
চট্টগ্রামের আনোয়ারার একটি গ্রামে অচেনা এক নারীর ঘোরাফেরা নিয়ে সবার ছিল কৌতূহল। ২৪ বছরের মানসিক প্রতিবন্ধী তরুণীটি বলতে পারছিলেন না নিজের পরিচয়। কিছু জানতে চাইলেই ক্লান্ত চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতেন। এর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে ওই নারী একমাস ধরে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন! কিন্তু‘ কেউ গুরুত্ব দেয়নি। গত ১৬ নভেম্বর হুট করে একটি বাড়ির সামনে অসুস্থ’ নারীটি পড়ে গেলে টনক নড়ে সবার। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে ওই নারীকে নেওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে।
অপর ঘটনাটি নগরের আকবর শাহ এলাকার। সেখানকার বিজয়নগরে ১৩ বছরের কিশোরীকে একা পেয়ে ছুরির ভয় দেখিয়ে পাহাড়ের ওপরে নিয়ে ধর্ষণ করেন রায়হান নামের এক যুবক। পরে স্থনীয়রা বিষয়টি জানতে পারলে চোখে-মুখে রক্তাত্ত অবস্থায় ওই কিশোরীকে উদ্ধার করেন। এরপর ওই যুবককে ধরে গণপিটুনি দেওয়া হয়। ঘটনাটি এই বছরের ২৯ জুনের।
শুধু চট্টগ্রামে নয়, এভাবে সারাদেশে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেব অনুযায়ী দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর-এই ১০ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৫০ জন নারী। তাদের মধ্যে খুনের শিকার হয়েছেন ৩৭ জন। দেশের ১০টি পত্রিকা ও বিভিন্ন অনলাইনের তথ্যের ভিত্তিতে এই তালিকা করে সংস্থাটি।
এমন পরিস্থিতিতে আজ মঙ্গলবার দেশজুড়ে পালিত হবে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। একইদিন শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষও। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ পক্ষ পালিত হবে। এ উপলক্ষে ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ হই, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করি’ প্রতিপাদ্যে দেশজুড়ে ১৬ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
ধর্ষণের শিকার ৬৫০, খুন ৩৭: আসক-এর তথ্য অনুযায়ী ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে ৪৮৯ জন একজন দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বাকি ১৬১ জন দলগত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর খুনের শিকার হয়েছেন ৩১ জন নারী। ধর্ষণের চেষ্টার পর খুন করা হয় ৬ জনকে। এছাড়া অপমানে আত্মহত্যা করেছেন ৬ নারী। এসব ধর্ষণের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে ৫৪১টি। তবে ১০১টি ধর্ষণের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে ৬৪ জনের বয়স ছয় বছরের নিচে। এই শিশুদের তিনজন দলগত নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩ জনকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়। ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১২৭টি। তাদের মধ্যে ৮ জন দলগত ধর্ষণ ও ৭ জন ধর্ষণের পর খুনের শিকার হয়। ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৩৩ জন। তাদের মধ্যে ৩১ জন দলগত ধর্ষণের শিকার হয়। ৫ জনকে দিতে হয়েছে প্রাণও। ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণীর মধ্যে ১৪ জন একজন দ্বারা এবং ১৩ জন দলগত ধর্ষণের শিকার হন এবং তাদের মধ্যে দু’জনকে খুন করা হয়। ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণীর মধ্যে ১৬ (দলগত ৭) জন ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর দু’জন খুনের শিকার হন। ৩০ বছরের বেশি বয়সী ২১ জনকেও ধর্ষণ করা হয়। তাদের মধ্যে ৩ জনকে খুন করা হয়। এই নারীদের মধ্যে ৮জন দলগত ধর্ষণ শিকার হন। বয়স উল্লেখ করা হয়নি এমন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৬২ জন। তাদের মধ্যে ৯১ জন দলগত ধর্ষণের শিকার।
এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ১৯৭ জন নারীকে। এর মধ্যে ১৪৩টি ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় মামলা হলেও বাকি ৭৪টি ঘটনায় কোনো আইনগত পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি।
দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে বলে স্বীকার করেছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদও। গতকাল আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে সচিবালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে এই মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘ঘর-কর্মক্ষেত্র-রাস্তা-ডিজিটাল জগৎ সব জায়গাতেই নারী ও কন্যাশিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন। শারীরিক, যৌন, মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।’
তবে দেশের যেকোনো জায়গায় নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানা এবং এ ব্যাপারে সক্রিয় হওয়ার বিষয়ে কুইক রেসপন্স স্ট্র্যাটেজি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা। এখন দেখার বিষয় এই উদ্যোগ নারী ও শিশুকে কতটা-সুরক্ষা দিতে পারে।
পূর্বকোণ/পারভেজ