীর্ঘ চিকিৎসা, আর সঙ্গে সঙ্গে নিঃশেষ হতে থাকে জীবনের সব সঞ্চয়। টাকা যায়, আশা যায়, আত্মসম্মানও টলে ওঠে। তবু জীবন বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা থেমে থাকে না। ২০১৭ সাল থেকে ডায়ালাইসিস হয়ে ওঠে তার নিত্যসঙ্গী। মাসে আটবার ডায়ালাইসিস, সঙ্গে পাহাড়সম ওষুধের খরচ। একসময় কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। ধার-দেনায় হয়ে পড়েন জর্জরিত। প্রবাসী পরিচয় মুছে গিয়ে আলমগীর সন্তানদের দু’মুঠো ভাত জোগাতে স্ত্রী শামসুন নাহারকে নিয়ে হয়ে পড়েন পথের ভিখারি। যে মানুষটি একদিন পরিবার-স্বজনদের ভরসা ছিলেন, তাকেই নিরুপায় হয়ে মানুষের করুণার দিকে হাত বাড়াতে হয়। ঠিক তখনই, ২০২৩ সালে আলমগীরের জীবনে আলো হয়ে আসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতি। বিনামূল্যে তার ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করে সমিতি।
একই বছরের আরেকটি দৃশ্য–ঋণের ১৬ হাজার টাকা নিয়ে কেমোথেরাপি দিতে চমেক হাসপাতালে এসেছিলেন রাঙ্গুনিয়ার কৃষক ফরিদ আহমদ। হঠাৎ তিনি বুঝতে পারেন-পকেটে টাকা নেই। আসার পথেই চুরি হয়ে গেছে। ৭০ বছর বয়সী জীর্ণ-শীর্ণ শরীরের ফরিদ যখন ছলছল চোখে চিকিৎসা ছাড়াই বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখনই ভালোবাসার হাত বাড়ায় রোগী কল্যাণ সমিতি। ১৪ হাজার ৫০০ টাকায় তাকে কিনে দেওয়া হয় সব ওষুধ। কান্না মুছে হাসিমুখেই বাড়ি ফিরেন ফরিদ।
এভাবেই চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা গরিব-অসহায় ও দুস্থ রোগীদের ভরসা আর নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠে রোগী কল্যাণ সমিতি। ১৯৬২ সালের ১৩ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি আজ রোববার ৬৩ বছর পার করে ৬৪ বছরে পা দিলো। এই দীর্ঘ সময়ে সমিতিটি সেবা দিয়েছে ৪ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৫ জন মানুষকে।
সরকারের সহায়তার পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ের দানে চলে এই সমিতির কার্যক্রম। গত ১৩ বছরের হিসেবেই দেখা যায়Ñএই সময়ে ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৭৮২ জন রোগীকে দেওয়া হয়েছে আর্থিকসহ নানা সহায়তা। আর সেই সেবার পেছনে খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৪৩ হাজার ২৩৫ টাকা। প্রতিদিন গড়ে শতাধিক রোগীর পাশে দাঁড়াচ্ছে এই সমিতি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষার প্রতিবেদন বলছে, একটি পরিবারের মাসিক আয়ের ৯ শতাংশ চলে যায় চিকিৎসা খাতে। কিন্তু দরিদ্র পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে তা বেড়ে দাঁড়ায়-প্রায় ৩৫ শতাংশে। পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটি অসুস্থ হলে বন্ধ হয়ে যায় আয়ের সব পথ। তখন চিকিৎসা তো দূরের কথা, সংসার চালানোই হয়ে ওঠে দুঃসাধ্য। ঠিক সেই অসময়ের বন্ধু হয়ে সহায়তা করে রোগী কল্যাণ সমিতি।
রোগীকে শুধু আর্থিক সহায়তাই নয়, সমিতির উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় চমেক হাসপাতালের নানা বিভাগে উন্নয়ন কার্যক্রম হয়েছে। বহু রোগী পেয়েছেন পুনর্বাসনের সুযোগ। অজ্ঞাতনামা রোগীদেরও আপন করে নিয়েছে এই সমিতি। এমনকি হারিয়ে যাওয়া অনেক রোগীকে চিকিৎসা শেষে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের স্বজনদের কাছে।
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এই সমিতি ও এর সাধারণ সম্পাদক সমাজসেবা অফিসার অভিজিৎ সাহা বহুবার পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও।
জানতে চাইলে অভিজিৎ সাহা পূর্বকোণকে বলেন, ‘সরকারি সহায়তা আর মানুষের দানে আমাদের পথচলা। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ অসহায় রোগী আমাদের সেবা পেয়েছে। ভবিষ্যতেও আমরা মানুষের পাশে থাকতে চাই। রোগী কল্যাণ সমিতিতে দান করলে আয়কর রেয়াতও পাওয়া যায়Ñতাই সবাই এগিয়ে এলে আরও অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব।’
চমেক হাসপাতালের করিডোরে প্রতিদিন হাজারো মানুষের আনাগোনা। কেউ ছোটেন বাঁচার আশায়, কেউ কষ্ট বয়ে নিয়ে। সেই ভিড়ের মাঝেই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে আলো ছড়ানো রোগী কল্যাণ সমিতি। যে প্রতিষ্ঠানটি নিত্য শিখিয়ে চলছে-‘অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই আমাদের কাজ!’
পূর্বকোণ/ইবনুর