চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

মন্তব্য প্রতিবেদন

স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স বিশ্বাসযোগ্য সমাধান নয়

ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, সম্পাদক

২০ নভেম্বর, ২০২৫ | ৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ

গত ২৮ সেপ্টেম্বরের ট্রাম্প-প্রস্তাবিত ‘২০ দফা গাজা পরিকল্পনা’ ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাস হয়েছে। হামাস বলছে, পরিকল্পনাটি গাজায় আন্তর্জাতিক অভিভাবকত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে, যা ফিলিস্তিনি জনগণ ও তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী মানতে নারাজ। তাছাড়া প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে নিরস্ত্র করার প্রস্তাব ও ইসরায়েলের চলমান একগুঁয়েমি অপতৎপরতা- এ প্রস্তাবের বিশ্বাসযোগ্যতাকে নড়বড়ে করে তুলেছে।

 

 

গাজা উপত্যকার জন্য আন্তর্জাতিক স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স (আইএসএফ) এর প্রস্তাব সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছে। মূলত যুদ্ধ-পরবর্তী গাজায় নিরাপত্তা, মানবিক সহায়তা বিতরণ, প্রশাসনিক স্থিতি এবং পুনর্গঠনের প্রাথমিক কাঠামো দাঁড় করাতে বহুজাতিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু ধারণাটি শুনতে যত সুন্দর, বাস্তবে তার রাজনৈতিক জটিলতা ততই গভীর এবং সেই জটিলতার কেন্দ্রেই রয়েছে হামাসের কঠোর বিরোধিতা, ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ইসরায়েলের অব্যাহত সামরিক আগ্রাসন।

 

প্রথমত, আন্তর্জাতিক স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স মূলত একটি ন্যাটো-ধাঁচের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকাই মুখ্য হয়ে উঠবে। এর উদ্দেশ্য ‘হামাস পরবর্তী গাজা’ পরিচালনা, অর্থাৎ নিরাপত্তা ব্যবস্থার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক বাহিনীর হাতে থাকা। হামাস এটিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করছে কারণ তাদের দৃষ্টিতে এটি গাজার উপর একটি নতুন ধরনের দখলদারিত্ব- যাতে শুধু বাহিনীর রঙ পাল্টাবে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের ধরন পাল্টাবে না। ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর যে অংশ এখনো হামাসকে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে দেখে, তাদের কাছে আন্তর্জাতিক বাহিনী মানে আবারও এক বাহ্যিক শক্তির অধীনস্থ হয়ে জীবনযাপন।

 

দ্বিতীয়ত, এই ধরনের বাহিনী তখনই সফল হতে পারে যখন তার কার্যপরিধি স্পষ্ট, পক্ষসমূহের মতৈক্য দৃঢ় এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো- ইসরায়েল এখনো গাজা ও পশ্চিম তীরে নির্বিচারে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে এবং দখলদারিত্বমূলক নীতির কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত নেই। এমন পরিস্থিতিতে একটি ‘ইতিবাচক ম্যান্ডেট’ অর্থাৎ স্থিতিশীলতা, শান্তি প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনিক সমন্বয় কার্যত অসম্ভব। কারণ যে রাষ্ট্রই এই বাহিনীতে থাকবে, তাকে ইসরায়েলের সমান্তরাল শক্তি হিসেবে আচরণ করতে হবে; কিন্তু পশ্চিমা শক্তিগুলোর নীতি বরাবরই ইসরায়েলমুখী। ফলে গাজার জনগণ বিশ্বাস করে না যে এই বাহিনী তাদের সুরক্ষা দেবে, বরং তারা আশঙ্কা করে- এটি গাজার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর হাতে তুলে দেবে।

 

তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাস্তবতা এমন যে, ইসরায়েল যখন গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করছে এবং পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ দ্রুততর করছে, তখন আন্তর্জাতিক বাহিনীর কথা বলা মানে যেন আগুন জ্বলতে থাকা ঘরে রং করার পরিকল্পনা করা। সংঘাত থামানো, দখলদারিত্বের অবসান, যুদ্ধাপরাধের বিচার এই মৌলিক প্রশ্নগুলো অমীমাংসিত রেখে কোনো স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্সই কার্যকর হতে পারে না। হামাসের প্রত্যাখ্যানকে তাই শুধু রাজনৈতিক একগুঁয়েমি হিসেবে দেখা ভুল; বরং এটি ক্ষমতার ভারসাম্য, প্রতিনিধিত্ব এবং জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

 

পরিশেষে বলা যায়, গাজায় স্থায়ী শান্তির জন্য আন্তর্জাতিক বাহিনী নয়, বরং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারই জরুরি। যদি ইসরায়েলের আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব বন্ধ না হয়, যদি ফিলিস্তিনিদের জাতীয় অধিকার নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে কোনো বাহিনীই শান্তি আনতে পারবে না। স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স কাগজে কলমে আকর্ষণীয়; কিন্তু রক্তাক্ত বাস্তবতায় এটি এখনো বিশ্বাসযোগ্য সমাধান নয় বরং একটি অসম্পূর্ণ প্রস্তাব, যেখানে মূল সমস্যাটিই অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

শেয়ার করুন