চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

চট্টগ্রামের যাত্রাপালা : সেদিন আর আসবে না ফিরে

চট্টগ্রামের যাত্রাপালা : সেদিন আর আসবে না ফিরে

অনুপম চৌধুরী

২২ নভেম্বর, ২০২৫ | ৩:১৩ অপরাহ্ণ

মনে হচ্ছে এইতো সেদিন। স্কুল মাঠের যাত্রাপালা দেখার জন্য সবকাজ ফেলে দিতাম দৌড়। কিন্তু ২ যুগের ব্যবধানে ইতিহাস-ঐতিহ্যে গড়া এই শিল্প এখন মৃতই বলা যায়। অদূর-ভবিষ্যতে এই শিল্প আর কখনও মাথা তুলে দাঁড়াবে বলে মনে হয় না।

 

যাত্রাপালা হল বাংলা লোকসংস্কৃতির এক প্রাচীন ও জনপ্রিয় লোকনাট্য ধারা। যাত্রার ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। একসময় এই উপমহাদেশে বাংলাভাষী মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিনোদনের মাধ্যম ছিল যাত্রা। যা এক প্রতিবেদনে তুলে আনা সম্ভব নয়। প্রাগৈতহাসিক যুগ থেকে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে যাত্রাপালা ছিল খুবই প্রচলিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও যাত্রাপালার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এবং এর আঙ্গিকতায় মুগ্ধ করেছিল। ১৯০২ সালে ‘রঙ্গমঞ্চ’ নামের প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “আমাদের দেশের যাত্রা আমার ভালো লাগে। যাত্রার অভিনয়ে দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে একটা গুরুতর ব্যবধান নাই। পরস্পর বিশ্বাস ও আনুকূল্যের উপর নির্ভর করিয়া কাজটা বেশ সহৃদয়তার সহিত সুসম্পন্ন হইয়া ওঠে। কাব্যরস, সেটা আসল জিনিস, সেটা পুলকিত দর্শক চিত্তের উপর আলোর ফোয়ারার মতো ছড়াইয়া পড়ে।’

 

চট্টগ্রামে যাত্রাশিল্প : শিল্পসংস্কৃতি ও নাট্যচর্চার পাশাপাশি চট্টগ্রামে যাত্রাশিল্পেরও রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য। চল্লিশ দশকে জোয়ারা গ্রামের যাত্রাশিল্পী ছিলেন শ্যামাচরণ। সুচক্রদণ্ডীতে বামাচরণ ও হিমাংশু পাটোয়ারি। এই তিনজন যাত্রাশিল্পী খুবই বিখ্যাত ছিলেন। পরবর্তীতে সুচক্রদণ্ডীতে আরেকজন যাত্রাশিল্পীর আর্বিভাব ঘটে তিনি ভোলা সেন। শ্যামাচরণ-বামাচরণ একটা গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। সেই গ্রুপে শিক্ষানবিশ যাত্রাশিল্পী হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন সাতকানিয়ার তুষার দাসগুপ্ত। পরবর্তীতে যাত্রার খল অভিনেতা হয়েছিলেন কুমিরার অমলেন্দু বিশ্বাস। বোয়ালখালীর শ্রীপুরের পোপাদিয়ার সারদা লালার ছিল যাত্রার দল। কেলিশহরের স্মৃতিশ ভট্টাচার্যের যাত্রাদলের নাম ছিল শ্রীকৃষ্ণ অপেরা। তারও আগে ১৯১৬-১৭ সালে বাংলার গণজাগরণের চারণকবি মুকুন্দ দাস স্বদেশি যাত্রাদল নিয়ে পটিয়া হাই স্কুলের মাঠে ‘পণ’ ও ‘মাতৃপূজা’ যাত্রাপালা করে যান। ১৮২২ সালে কলকাতায় ‘কলিরাজার যাত্রা’ নামে যে পালাটি অনুষ্ঠিত হয়, তার বেশিরভাগ শিল্পী ছিলেন চট্টগ্রামের। ব্রিটিশ যুগে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত যাত্রাদল হলো- পরৈকোড়ার যোগেশ বাবুর দল, সুচক্রদণ্ডীর রামাচরণ ও হিমাংশু পাঠকের দল, হাওলা-পোপাদিয়ার সারদা লালার দল।

 

পাকিস্তান আমলের দু’টি বিখ্যাত যাত্রাদল হলো- ঘাটফরহাদবেগের আমীন শরীফ চৌধুরীর বাবুল অপেরা এবং এনায়েতবাজারের গীতা রুদ্রের গীতশ্রী অপেরা। স্বাধীনতার পরের কয়েকটি জনপ্রিয় যাত্রাদল হলো- এনায়েত বাজারের হরিপদ ঘোষের নবারুণ নাট্য সংস্থা, রেয়াজউদ্দিন বাজারের প্রাণবল্লভ ঘোষের উদয়ন নাট্য সংস্থা এবং ঘাটফরহাদবেগের এমএ চৌধুরীর অগ্রদূত নাট্য সংস্থা। এদেশে প্রথম যাত্রাশিল্প বিষয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামে, ১৩ জুলাই ১৯৭৫ (উদ্যোক্তা-অধুনালুপ্ত বাংলাদেশ পরিষদ, চট্টগ্রাম কেন্দ্র)। মূল প্রবন্ধকার মিলন কান্তি দে। চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান, বাংলাদেশের বিখ্যাত যাত্রানট অমলেন্দু বিশ্বাস (১৯২৫-৮৭) একুশে পদকে ভ‚ষিত হন ১৯৮৯ সালে (মরণোত্তর)। এদেশে প্রথম যাত্রা বিষয়ক লেখক, গবেষক ও সংগঠক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বিশেষ যাত্রা ব্যক্তিত্বের পুরস্কারপ্রাপ্ত মিলন কান্তি দে। যার জন্মস্থান পটিয়া উপজেলা ছনহরা গ্রামে।

 

বাবুল অপেরা : বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প আন্দোলনে এই বাবুল অপেরার কথা না বললে চট্টগ্রামের যাত্রাশিল্পের অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যাবে। তাই আলাদা করে বলতেই হয়। মুসলিম পরিচালিত প্রথম যাত্রাদল হলো ‘মুসলিম যাত্রা পার্র্টি’। ১৯৩০ সালের পটুয়াখালীর মোজাহের আলী সিকদার চালু করেছিলেন ‘মুসলিম যাত্রা পার্র্টি’। মোজাহের আলী সিকদার ১৯৬৬ সালে ‘বাবুল যাত্রাপার্টি’ নামের আরেকটি যাত্রাদল গঠন করেন। এক সময় ‘বাবুল যাত্রাপার্টি’ বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। অনেকে ‘বাবুল যাত্রাপার্টি’ ও ‘বাবুল অপেরা’ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যান, তাই ‘বাবুল অপেরা’ কিছু বিষয় নিচে লিপিবদ্ধ করা হলো।

 

১৯৫৮ সালে গঠিত হয় ‘বাবুল অপেরা’। ‘বাবুল অপেরা’র মালিক ছিলেন চট্টগ্রামের আমিন শরীফ চৌধুরী। ১৯৬০ সাল থেকে এ দলে নারীশিল্পীরা অভিনয় করতে শুরু করেন। ওই সময় পরিচালক ছিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস। নারীশিল্পী জ্যোৎস্না বিশ্বাস ও জয়শ্রী প্রামাণিক ছাড়া এ দলে পুরুষশিল্পী ছিলেন তুষার দাশগুপ্ত, ঠাকুরদাস ঘোষ, কালী দত্ত, ফণীভ‚ষণ, অমিয় সরকার প্রমুখ। এটি মূলত ‘বাবুল থিয়েটারে’র যাত্রা’য় রূপান্তর। বাবুল অপেরায় অন্য উদ্যোক্তারা ছিলেন সাদেকুন নবী, মলয় ঘোষ দস্তিদার, রুনু বিশ্বাস প্রমুখ। প্রখ্যাত নট অমলেন্দু বিশ্বাস ছাড়াও এ দলের শুরুতে শিল্পী হিসেবে ছিলেন সাদেক আলী, নাজির আহমেদ, সাধনা চৌধুরী, মঞ্জুশ্রী মুখার্জী, বেণী চক্রবর্তী, ঊষা দাশ, মকবুল আহমেদ, এমএ হামিদ, জাহানারা বেগম, শান্তি দেবী প্রমুখ। জাহানারা বেগম এ দেশের প্রথম মুসলিম নারীশিল্পী।

 

এ সাহসী নারীশিল্পীদের অন্যতম চট্টগ্রামের মঞ্জুশ্রী মুখার্জীর। চট্টগ্রামের বাবুল থিয়েটারে ১৯৫০ সাল থেকে অভিনয় শুরু করেন। ‘বাবুল থিয়েটার’ ‘বাবুল অপেরা’ নামে রূপান্তর হলে মঞ্জুশ্রী মুখার্জী এ দলের নায়িকা হন। এর আগে কোনো নারী নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেননি। বাবুল অপেরাই প্রথম নারী-পুরুষ সম্মিলিত যাত্রাদল।

 

যাত্রা শিল্পের ধস : ১৯৯১ সালের পর থেকেই এই শিল্পের ধস নামে। যে ধসে আর মুখ তুলে দাঁড়াতে পারেনি এই শিল্প। এক শ্রেণির মুনাফালোভী প্রদর্শক মূল যাত্রাপালার সঙ্গে অশ্লীল নৃত্য, জুয়া ও হাউজির মতো কুরুচিপূর্ণ উপাদান যুক্ত করেছিলেন। ফলে যাত্রাশিল্পের মূল সৌন্দর্য ও সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে। অশ্লীলতা, জুয়া ও মাদকের কারণে স্থানীয় প্রশাসন (জেলা প্রশাসক ও থানা) যাত্রানুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দিতে অনীহা দেখায়। বারংবার অনুমতি নেওয়ার এই প্রশাসনিক জটিলতাও যাত্রাশিল্পের জন্য একটি বড় অন্তরায়।

 

শহর গ্রামে মানুষের হাতে-হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দ্রæত বিচরণ ও সহজ বিনোদন। চার ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রাপালা উপভোগ করার ধৈর্য এবং সময় এখনকার দর্শকের নেই বললেই চলে। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাও যাত্রপালা ধসের অন্যতম কারণ। বড় মাপের যাত্রাপালার জন্য প্রচুর শিল্পী, কলাকুশলী, বাদ্যযন্ত্র এবং বিশাল মঞ্চের প্রয়োজন হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এত বড় আয়োজন করা কঠিন।

 

পূর্ব পাকিস্তানে যাত্রার দল ছিল ২৬টি। স্বাধীনতার পরে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০-এ। ১৯৮৭/৮৮ সালের দিকে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২১০-এ। তখন যাত্রাপালার সুদিন বলা যায়। এবং যাত্রাপালার ব্যবসাও রমরমা। এই যে বিশাল একটা সম্ভবনার যাত্রাশিল্প আজ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করল।

 

এ প্রসঙ্গে নাট্যকার মিলন কান্তি দে বলেন, “যাত্রার দল ফিরে আসার আর সম্ভবনা নেই। রাজনৈতিক অস্থিরতা যেখানে প্রবল সেখানে শুধু যাত্রা কেন সংস্কৃতির কোনো মাধ্যমই আর উঠে আসার সম্ভবনা নেই।”

 

যাত্রা পালার সেকাল-একাল

 

 

মিলন কান্তি দে

 

যুদ্ধে, জাগরণে ও সংগ্রামে বীর চট্টলার যে গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে, তার অংশীদার যাত্রাশিল্পও। ১৮২২ সালে কলকাতায় ‘কলিরাজার যাত্রা’ নামে যে পালাটি অনুষ্ঠিত হয় তাতে বেশিরভাগ শিল্পী ছিলেন চট্টগ্রামের। ১৯১৬-১৭ সালে চারণকবি মুকুন্দ দাশ স্বদেশি যাত্রা নিয়ে এসেছিলেন পটিয়া হাই স্কুল মাঠে। সেই স্বদেশি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যাত্রাদল গঠন করেন পরৈকোড়ার যোগেশ বাবু, সুচক্রদন্ডীর বামাচরণ এবং হাওলা পোপাদিয়ার শারদা লালা। পাশাপাশি শ্যামাচরণ ও হিমাংশু-পাঠক এই দুই অভিনেতার অসাধারণ অভিনয় নৈপুণ্য আজও স্মৃতিময় হয়ে আছে প্রত্যন্ত পল্লীর জনপদে। চট্টগ্রামের যাত্রা কাহিনি অমৃত সমান।

 

১৯৫৮ সালে ঘাটফরহাদবেগ এলাকার ব্যবসায়ী আমিন শরীফ চৌধুরী গড়ে তোলেন একটি ব্যতিক্রমী যাত্রা সংগঠন বাবুল ওপেরা। এদেশে এই দলই প্রথম নারী-পুরুষসহ অভিনয় প্রথা চালু করে, সময়ের প্রেক্ষিতে গণজাগরণমূলক পালা মঞ্চায়ন করে। বাবুল অপেরার দেশ বিখ্যাত সেরা শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস, তুষার দাশগুপ্ত, মঞ্জুশ্রী মুখার্জী, এম এ হামিদ, জ্যোৎস্না বিশ্বাস, জাহানারা বেগম, শবরী দাশগুপ্তা প্রমুখ।

 

চট্টগ্রামের আরও জাঁদরেল যাত্রাশিল্পীদের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন সাদেক আলী, সাদেক-উন-নবী, ভোলা সেন, স্মৃতিশ ভট্টচার্য্য। ১৯৭৩ সালে অমলেন্দু বিশ্বাস যশোরে মাইকেল মধুসূদন যাত্রায় অভিনয় করে দেশীয় সংস্কৃতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি মরণোত্তর একুশে পদকে ভ‚ষিত হন। এত সব কীর্তিগাথায় সমৃদ্ধ চট্টগ্রামের যাত্রা আজ কোথায়, কোন দিকে? এক কথায় উত্তর হচ্ছে অন্ধকারে নিমজ্জিত এই শিল্পটি আজ পুরোপুরি ধ্বংসের কবলে। অন্যান্য জেলাই কদাচিৎ ছিটেফোঁটা যাত্রা অনুষ্ঠান হলেও আমাদের এই অঞ্চলে যাত্রার কনসার্ট বন্ধ হয়ে আছে সেই ১৯৯০ থেকে। মাঝে মধ্যে জেলা শিল্পকলা একাডেমি ফরমায়েশি যাত্রা প্রদর্শনীর অয়োজন করে থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ কখনও বা কালেভদ্রে শিক্ষার্থীদের এক-আধটু যাত্রার ওয়ার্কশপ করে। তবে যাত্রাকে পাঠ্যসূচির আওতায় আনার কোন মন-মানসিকতা নেই।

 

এভাবে তো এই শিল্পের সুদিন আসবে না। সমাজজীবনে যাত্রার উত্তরণ ঘটাতে হলে আমাদের যেতে হবে বিশিষ্ট নাট্য গবেষক, তাত্তি¡ক অধ্যাপক জিয়া হায়দারের কাছে। তিনি বলে গেছেন, ‘যাত্রাই আমাদের জাতীয় নাট্য। যাত্রার জন্য চাই সামাজিক মর্যাদা।’ জিয়া হায়দারের কথার সূত্র ধরে বলতে পারি, এই তথ্য প্রযুক্তির যুগেও কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষ যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ, তখন ঐতিহ্যবাহী যাত্রাই দেখাতে পারে মুক্তির আলো, মুক্তির ঠিকানা।

 

লেখক : যাত্রাশিল্পী, গবেষক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট