
এন্টিবায়োটিক হলো ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংসকারী ওষুধ। ১৯২৮ সালে বিজ্ঞানী অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং তার গবেষণাগারে একটি পেনিসিলিয়াম (Penicilium)নামের ফাংগাস (ছাঁচ) দেখতে পান। ফাংগাস এর আশেপাশে থাকা ব্যাক্টেরিয়া মারা যাচ্ছিল। তিনি বুঝতে পারেন ফাংগাসটি এমন একটি রাসায়নিক তৈরি করছে, যা ব্যাক্টেরিয়া মেরে ফেলতে পারে- এটাই ছিল প্রথম এন্টিবায়োটিক পেনিসিলিন।
বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নীরবে এক ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিচ্ছে । সামান্য জ্বর, সর্দি, গলা ব্যথা কিংবা কাশি- এসব ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই; তবুও দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোতে এগুলোর ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এর বড় একটি অংশ আসে প্রাথমিক স্তরে গ্রামীন স্বাস্থ্য সেবায় কর্মরত, স্যাকমো (সহকারী কম্যুনিটি মেডিকেল অফিসার)/ম্যাটস/ ডিএমএফ পাস স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রেসক্রিপশন থেকে। এই সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভুল ধারণা, রোগীর চাপ, প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতা এবং ফার্মেসিতে অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি। এর ফলাফল এখন স্পষ্ট। বাংলাদেশে বহুরকম ব্যাকটেরিয়া সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে, যা চিকিৎসাকে ব্যয়বহুল, জটিল ও কখনও কখনও অকার্যকর করে দিচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা গ্রামপর্যায়ে প্রতিদিন অনেক রোগী দেখেন। তাদের বেশির ভাগেরই অসুখ ভাইরাল, যেখানে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়। কিন্তু অনেক সময়ই স্যাকমো (সহকারী কম্যুনিটি মেডিকেল অফিসার)/ ম্যাটস/ ডিএমএফ কর্মীরা অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করেন, বিশেষ করে ব্রড-স্পেকট্রাম ওষুধ, যা ভবিষ্যতে মারাত্মক রেজিস্ট্যান্স তৈরি করে। পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে দেশের হাজার হাজার ওষুধের দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি। রোগীরা মনে করেন অ্যান্টিবায়োটিক ‘জাদুর ওষুধ’- যা দ্রুত আরাম দেয়। এই ভ্রান্তধারণা নিয়ন্ত্রণ না করলে এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।
বাংলাদেশের স্বল্প সম্পদ ও সীমিত ডাক্তারসংখ্যার বাস্তবতায় গ্রামীণ এলাকায় এই স্যাকমো (সহকারী কম্যুনিটি মেডিকেল অফিসার)/ম্যাটস/ ডিএমএফ অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তারা প্রতিদিন এনডেমিক রোগ, শিশুরোগ, মাতৃসেবা ও জরুরি সেবা দেন। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত বিশেষায়িত একটি ক্ষেত্র, এটি ভুল হলে ভবিষ্যতের চিকিৎসা পুরোপুরি ব্যর্থ হতে পারে। তাই এটি কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়; বরং নীতিমালার ফাঁকফোকর। এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে যদি প্রেসক্রাইবিং ক্ষমতা স্পষ্ট করে সীমাবদ্ধ করা হয়। এই ব্যপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএমডিসিকে কে একযোগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে স্যাকমো (সহকারী কম্যুনিটি মেডিকেল অফিসার)/ম্যাটস/ ডিএমএফরা ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করতে পারবেন না। শুধুমাত্র প্রটোকলভিত্তিক সীমিত তালিকা রাখলে তারা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রথম স্তরের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারবেন। শুধু MBBS/BDS চিকিৎসকদের জন্য আলাদা অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশন প্যাড ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। স্যাকমো (সহকারী কম্যুনিটি মেডিকেল অফিসার)/ম্যাটস/ ডিএমএফদের জন্য কেবল নির্দিষ্ট কয়েকটি এন্টিবায়োটিক প্রটোকল ফর্ম তৈরী করাও জরুরি।
এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের নিয়মিত অডিট ও জবাবদিহিতা থাকা খুবই দরকার। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাসিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার রিপোর্ট প্রকাশ করা যেতে পারে, যেমন- ‘আমাদের টঐঈ: অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ৭০% জেলা গড় ৪০%।’ এতে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। উপজিলা পর্যায়ে কর্মরতদের প্রশিক্ষণ ও ভূমিকার পুনর্গঠনও জরুরি। স্যাকমো (সহকারী কম্যুনিটি মেডিকেল অফিসার)/ম্যাটস/ ডিএমএফ দের জন্য বাধ্যতামূলক, সংক্ষিপ্ত কিন্তু উচ্চ মানের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, বিশেষ করে ভাইরাল বনাম ব্যাকটেরিয়াল রোগের ক্ষেত্রে কখন অ্যান্টিবায়োটিক দরকার নয়, এটা বিস্তারিত জানা জরুরি।
ওয়াল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO )-এর National Action Plan অনুযায়ী চিকিৎসায় প্যারামেডিকস (স্যাকমো (সহকারী কম্যুনিটি মেডিকেল অফিসার)/ম্যাটস/ ডিএমএফ)দের ভূমিকা নতুনভাবে মূল্যায়ন করা দরকার, যারা রোগীকে যৌক্তিক চিকিৎসা বুঝিয়ে বলবেন। বাংলাদেশে ঔষধের দোকান বা ফার্মেসির নিয়ন্ত্রণ জরুরি। যত্রতত্র যে কাউকে ফার্মেসি খোলার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করা দরকার। বাংলাদেশ ঔষধপ্রশাসনকে কে ওভার দি কাউন্টার (OTC) অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ফার্মেসিতে পোস্টার বাধ্যতামূলক, ‘প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক নয়’। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে বুঝাতে হবে যে ‘সব জ্বর বা কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিক লাগে না।’ ‘অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ভবিষ্যতে অকেজো হতে পারে।’ টিভি, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মসজিদের ইমামদের নেতৃত্বে জাতীয় প্রচারণা প্রয়োজন।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স একটি ধীর, অদৃশ্য মহামারি। আজ আমরা যেটিকে সাধারণ সর্দি-কাশির চিকিৎসা ভাবছি, আগামী দিনে সেটি বহু রোগে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। ভুল ব্যবহার, কোর্স শেষ না করা, অতিরিক্ত ব্যবহার ও জেনেটিক পরিবর্তনের কারণে ব্যাক্টেরিয়া রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় বাংলাদেশ। প্রতিবছর ১ সপ্তাহ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স উইক উপলক্ষে র্যালি, ছবি, ওয়েবিনার, ওয়ার্কশপ, ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন করা যেমন জরুরি, তেমনিভাবে সারাবছরও এই ধরনের কার্যকলাপ চালু রাখাও জরুরি।
দেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধির পেছনে মূল চালক ফার্মা কোম্পানির এমআর,ফার্মেসি দোকানদার ও কোয়াক ডাক্তার। দেশে আইন আছে যে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক বিক্রি করা যাবে না, কিন্তু কে মানে এসব আইন আর না মানলেই বা কে দেখে? বাংলাদেশে এমন সব রিজার্ভ এন্টিবায়োটিক দূর দূরান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছনের ঘরের ফার্মেসিতে পাওয়া যায় যা উন্নত দেশের স্পেশালিষ্টরাও প্রেসক্রাইব করতে ১০ বার চিন্তা করে।
সুতরাং এখনই সময়, প্রেসক্রাইবিং নিয়ম ঠিক করা।সারা দেশের ফার্মেসিতে নিয়ন্ত্রণ আনা, স্যাকমো (সহকারী কম্যুনিটি মেডিকেল অফিসার)/ম্যাটস/ ডিএমএফ দের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া,এবং পুরো সমাজকে সচেতন করা। এখনই পদক্ষেপ নেওয়া গেলে বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্তত এই নীরব মহামারির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে। এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত না নিলে ভবিষ্যৎ বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না
ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, সেইন্টজন রেজিওনাল হসপিটাল, নিউব্রান্সউইক, কানাডা।
পূর্বকোণ