চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

‘ফুঁ বৈদ্যের ফাঁদ, ফুঁ দিয়ে কোটিপতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

‘ফুঁ বৈদ্যের ফাঁদ, ফুঁ দিয়ে কোটিপতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

আবসার মাহফুজ

১৩ নভেম্বর, ২০২৫ | ৫:০৮ অপরাহ্ণ

তন্ত্র-মন্ত্রের ‘ফুঁ’ দিয়ে কোটিপতি বনে যাওয়া কাপ্তাইয়ের উঃসিরি বৈদ্য এবং চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার ‘ফুঁ বৈদ্য’ শাহনেওয়াজের কাহিনি আজ শুধু দুটি এলাকার প্রতারণার গল্প নয়, এটি আমাদের সমাজের অন্ধবিশ্বাস, অসচেতনতা, কুসংস্কার এবং প্রশাসনিক উদাসীনতারও এক ভয়ঙ্কর চিত্র। বছরকয়েক আগে ভাগ্য-অন্বেষণে মিয়ানমার থেকে কাপ্তাইয়ে আসা উঃসিরি এবং লোহাগাড়ার শাহনেওয়াজ একসময়ের দিনমজুর থেকে কয়েক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি হয়ে ওঠা এই দুই ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে আমাদের সমাজের দুর্বল জায়গাটিকেই নিজের মূলধন বানিয়েছেন। তারা মানুষের অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ভয়, এবং অসহায়ত্বকে পুঁজি করে নানামাত্রিক প্রতারণার মাধ্যমে নিজেদের কুউদ্দেশ্য হাসিল করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এরা দু’জন নয়, সারাদেশে আরো অসংখ্য উঃসিরি এবং শাহনেওয়াজের দোর্দÐপ্রতাপ বিচরণ আছে। তারা সবাই অশিক্ষা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ভয়, দারিদ্য, অসহায়ত্ব এবং প্রশাসনিক নির্লিপ্ততাকে পুঁজি করে নির্বিঘেœ কুউদ্দেশ্য সাধন করে চলেছে। এর মাধ্যমে তারা সহজেই কোটিপতি বনে যাচ্ছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাপ্রার্থীদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়ছে। তারা স্বাস্থ্য এবং অর্থ দু’দিকেই ক্ষতির শিকার হলেও ফুঁ বৈদ্যরা ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ বনে যাচ্ছে। কিন্তু নানাকারণে প্রশাসন তা দেখেও দেখে না। এটি খুবই দুঃখজনক।

 

গত ৪ নভেম্বর ২০২৫, দৈনিক পূর্বকোণে ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘অল্প সময়ে হয়েছেন কোটিপতি : ফুঁ দিয়ে সর্বরোগের চিকিৎসা দেন তিনি!’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া ইউনিয়নের শাহনেওয়াজ বছরসাতেক আগেও মানুষের বাড়িতে কামলা হিসাবে খাটতেন, কখনো ধান কাটা, কখনো গরু চরানো, কখনো বা মাটি কাটার কাজ করতেন। অবসরে ধানখেত কিংবা পাহাড়ে পুঁথি গাইতেন। এখন তিনি কোটিপতি বনে গেছেন ফুঁ চিকিৎসার মাধ্যমে। প্রকৃত নাম আব্দুল গফুর হলেও স্থানীয়ভাবে তিনি এখন শাহনেওয়াজ বৈদ্য নামে পরিচিত। তিনি এক ফুঁ দিয়েই যে কোনো জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা সারেন। সর্বরোগের চিকিৎসা দেন তিনি। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিকিৎসা নিতে আসা সহজ-সরল রোগীদের কাছ থেকে কৌশলে হাতিয়ে নেন হাজার হাজার টাকা, লাখ টাকায়ও চুক্তি করেন এমন অভিযোগও রয়েছে। রোগী জোগাড় করতে কয়েকজন দালালও আছে। বৈদ্যগিরি করে অর্ধকোটি টাকায় করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। রয়েছে গরুর খামার, হাল চাষের ট্রাক্টর, কৃষিজমি, রয়েছে ব্যাংক ব্যালেন্সও। তিনি প্রথমে ফুঁ দেন, পরে রোগ ভেদে চিকিৎসা করেন। সপ্তাহে দুই দিন বৈদ্যের বাড়িতে বসে ‘জিন হাজিরার হাট’। এখানে নাকি মানুষের জীবনের সমস্যা সমাধান হয় ‘অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে’। বাস্তবে এখানেই হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। কেউ দেয় বিশ হাজার, কেউ আবার লক্ষ টাকা পর্যন্ত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে বলেছেন, মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিয়ে কয়েক রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধির আশ্রয়ে শাহনেওয়াজ প্রতিনিয়ত এসব অপকর্ম করে যাচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন এলাকায় দালাল নিয়োগ করে রেখেছেন। তাদের মাধ্যমে সর্বরোগের চিকিৎসার প্রচার চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নিজেরাই শাহনেওয়াজ বৈদ্যের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন বলেও প্রচার করছে এ দালালরা। তাদের কথা শুনে লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও পার্শ্ববর্তী কক্সবাজার, বান্দরবান জেলা থেকেও অনেক সহজ-সরল মানুষ ছুটে আসেন তার কাছে। রোগীদের বেশিরভাগই নারী। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও কষ্টের জায়গাটিকেই মূল পুঁজি বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সুকৌশলে উদ্দেশ্য সাধন করে চলেছেন শাহনেওয়াজ। অথচ প্রশাসন তা দেখেও দেখছে না।

 

তন্ত্র-মন্ত্রের ফুঁ দিয়ে কোটিপতি বনে গেছেন মিয়ানমার থেকে কাপ্তাইয়ের মিতিংগ্যাছড়ি গ্রামে আসা আরেক ফুঁ বৈদ্য উঃসিরি। বানটোনা করে মানুষের সংসারে কলহ দূর, যেকোনো কঠিন রোগের মুক্তি, প্রেমিক-প্রেমিকাকে আপসে আনা, গোপন রোগের চিকিৎসাসহ সব সমস্যার সমাধানের নামে প্রতারণা করে সরলমনা নারী-পুরুষদের কাছ থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়ে কোন ডিগ্রি না থাকলেও বানটোনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের প্রলোভন দেখিয়ে সহজ সরল মানুষদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়াসহ বছরকয়েক ধরে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছেন তিনি। ভুয়া জিন সাধন করে মূলত তিনি এসব করে যাচ্ছেন। তবে তার কাছে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছেন এরকম নজির না থাকলেও, মূলত বিশ্বাসের জোরে কিংবা কিছু দালালের মারফতে প্রচারণায় তার এই ভুয়া চিকিৎসার প্রসার হচ্ছে এবং তারা এটি অব্যাহতভাবে করে চলেছেন। দালালদের মাধ্যমে রোগী ম্যানেজ করেই মূলত তিনি এসব অপচিকিৎসা করে যাচ্ছেন। তিনি প্রতিদিন সরল মনের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মিয়ানমারের নাগরিক উঃসিরি বৈদ্য ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে নারী ও শিশু পাচারকালে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন জেল হাজতে ছিলেন। প্রসঙ্গত, প্রতারণার এসব ঘটনা নতুন নয়। কয়েক বছর আগে কুমিল্লায় এক ‘পীর’ দোয়া পড়ে ক্যানসার সারানোর নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। বরিশালে ‘আল্লাহর হুকুমে ওষুধ’ নামে লবণ-পানি বিক্রি করা হয়েছিল বোতলে বোতলে। এমনকি রাজধানীতেও ‘রুকইয়া সেন্টার’ নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান মানুষকে ‘জিন তাড়ানো’ চিকিৎসা দিত। প্রতিটি ঘটনায় ধর্মীয় আবেগ, অজ্ঞতা এবং রাষ্ট্রীয় নীরবতা একত্রে কাজ করেছে।

 

‘ফুঁ বৈদ্য’দের এসব গল্প আমাদের সমাজেরই আয়না। এসব গল্পে আছে দারিদ্র্য, আছে বিশ্বাসের সরলতা, আছে প্রতারণার এক সূ² ধর্মীয় আবরণ, আর আছে প্রশাসনের এক দীর্ঘ ও লজ্জাজনক নীরবতা। এসব গল্পে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো সমাজের প্রতিক্রিয়া। মানুষ জানে, শাহনেওয়াজ- উঃসিরিরা কোনো ডাক্তার নন, তাদের কোনো চিকিৎসা-প্রশিক্ষণ নেই। তবু তারা ছুটে আসে তাদের কাছে, কারণ এদের বিশ^াস শাহনেওয়াজ- উঃসিরিরা সর্বরোগের মুক্তিদাতা। এমন মানসিকতা শুধু একটি বা দুটি এলাকার সমস্যা নয়, এটি বাংলাদেশের বহু গ্রামীণ-সমাজের গভীরে প্রোথিত এক রোগ, যার নাম অন্ধবিশ্বাস। বাংলাদেশে এখনো এমন হাজার হাজার ‘ফুঁ বৈদ্য’ গ্রামে-গঞ্জে সক্রিয় রয়েছে। কেউ নিজেদের ‘জিন হাজিরা’র কারিগর বলে দাবি করে, কেউ ‘দূর থেকে রোগ সারিয়ে দেয়’ বলে প্রচার চালায়। আশ্চর্যের বিষয় হলো- এই প্রতারকরা বছরের পর বছর নির্বিঘেœ ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে, অথচ স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্যবিভাগ এমনকি সমাজের প্রভাবশালী মানুষরাও বিষয়টি জানে। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না। কারণও আছে, এই প্রতারকরা কখনো একা থাকে না। তাদের চারপাশে থাকে রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এমনকি কিছু প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা। তারা বুঝে গেছেন, এই ‘ভণ্ডচিকিৎসা-ব্যবসা’ কেবল অর্থ নয়, প্রভাব বিস্তারেরও হাতিয়ার। ফলে একজন ‘ফুঁ বৈদ্য’ হয়ে ওঠে স্থানীয় ক্ষমতার এক অদৃশ্য অংশ।

 

প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, লোহাগাড়ার এই ঘটনার পর যখন প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়, তখন স্বাস্থ্যকর্মকর্তা বলেছেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রে এর কোনো ভিত্তি নেই’। কিন্তু প্রশাসনের বক্তব্য হলো- ‘বিষয়টি আমাদের জানা নেই’। ‘জানা নেই’- এই চারটি শব্দই আমাদের প্রশাসন ও রাষ্ট্রের দুর্বলতার সারসংক্ষেপ। কারণ একজন ব্যক্তি বছরের পর বছর ধরে শত শত মানুষকে ঠকাচ্ছে, তার নামে এলাকায় বহু অভিযোগ রয়েছে- তবু প্রশাসন জানে না! এটি দায় এড়ানো ছাড়া আর কি হতে পারে? এটি কেবল অবহেলা নয়, এটি দায়িত্বে ব্যর্থতার এক নগ্ন উদাহরণ। একটি সমাজে যখন অজ্ঞতা ও কুসংস্কার এবং অসহায়ত্বের মূলোৎপাটন না হয়ে দিন দিন বেড়ে যায়, তখন ‘অলৌকিকতার ব্যবসা’ চাঙ্গা হয়ে উঠে। তাছাড়া বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালের ভিড়, চিকিৎসকের অভাব, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অনুপস্থিত, আর বেসরকারি চিকিৎসা খরচসাপেক্ষ। এই অবস্থায় গ্রামের মানুষ যখন সমাধান খুঁজে পায় না, তখন তারা বিশ্বাস করে ‘বাবা ফুঁ দিলে ভালো হবে’, ‘জিন ছাড়িয়ে দেবে’- এই মনস্তাত্তি¡ক চাহিদাই শাহনেওয়াজ- উঃসিরিদের টিকিয়ে রাখে।

 

প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ফুঁ বৈদ্যের দরবারে নারীরোগীদের ব্যাপক উপস্থিতি। এটি সমাজের আরেক গভীর ক্ষতকে নির্দেশ করছে। অনেক নারী নিজের রোগ নিয়ে খোলাখুলি ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন না, স্বামী বা পরিবার নিয়ে যায় না। তার উপর দাম্পত্য বা পারিবারিক সমস্যা থাকলে সেই কষ্টের কথা কাউকে বলতেও পারেন না। সেই সুযোগে ঢুকে পড়ে এইসব ‘বৈদ্য’রা। তারা বলে, ‘তোমার উপর জিনের প্রভাব আছে’, ‘স্বামীর মন অন্য নারীর দিকে চলে গেছে, আমি ফেরত আনব’- এইসব মিথ্যে আশ্বাসেই নারীটি মুগ্ধ হয়, টাকা দেয়, আবার প্রতারিত হয়। কিন্তু এটি কেবলই প্রতারণা নয়, এটি একধরনের শোষণও। এই শোষণের শিকার হলো সেই শ্রেণি যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, শিক্ষায় পিছিয়ে, এবং ধর্মীয়ভাবে সহজে প্রভাবিত হয়। ফলে একদিকে ধর্ম, অন্যদিকে দারিদ্র- দুটোই এই প্রতারকদের অস্ত্র হয়ে ওঠে।

 

এখন প্রশ্ন হলো- এর প্রতিকার কীভাবে সম্ভব? প্রথমত, আইনের প্রয়োগ হতে হবে কঠোরভাবে। বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন অনুযায়ী, নিবন্ধন ছাড়া কেউ চিকিৎসা দিতে পারে না। শাহনেওয়াজ ও উঃসিরি বৈদ্যদের মতো প্রতারকরা নিজেদের চিকিৎসক নয় বলে দাবি করে, কিন্তু তারা চিকিৎসা-সদৃশ কাজই করছে। তাই তাদের ‘অলৌকিক চিকিৎসা’কেও প্রতারণা হিসেবে গণ্য করে ফৌজদারি আইনে দÐনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও আলেম সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলাম কখনো প্রতারণা বা মিথ্যা অলৌকিকতার অনুমোদন দেয়নি। কুরআন-পাঠ, দোয়া বা রুকইয়া- এসবের উদ্দেশ্য হলো আত্মিক শান্তি, আরোগ্য নয়। তাই ইমাম-মাওলানাদের দায়িত্ব হলো- গ্রামীণ মানুষদের বোঝানো যে ‘ফুঁ বৈদ্য’ বা ‘জিন হাজিরা’ কোনো ইসলামি প্রথা নয়, বরং এটি ইসলামবিরোধী কর্মকাÐ। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত গ্রামের মানুষ স্থানীয় হাসপাতালকে বিশ্বাস করবে না, ততদিন তারা ‘বাবা বৈদ্য’-র কাছে যাবে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মানসম্মত চিকিৎসা, বিশেষ করে নারী স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা না করলে এই প্রতারণা রোধ সম্ভব নয়। চতুর্থত, গণমাধ্যমেরও ভূমিকা রয়েছে। কেবল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলেই দায়িত্ব শেষ নয়। বরং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে হবে, এই প্রতারকদের অর্থ কোথা থেকে আসে, কারা তাদের পেছনে, প্রশাসন কেন নীরব- এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে নিয়মিতভাবে। জনগণকে তথ্য দিতে হবে যাতে তারা সচেতন হয়। সবশেষে আসা যাক সমাজের দায়ে। আমরা যারা শিক্ষিত, যারা শহরে থাকি, তারাও এই ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার নই। আমরা চুপ করে থাকি। কিন্তু এই নীরবতাই প্রতারকদের শক্তি যোগায়। সমাজ যদি সাহস নিয়ে বলতে পারে- ‘এটি প্রতারণা’ তাহলে এইসব ‘ফুঁ বৈদ্য’রা টিকতে পারবে না।

 

লোহাগাড়ার শাহনেওয়াজ এখন কোটিপতি। তার বিলাসবহুল বাড়ি, গরুর খামার, বিদেশে সন্তান পড়ছে- সবই এসেছে মানুষের কষ্টের টাকা থেকে। প্রতিটি টাকাই কোনো না কোনো অসহায় মানুষের দুঃখের দাম। অথচ স্থানীয় প্রশাসন নীরব, সমাজ তার ভয়ে নত। এই দৃশ্য আমাদের রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। একদিকে আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলি, অন্যদিকে ‘ফুঁ বৈদ্য’রা লাখো মানুষকে প্রতিদিন ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। এটি রাষ্ট্র, সমাজ, এবং আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। এখন সময় এসেছে এই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করার। শাহনেওয়াজ এবং উঃসিরি বৈদ্যদের থামাতে হবে। থামাতে হলে শুধু পুলিশ পাঠালেই হবে না, মানুষের মনের অন্ধকারে আলো ফেলতে হবে। সেই আলো হতে পারে শিক্ষায়, বিজ্ঞানে, সচেতনতায়, আর সবচেয়ে বেশি দরকার মানবিকতার আলো। কারণ ‘ফুঁ বৈদ্য’ কেবল একজন প্রতারক নন, তিনি এক প্রতীকে পরিণত হয়েছেন- এমন সমাজের প্রতীক, যেখানে মানুষ কষ্টে বিশ্বাস হারিয়েছে চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি, হারিয়েছে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা, তাই শেষভরসা করেছে ধোঁয়ার ফুঁয়ে। সেই ফুঁ তাদের রোগ সারায় না, বরং ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয় তাদের বিবেক, তাদের আত্মসম্মান, তাদের যুক্তিবোধ। এখনই সময়, এই প্রতারণার চক্র ভাঙার। এ জন্যে প্রশাসনকে জবাবদিহির মুখে দাঁড়াতে হবে, সমাজকে সচেতন হতে হবে, আর ধর্মীয় নেতাদের দায়িত্ব নিতে হবে। অন্যথায় আগামী প্রজন্মও বড় হবে একই অন্ধকারে- যেখানে চিকিৎসার বদলে ফুঁ, বিজ্ঞানীর বদলে বৈদ্য, আর বিশ্বাসের জায়গায় থাকবে ভয় ও প্রতারণা। বাংলাদেশ, যে দেশকে বৈষম্যহীন উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই, সেই দেশের মাটিতে যেন আর কোনো ‘ফুঁ বৈদ্য’ জন্ম না নেয়। সেই দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, আমাদের প্রত্যেকের, কারণ অন্ধবিশ্বাস যতদিন বেঁচে থাকবে, প্রতারণা ততদিনই ফুলেফেঁপে উঠবে।

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট