চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

বেদখলে কোটি টাকার ‘সরকারি বাড়ি’!

বেদখলে কোটি টাকার ‘সরকারি বাড়ি’!

ইমাম হোসাইন রাজু

২৬ নভেম্বর, ২০২৫ | ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ

নগরের খুলশী থানাধীন জালালাবাদ এলাকায় ‘সরকারি দাবিকৃত’ ৮৯ নম্বর পরিত্যক্ত বাড়িটি বেদখলের পথে। সরকারি সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে বাড়িটি যে কোনো সময় হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

 

গণপূর্ত বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, সরকারি নথি অনুযায়ী ৮৯ নম্বর পরিত্যক্ত বাড়িটি জেলা আবাসন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন গেজেট-বহির্ভূত সংরক্ষিত পরিত্যক্ত বাড়ি। এই বাড়ির মোট আয়তন ৩০ শতক। যা পূর্ব পাহাড়তলী মৌজার আরএস ৯৩/৯৪ দাগ এবং বিএস ১০০ ও ১০১ দাগে অবস্থিত।

 

গণপূর্ত বলছে, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকটি অসাধু চক্র জাল দলিল ও খতিয়ান তৈরির মাধ্যমে মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা দিয়ে ‘সরকারি’ এ বাড়ি বেদখলে রেখেছেন। সর্বশেষ হালিমা খাতুন গং ২০২২ সালে একটি মামলা (নম্বর ৪০৪/২০২২) দায়ের করেন। যা এখনো চলমান।

 

এর মধ্যেই নতুন আরেকটি পক্ষ বাড়িটির জায়গায় ১৫তলা বহুতল ভবন নির্মাণে সিডিএর কাছে নকশা অনুমোদনের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। তবে বিষয়টি গণপূর্ত বিভাগের নজরে এলে চলতি বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সিডিএকে লিখিতভাবে নকশা স্থগিত করার অনুরোধ জানানো হয়। এরই প্রেক্ষিতে ভবনের নকশা অনুমোদন কার্যক্রম স্থগিত করে সিডিএ।

 

বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অথরাইজড অফিসার কাজী কাদের নেওয়াজ বলেন, জায়গাটি নিয়ে মামলা চলমান থাকায় এবং তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নথির কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।

 

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঝাউতলা ওয়্যারলেস মোড় থেকে বিএডিসি সড়ক ধরে এগোতেই ‘সরকারি’ এই বাড়ির অবস্থান। বাড়ির চারদিকে দেয়ালঘেরা; সামনে কয়েকটি দোকান। ভেতরে তাঁবু টাঙিয়ে রাতের বেলায় চলছে খনন ও পুরাতন স্থাপনা ভাঙার প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে নতুন ভবনের ফাউন্ডেশন তৈরির জন্য মাটি কেটে ‘সলিং’ পর্যন্ত করা হয়েছে।

 

স্থানীয়রা জানান, ‘সরকারি’ এই বাড়ির মালিক দাবি করে আদালতে মামলা করা হালিমা খাতুনের ছেলে ডা. তাওহীদ চৌধুরীর কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যে জায়গাটি ‘কিনেছে’ আদিবা হোল্ডিংস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারাই ভবন নির্মাণের জন্য কয়েক মাস ধরে সেখানে খনন ও পুরাতন স্থাপনা ভাঙার কাজ করছিল। খবর পেয়ে একাধিকবার গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ, পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়।

 

অভিযোগ আছে- জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে ‘সরকারি বাড়িটি’ দখলে নেওয়া হয়। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাড়িটি বিক্রির তোড়জোড় শুরু করেন ডা. তাওহীদ চৌধুরী। যা প্রায় দেড় কোটি টাকায় কিনে নেয় ‘আদিবা হোল্ডিংস’।

 

সরকারি বাড়ি’ কীভাবে বিক্রি করলেন- সে বিষয়ে জানতে ডা. তাওহীদ চৌধুরীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদককে সাক্ষাতে কথা বলার অনুরোধ জানান। কিন্তু সাক্ষাতে কথা বলতে গেলে- তিনি এসব বিষয়ে আর কথা বলতে রাজি হননি। উল্টো এ নিউজ করতে কেউ প্ররোচিত করছে কিনা, সে উত্তরের জন্য প্রতিবেদককে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি ।

অন্যদিকে, আদিবা হোল্ডিংসের ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন বলেন, ‘ওই জায়গা ছাড়াও আশপাশে আমাদের আরও জায়গা রয়েছে। নিয়ম অনুসারে আমরা সেখানে ভবন নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু গণপূর্ত বিভাগ জায়গাটি তাদের দাবি করে আমাদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। তারা (গণপূর্ত) যে জায়গাটিকে তাদের দাবি করছে- সেটি এই জায়গা নয়। এ বিষয়ে আমরা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করবো।’

 

ছিল ‘উদাসীনতা ও গাফিলতি’:

বাড়িটি গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ উপ-বিভাগ-৩ এর আওতাধীন। কিন্তু দখল প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চললেও তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে যথাসময়ে জানানো হয়নি। সর্বশেষ বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চললেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

এ নিয়ে গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান জিতু এক চিঠিতে সংশ্লিষ্ট উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পূষন চক্রবর্তীর গাফিলতির বিষয়টি উল্লেখ করেন এবং জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

 

নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান জিতু বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়টি জেনেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিই। এ নিয়ে সরকারের মামলা চলমান রয়েছে। এরপরও একটি চক্র রাতের আঁধারে বহুতল ভবন নির্মাণের তোড়জোড় শুরু করে। বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবহিত করা হয় এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় তাদের কাজ বন্ধ করা হয়।

 

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা বিভাগের গাফিলতি ছিল কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার গাফিলতি ছিল কিনা এ বিষয়ে তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়েছে।

 

জানতে চাইলে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পূষন চক্রবর্তী বলেন, আমার দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই বাড়িটি নিয়ে সমস্যা চলছিল। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও কয়েক দফা গিয়েছেন সেখানে। মামলা চলমান থাকার কারণে এবং দখলে থাকায় জেলা প্রশাসনও জায়গাটি বুঝিয়ে দিতে পারেননি। যখন বহুতল ভবনের খবর পাই, সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তা বন্ধ করি।

 

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বাড়ি রক্ষার দায়িত্ব আমার একার নয়; এটি যৌথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। তাই দায়ভারও এককভাবে আমার ওপর বর্তায় না।

 

সুযোগ নেই দায় এড়ানোর:

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘সরকারি সম্পত্তি’ বেদখল হওয়ার পেছনে সরকারি নজরদারিতে ফাঁকফোকর ছিল, যা সুযোগ হিসেবে নিয়েছে একটি চক্র। এ অবস্থায় দখল বা নির্মাণকাজ চলা সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন।

 

তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে হালিমা খাতুন গংয়ের মামলা চলমান রয়েছে। এ মামলা নিষ্পত্তির আগে কোনোভাবেই স্থাপনা নির্মাণ বা জায়গা হস্তান্তরের সুযোগ নেই। এটি আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। পাশাপাশি শুরু থেকেই এটি সরকারি পরিত্যক্ত বাড়ি হিসেবে গণপূর্তের রক্ষণাবেক্ষণে থাকার কথা। যারা সরকারি পরিত্যক্ত বাড়ি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরও দায়িত্বে অবহেলা বা যোগসাজশ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটি বেদখল হলে তাদেরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট