
আধিপত্য ও চাঁদাবাজি নিয়ে পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলার সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিলো আরেকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের। তারা সরোয়ারকে ‘দুনিয়া থেকে সরাতে’ কয়েক দফা চেষ্টাও চালায়। গত ৩০ মার্চ নগরীর বাকলিয়া এলাকায় তাকে লক্ষ্য করে সিনেমা স্টাইলে গুলি ছোড়া হয়। দুই সহযোগী নিহত হলেও সেবার সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সরোয়ার।
এই ঘটনার ৭ মাস পার না হতেই ফের হামলার শিকার হলেন সরোয়ার। চট্টগ্রাম শহর দাপিয়ে বেড়ানো এই শীর্ষ সন্ত্রাসী নিজ ঘরের সামনেই খুন হলেন সন্ত্রাসীদের গুলিতে। গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টায় নগরীর বায়েজিদ থানার চালিতাতলী খন্দকারপাড়া এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন তিনি।
সরোয়ারের বাবা আবদুল কাদেরের দাবি, তিনদিন আগে ভারতে থাকা সন্ত্রাসী বড় সাজ্জাদ ছেলেকে ফোন করে বলেছেন, তোমার সময় শেষ। যা খাবার খেয়ে নাও। কারাগারে থাকা ছোট সাজ্জাদের সহযোগী রায়হানের নেতৃত্বে সরোয়ারকে খুন করা হয়েছে। হত্যার সময় মুখোশ পরা ৭/৮ জন যুবক ছিল।
পুলিশ জানায়- নিহত সরোয়ার হোসেন বাবলা পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি নিজেকে বিএনপি কর্মী বলে দাবি করতেন। গত একমাস আগে বিয়ে করেন সরওয়ার।
নগর পুলিশের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার আমীরুল ইসলাম জানান, এরশাদ উল্লাহ সাহেব নির্বাচনী প্রচারে চালিতাতলী এলাকায় এসেছিলেন। সেখানে সন্ত্রাসীদের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। সরোয়ারসহ আহত সবাইকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সরোয়ার মারা যায়।
এর আগে গত ৩০ মার্চ নগরের বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকায় একটি প্রাইভেটকারে গুলি চালিয়ে ‘সন্ত্রাসী’ সরোয়ারকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ওই সময় প্রাইভেট কারে থাকা তার সহযোগী বখতিয়ার হোসেন মানিক ও আবদুল্লাহ আল রিফাত নামে দুজন ঘটনাস্থলে মারা যান। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সরোয়ার।
পরে এই মামলায় গ্রেপ্তার আসামিরা জবানবন্দিতেও পুলিশকে জানান, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের নির্দেশে সরোয়ারকে গুলি করা হয়। ছোট সাজ্জাদ বিদেশে পলাতক শিবির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সাজ্জাদ আলীর অনুসারী। একসময় সরোয়ার হোসেনও তাঁর অনুসারী ছিলেন। ২০১৫ সালের পর থেকে সরোয়ার তাদের কাছ থেকে সরে যান।
কে এই সরওয়ার:
২০০০ সালের ১২ জুলাই বহদ্দারহাটে সন্ত্রাসী হামলায় ছয় ছাত্রলীগ কর্মীসহ আটজন নিহত হন। সে ঘটনায় করা মামলায় সাজ্জাদ আলী (বড় সাজ্জাদ) সাজাপ্রাপ্ত হলেও পরে উচ্চ আদালত থেকে খালাস পান। এরপর তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। তবে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থামাননি। বিদেশ থেকে তাঁর বাহিনীর মাধ্যমে বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারীতে অপরাধ পরিচালনা করে আসছেন। তাঁর এসব কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছেন সাজ্জাদ হোসেন (ছোট সাজ্জাদ)।
২০১১ সালের ১৬ জুলাই একে-৪৭ রাইফেলসহ পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বাহ্মণবাড়িয়া থেকে সাজ্জাদের অন্যতম সহযোগী ম্যাক্সন ও সরওয়ারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর থেকে তারা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিল। ২০০৬ সালে ভয়ংকর সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন খানের হাত ধরে চট্টগ্রামে অপরাধ জগতে এসে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে এ দুই সন্ত্রাসী।
খুন,অস্ত্র,অপহরণসহ একাধিক ঘটনায় তারা চট্টগ্রামে ‘মানিকজোড়’ সন্ত্রাসী হিসাবে পরিচিত ছিল। ২০১৩ সালের ১৫ নভেম্বর ঈদের আগের রাতে দুই সন্ত্রাসী সরোয়ার ও ম্যাক্সন জামিনে মুক্তি পেয়েছিল। ২০২২ সালে ভারতে আতœহত্যা করে মারা যায় ম্যাক্সন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে মুক্তি পায় সরোয়ার। এরপর থেকে সরওয়ারকে উত্তর জেলা বিএনপি প্রভাবশালী এক নেতার সাথে বিভিন্ন সভা সমাবেশে দেখা যায়।
২১ বছরের কারাদণ্ড :
২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল -৭ এর বিচারক এবং যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ মোছাম্মৎ বিলকিস আক্তার অস্ত্র মামলার রায়ে নুরুন্নবী প্রকাশ ম্যাক্সন, সরওয়ার এবং মানিক ওরফে গিট্টু মানিককে ২১ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। রায়ের সময় সরওয়ার ও ম্যাক্সন আদালতে হাজির থাকলেও মানিক জামিনে বের হয়ে পলাতক থাকে। ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট জামিনে মুক্ত হয়ে কাতার চলে যায় সরওয়ার ও ম্যাক্সন। ২০২০ সালে কাতার থেকে দেশে ফিরলে শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে সরওয়ারকে গ্রেপ্তার করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। পরে তাকে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় হস্তান্তর করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বায়েজিদ খোন্দকারবাদ কালু মুন্সি পাড়ায় তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটি আমেরিকার তৈরি একে-২২ রাইফেল, ৩০ রাউন্ড গুলি, দুটি এলজি ও চার রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করে পুলিশ।
পূর্বকোণ/ইবনুর