
বিশ্বে খাদ্যের উৎপাদন আজ এত বেশি যে বৈশ্বিক জনসংখ্যার দেড় গুণ মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব। অথচ এই পৃথিবীতেই প্রতিদিন প্রায় ৭৮ কোটি মানুষ না খেয়ে ঘুমাতে যায়। এর কারণ খাদ্যের অভাব নয়, বরং খাদ্য বণ্টনের অসমতা এবং ভয়াবহ অপচয়। ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের উৎপাদিত মোট খাদ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই কোনো না কোনো পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যায়। এই ক্ষতির আর্থিক মূল্য বছরে প্রায় এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু আরও মর্মান্তিক হলো, এই অপচয়ের তালিকায় এখন এশিয়ার শীর্ষ পাঁচ দেশের একটি বাংলাদেশ। জাতিসংঘের ‘ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স ২০২৪’-এর তথ্য বলছে, বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবার বছরে গড়ে ৮২ কেজি খাদ্য নষ্ট করে। কোটি কোটি টন খাদ্য অকারণে নষ্ট হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ একবেলা খাবারও পাচ্ছে না। চাহিদা মতো খাবার খেতে না পারার কারণে পুষ্টিহীনতায় ভোগছে লাখো মানুষ। এই দ্বৈত বাস্তবতাই আজ আমাদের সময়ের নির্মম পরিহাস। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার পথে এ এক বড় বাধা।
ইউএনইপি’র ‘ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স ২০২৪’ ও ‘গে্লাবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস (জিআরএফসি) ২০২৫’-এর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ খাদ্য অপচয়ের ক্ষেত্রে এশিয়ার শীর্ষ ৫ দেশের একটি। খাদ্য নষ্ট হয়ে থাকে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে। সে হিসেবে বছরে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ৩৪ শতাংশই নষ্ট হয়। ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্য নষ্টের তালিকায় এশিয়ার শীর্ষ ৫ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। খাদ্য নষ্টের তালিকায় বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে মালদ্বীপ। দেশটি বছরে পরিবারপ্রতি ২০৭ কেজি খাদ্য নষ্ট করে। পাকিস্তানে হয় ১৩০, আফগানিস্তানে ১২৭, নেপালে ৯৩, বাংলাদেশ ৮২, শ্রীলঙ্কা ও চীনে ৭৬, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩ ও ভারতে ৫৫ কেজি। গেøাবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস (জিআরএফসি) অনুযায়ী, ২০১৬-২০২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৮ বছর বিশ্বের যেসব দেশ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরে অবস্থান করছিল সেখানে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয়। জিআরএফসির রিপোর্ট মতে, তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরে সর্বোচ্চ স্তরে ছিল নাইজেরিয়ার মানুষ ৩১.৮ মিলিয়ন, সুদান ও কঙ্গোর ২৫.৬, বাংলাদেশের ২৩.৬, ইথিওপিয়ার ২২, ইয়ামেনের ১৬.৭, আফগানিস্তানের ১৫.৮, মিয়ানমারের ১৪.৪, পাকিস্তানের ১১.৮ মিলিয়ন। গবেষণায় দেখা গেছে, ধনী পরিবারগুলোতে খাদ্যের অপচয় সবচেয়ে বেশি। আর দরিদ্র পরিবারগুলোতে সবচেয়ে কম। বাংলাদেশে উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীর ১০০ শতাংশ পরিবার প্রতি সপ্তাহে ০.৫ থেকে ২.০ কেজি খাদ্য অপচয় করে। অর্থাৎ তারা প্রতিবছর প্রায় ২৬-১০৪ কেজি খাদ্য অপচয় করে।
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশে খাদ্যের অপচয় ও ক্ষতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আমাদের উৎপাদিত খাদ্যের আনুমানিক ৩৪ শতাংশ নষ্ট হয়। একই অনুষ্ঠানে ডবিøউএফপি বাংলাদেশের অফিস ইন চার্জ ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর জেসি উড বলেছেন, ফসল কাটার পর ৮-১৫ শতাংশ ধান নষ্ট হয় এবং ২০-৪০ শতাংশ ফল ও সবজি নষ্ট হয়। এসবের মূল্য ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাঁর মতে, বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শাকসবজি, মাছ এবং প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন করে। সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতার কারণে উৎপাদিত পণ্যের বাইরেও বিপুল পণ্য আমদানি করতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পূর্বাপেক্ষা অগ্রগামী। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন। গত অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি টনেরও বেশি। অর্থাৎ ৫২ বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩৬৫ শতাংশ। আধুনিক প্রযুক্তি, গবেষণা ও কৃষকের পরিশ্রমের ফলে চাল, গম, ভুট্টা, শাকসবজি ও মাছ উৎপাদনে আমরা প্রায় আত্মনির্ভরতার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বিপুল উৎপাদনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই নষ্ট হয়ে যায় উৎপাদন, পরিবহন বা সংরক্ষণ পর্যায়ে। ফসল কাটার পর ধানের গড়ে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ নষ্ট হয়, গমে ১৭.৫ শতাংশ, ফলে ও শাকসবজিতে ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। আম ৩১.৭ শতাংশ, আলু ২১.৮, গাজর ২৬.৮, টমেটো ২৭.৯ শতাংশ পর্যন্ত পচে যায় বাজারে পৌঁছানোর আগেই। স¤প্রতি বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চালের প্রস্তুতির পূর্বে পোস্টহার্ভেস্ট পর্যায়ে ধান নষ্ট হয় ১৭.৮০ শতাংশ। ফসল কাটার পর ধানের গড় ক্ষতি বা নষ্ট হয় ১৭.৮০ শতাংশ। তার মধ্যে কৃষক, মধ্যস্বত্বভোগী এবং মিলারদের স্তরে নষ্ট হয় ১৪.০২ শতাংশ। পরিবহনে ১.৪, মাড়াইয়ে ১.৭, ঝাড়ায় ১.৫, শুকানোতে ২.৬, সংরক্ষণে ৬.৮, মধ্যস্বত্বভোগীতে ১.৬২ এবং মিলারদের ক্ষেত্রে ২.১২ শতাংশ।
তবে ফসল কাটার আগে ক্ষতিসহ মোট ধানের ক্ষতি হয় ২৩ থেকে ২৮ শতাংশ। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাদ্য হচ্ছে গম। কাটার পর এই গমের গড় ক্ষতি ১৭.৫৯ শতাংশ। ফল এবং শাকসবজি কাটার পর ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়। আম ৩১.৭, কলা ১৯.৯, আলু ২১.৮, গাজর ২৬.৮, টমেটো ২৭.৯ শতাংশ। সার্ক কৃষি তথ্যের হিসেবে, বাংলাদেশে বার্ষিক শস্য অপচয় ১২.৯ শতাংশ, শিকড় ও কন্দ ৩৬.৯, তৈলবীজ ও ডাল ১০.৩, ফল ও শাকসবজি ৪০.২, মাংসজাত দ্রব্য ১৪.৯, মাছ ও সামুদ্রিক খাদ্য ৩০.২, দুগ্ধজাত দ্রব্য ১৭.৫ এবং অন্যান্য খাদ্য ২৪.৯ শতাংশ। গরু ও মহিষের দুধ দোহনের পর নষ্ট হয় ২৪.৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে গরুর ৮.০৭ এবং মহিষের ১৫.৬৭ শতাংশ। ডিম নষ্ট হয় ১২.৯ শতাংশ, হাঁস ও মুরগির মাংস ১৬.৯, গরু ও মহিষের মাংস ২১.৪ শতাংশ নষ্ট হয়। তা ছাড়া মাংস এবং মাংসজাত দ্রব্য ৫-৯ এবং দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে নষ্ট হয় ৮-১২ শতাংশ। ছোট মাছ ধরার পর নষ্ট হয় ২৫.৪৫ ও কার্পজাতীয় মাছ ১৮.১৩ শতাংশ। মাছের পাত্র বাঁশের ঝুড়িতে ২৩ শতাংশ, ফ্রিজে ২.৫ শতাংশ পর্যন্ত মানের ক্ষতি হ্রাসে ভূমিকা রাখে। সার্ক কৃষি তথ্যের হিসাবে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৪ মিলিয়ন টন খাদ্য অপচয় হয়, যার অর্থনৈতিক মূল্য জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ। সব খাদ্যপণ্যেই অপচয়ের হার ভয়াবহ। এই বিশাল অপচয় দেশের কৃষক, ভোক্তা ও অর্থনীতির জন্য সমানভাবে ধ্বংসাত্মক।
অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে খাদ্য অপচয় হলো ‘নীরব ক্ষয়ক্ষতি’। কৃষক তার শ্রমের সঠিক মূল্য পায় না, কারণ ফসলের একটি অংশ বাজারে পৌঁছানোর আগেই নষ্ট হয়ে যায়। সরকারকে আবার আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করতে হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের খাদ্যপণ্য আমদানি করেছে- চাল, গম, তেল, ডাল, দুধ, মসলা, সবই বিদেশ থেকে আসে। অথচ দেশে যে খাদ্য নষ্ট হয়, তা দিয়ে অনায়াসে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কয়েক মাস খাওয়ানো সম্ভব। এই অপচয়ের ফলে কৃষি খাতের লাভ কমে, গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হয় এবং খাদ্য আমদানিনির্ভরতা বাড়ে। অপচয়ের উৎস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মূলত তিনটি স্তরে খাদ্য নষ্ট হয়- উৎপাদন ও ফসল কাটার সময়, সংরক্ষণ ও পরিবহনের সময়, এবং শেষপর্যন্ত ভোক্তাপর্যায়ে। প্রথম স্তরে, কৃষকরা ফসল কাটার পর ধান বা গম যথাযথভাবে শুকাতে না পারায় আর্দ্রতা ধরে রাখে, ফলে পচন ঘটে। সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ বা আধুনিক গুদাম না থাকায় ফল-সবজি দ্রæত নষ্ট হয়। দ্বিতীয় স্তরে, পরিবহন ব্যবস্থা দুর্বল, সড়কে যানজট ও খোলা ট্রাকে পণ্য বহনের ফলে ফসলের মান নষ্ট হয়। শেষস্তরে, শহরের অভিজাত এলাকাগুলোতে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, বিয়ে অনুষ্ঠান বা পারিবারিক আয়োজনে যে পরিমাণ খাবার ফেলে দেওয়া হয়, তা এক একটি জেলার দরিদ্র মানুষের কয়েক দিনের আহারের সমান।
অপচয় কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, পরিবেশগত ক্ষতিরও এক বড় উৎস। খাদ্য পচে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে, যা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ২৫ গুণ বেশি গ্রিনহাউস প্রভাব সৃষ্টি করে। বিশ্বব্যাপী মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের প্রায় ১০ শতাংশের জন্য দায়ী খাদ্য পচন। একইসঙ্গে অপচয় মানে পানি, জমি, শ্রম ও শক্তির অপচয়ও বটে। এক কেজি চাল উৎপাদনে প্রায় ৩,০০০ লিটার পানি লাগে। যদি এই চাল নষ্ট হয়, তবে শুধু খাদ্য নয়, পানি ও শক্তিরও অপচয় ঘটে। এ কথা ঠিক, সরকার অপচয় রোধে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ‘সাশ্রয়ী কোল্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি স¤প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে, যাতে ক্ষুদ্র কৃষকরা তাদের শাকসবজি ও ফলমূল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে পারেন। এর পাশাপাশি ‘পেঁয়াজ সংরক্ষণ অভিযোজন প্রকল্প’-এর আওতায় কৃষকদের এয়ার ফ্লো মেশিন সরবরাহ করা হচ্ছে, যাতে সংরক্ষণকাল বাড়ে ও পচন রোধ হয়। এসব উদ্যোগ প্রশংসনীয়, সন্দেহ নেই। তবে তা দেশের মোট কৃষি উৎপাদনের তুলনায় অতি সীমিত। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত প্রায় ২৫ মিলিয়ন টন খাদ্যের মধ্যে ৫ মিলিয়ন টন নষ্ট হয়। কিন্তু কোল্ড স্টোরেজের সক্ষমতা মাত্র ২.৫ মিলিয়ন টন, যার অধিকাংশই আলুর জন্য ব্যবহৃত হয়। ফল, শাকসবজি, দুধ বা মাছের জন্য কার্যকর শীতল চেইন (পড়ষফ পযধরহ) অবকাঠামো এখনো গড়ে ওঠেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপচয় কমাতে প্রযুক্তি ও অবকাঠামো যতটা জরুরি, সচেতনতা তার চেয়ে বেশি। শহুরে জীবনে খাবার ফেলে দেওয়া এখন যেন একধরনের সামাজিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রেস্টুরেন্টে কেউ পেট ভরে খায় না, বিয়েবাড়িতে সিংহভাগ মানুষই প্লেটের অর্ধেক খাবার নষ্ট করে। এই প্রবণতা শুধু অর্থনীতির ক্ষতি নয়, একধরনের নৈতিক অবক্ষয়ও বটে। কারণ, যে দেশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, সেখানে খাবার নষ্ট করা মানে ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি উপহাস। বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ ইসলামের অনুসারী। ইসলাম ধর্মে খাদ্য অপচয়কে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘খাও ও পান কর, কিন্তু অপচয় করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না’ (সূরা আরাফ, আয়াত ৩১)। নবী করিম (সা.) খাবার শেষে নিজের হাত ও প্লেট পর্যন্ত পরিষ্কার করতেন, যেন খাদ্যের কোনো কণা অপচয় না হয়। অথচ আজ আধুনিক সমাজে এই নৈতিক শিক্ষার ছিটেফোঁটাও আমরা মানি না।
এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১২.৩ নম্বর লক্ষ্য অনুযায়ী, ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিশ্বব্যাপী খাদ্য অপচয় অর্ধেকে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ এই লক্ষ্যের অংশীদার হলেও এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ বা জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নেই। খাদ্য অপচয় নিয়ন্ত্রণের কোনো স্বতন্ত্র আইন বা নীতিমালাও নেই। অথচ খাদ্য অপচয় কমানো মানে শুধু ক্ষুধা রোধ নয়, বরং টেকসই কৃষি, দারিদ্র্য হ্রাস, পানি সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়ও বড় ভূমিকা রাখা। তাই সময় এসেছে বিষয়টিকে উন্নয়ন নীতির মূলধারায় আনার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য অপচয় রোধে সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। প্রথমত, কৃষি উৎপাদন থেকে বাজারজাত পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ফসল কাটার পর প্রক্রিয়াকরণ, শুকানো, প্যাকেজিং ও সংরক্ষণে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষি গবেষণা ও বিপণন অধিদপ্তরের আওতায় মোবাইল কোল্ড স্টোরেজ ও হিমায়িত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, শহরে হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইনত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অনেক উন্নত দেশে যেমন অতিরিক্ত খাবার দান করার ‘ফুড ব্যাংক’ ব্যবস্থা আছে, তেমন উদ্যোগ বাংলাদেশেও নেওয়া যেতে পারে। এতে একদিকে অপচয় কমবে, অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত হবে। তৃতীয়ত, জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাদ্যের মূল্যবোধ ও অপচয়ের পরিণতি নিয়ে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনসচেতনতা প্রচার, সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় জাতীয় প্রচারাভিযান শুরু করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরতার দোরগোড়ায়, কিন্তু খাদ্যব্যবস্থাপনায় এখনো পিছিয়ে। প্রতিবছর ১৪ মিলিয়ন টন খাদ্য অপচয় রোধ করা গেলে আমরা শুধু আমদানিনির্ভরতা কমাতে পারতাম না, বরং ক্ষুধার্ত জনগণের জন্য নতুন আশার দিগন্ত খুলতে পারতাম। তাই সরকারের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি নাগরিককেই দায়িত্ব নিতে হবে। ধর্মীয় নীতি, নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবিক বিবেচনায় আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে যে, এক মুঠো ভাতও যদি আমরা অযথা ফেলে দিই, তার দায় শুধু অর্থনীতির নয়, মানবতার কাছেও আমাদের চিরঋণী করে রাখে।
পূর্বকোণ/ইবনুর