
বাঁশখালীতে ২৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেড়িবাঁধ দুই বছর না যেতেই ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। বাঁধের বিভিন্ন স্থান ভেঙে সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ব্লক ও জিও ব্যাগ তছনছ হয়ে বাঁধের অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিম্নমানের কাজের কারণে বাঁধটি বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে বলে দাবি এলাকাবাসীর।
বর্তমানে বাঁশখালীতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পে বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার ও ব্লক বসানো হবে। কিন্তু প্রকল্পের শুরুতেই অনিয়ম, নোনামিশ্রিত পানি, লবণাক্ত বালু ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ ওঠেছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে বাঁশখালী উপজেলা প্রশাসন। ২৭ অক্টোবর কদম রসুল এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতে প্রকল্পের দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে বাঁশখালী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ওমর সানি আকন বলেন, ‘লবণাক্ত বালু জব্দ করা হয়। এসব বালু সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা দেওয়া হয়।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী স্বপন কুমার বড়ুয়ার গ্রামের বাড়ি বাঁশখালীতে। নিজ এলাকার প্রকল্পের শুরুতেই অনিয়ম অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বপন কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘লবণপানিমিশ্রিত বালু দিয়ে ব্লক বানানো এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিষয় জানা নেই।’
২০১৭ সালে জানুয়ারিতে বাঁধ নির্মাণে প্রতিমিটারে খরচ ধরা হয়েছিল দুই দশমিক ৩৩ লাখ টাকা। ২০২২ সালে ধরা হয়েছে সাত দশমিক ৪৬ লাখ টাকা। ব্যয় বাড়িয়েও অনিয়ম-নিম্নমানের কাজ ঠেকানো যাচ্ছে না। ২৯৩ কোটি টাকার প্রকল্প পরিচালক ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন নির্বাহী অফিসার ও বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক। ৫০০ কোটি টাকার ভাঙন প্রকল্পেও প্রকল্প পরিচালক তিনি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওখানকার বালু দিয়ে ব্লক বানানোর সুযোগ নেই।’
গত ১৫ অক্টোবর বাঁশখালী বেড়িবাঁধের বাহারছড়া, খানখানাবাদ, কদমরসুল এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা হয়। দেখা যায়, বাঁশখালীতে ১১ কি.মি বাঁধের অন্তত ১৬ স্থানে ভাঙন ধরেছে। ব্লক ধসে পড়েছে। বিভিন্ন স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে।
খানখানাবাদ এলাকার নুরুল হামিদ, কদমরসুল এলাকার মোরশেদ ও নেজাম সওদাগর বলেন, ‘২৯৩ কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বাঁধ টেকসই হয়নি। সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।’ তারা বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি, চেয়ারম্যান ও নেতাকর্মীরা মিলেমিশে গিলে খেয়েছে।’
গত দুইদিন (মঙ্গল ও বুধবার) সাধনপুর, ছনুয়া ও সরল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, লবণপানিমিশ্রিত বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তবে উপজেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই বালু দিয়ে ব্লক নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে।
এদিকে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডকে (পিডিএল) বালু সরবরাহকারী মোহাম্মদ কাইদুল ওয়াদুদ (জিহান) লবণপানিমিশ্রিত বালু সরবরাহ করার কথা স্বীকার করেন। এ জন্য এলাকাবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এখন রাতের আঁধারে লবণ বালু ফেলা হচ্ছে।’ স্থানীয়ভাবে সংবাদ সম্মেলন করে একথা বলেছেন তিনি।
সরেজমিনে গতকাল বুধবার খানখানাবাদ ইউনিয়নের কদম রসুল এলাকায় দেখা যায়, ব্লক তৈরির কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে লবণপানিযুক্ত বালুগুলোর বিশাল স্তূপ রয়েছে। সাধনপুরে সাঙ্গু নদী রাতার কুল পয়েন্টে বালু উত্তোলনের কাজ চলছে। গত দুই মাস ধরে ড্রেজার মেশিন থেকে বালু তোলা হচ্ছে।
সাঙ্গু নদীর পানি ব্যবহারের বিষয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পিডিএল’র দায়িত্বরত প্রকৌশলী সুশেন চাকমা দাবি করেন, ‘এই পানিগুলো লবণাক্ত না। সাগরের পানি অনেক দূরে। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, এগুলো মিষ্টি পানি।’
কদমরসুল হাছিয়াপাড়া এলাকায় এক কিলোমিটার অংশে বেড়িবাঁধ নেই। ৫০০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সামশুল আলম (৬৫), সাজেদুর রহমান (৫৫), মো. বোরহান উদ্দিন (৪৫)। তারা বলেন, ‘সাগরের নোনাবালু, নোনাপানি ও নিম্নমানের নুড়িপাথর দিয়ে কাজ চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা তা দেখেও না দেখার ভান করে রয়েছে।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিডিএলের কদম রসুল এলাকার প্রকৌশলী ফখরুল হাসান বলেন, ‘স্থানীয়রা টিকাদারি কাজের জন্য বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করছে। বালু দিতে না বললেও বালু দিয়ে দিচ্ছে। লবণাক্ত বালু ব্যবহার না করার জন্য সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) মহোদয় সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সব সময় কাজের মান চাই।’
কদমরসুল এলাকার ফরিদুল আলম (৫৫) বলেন, ১০ কানি জমা-জিরাত সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দইজ্যা খুদি দইজ্যার (সাগরের মাটি ও বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণ) গড়ার কারণে বাঁধ স্থায়ী ও টেকসই হচ্ছে না। একই এলাকার মৎস্যজীবী মোরশেদ ও নেজাম উদ্দিন বলেন, চলতি বছরের আগস্ট মাসে ফেলা জিও ব্যাগ ইতিমধ্যেই তছনছ হয়ে গেছে। এভাবে বাঁধ সংস্কারের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। প্রকল্পের নামে সরকারি টাকা লুটপাটের উৎসব হয়। জনগণের কল্যাণ হচ্ছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী অনুপম পাল পূর্বকোণকে বলেন, পাথরের মান নিয়ে সমস্যা নেই। তবে লবণপানির জন্য বালু নিয়ে একটু সমস্যা রয়েছে। আমরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছি।
২০২৪ সালের ২৭ মে একনেক সভায় আনোয়ারা ও বাঁশখালী উপজেলায় সাগর উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ভাঙন প্রতিরোধে ৮৭৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পে বাঁশখালীর জন্য ৪৯৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। এতে বাহারছড়া, ছনুয়া, সাধনপুর, খানখানাবাদ চার ইউনিয়নে ৬ দশমিক ২১০ কিলোমিটার সমুদ্র তীর প্রতিরক্ষার কাজ করা হবে। মোহনায় ১৩০০ মিটার পুরোনো বাঁধ শক্তিশালী (সংস্কার) করা হবে।
প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ পেয়েছে প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (পিডিএল)। এছাড়া হাসান এন্ড ব্রাদার্স এবং জামিল ইকবাল নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। তবে পিডিএল ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো কাজ শুরু করেনি। কাজ শুরু করার জন্য একাধিকবার চিঠি দিয়েছে পাউবো।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী অনুপম পাল বলেন, ‘কাজ শুরু করার জন্য নোটিশ করা হয়েছে। কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জামশেদুল আলম বলেন, ‘বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে বালুর মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর বালু পরিবর্তনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অমান্য করে লবণাক্ত বালু তোলার কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কোনোভাবেই লবণপানি মিশ্রিত বালু দিয়ে ব্লক নির্মাণ করা যাবে না।’
পূর্বকোণ/ইবনুর