
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপমুখী অবৈধ অভিবাসনের ঢল এখন শুধু একটি সামাজিক প্রবণতা নয়, বরং এক গভীর অর্থনৈতিক ও মানসিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। শোভন কর্মসংস্থানের অভাবে দেশে বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ফলে উন্নতর কর্মসংস্থান ও জীবিকার খোঁজে বিদেশ পাড়ি দিতে আগ্রহীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিবছর বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে গড়ে অন্তত ১০ লাখ মানুষ। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রন্টেক্স-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করা শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে তৃতীয় স্থানে। শুধু গতবছরেই প্রায় ২৭ হাজার বাংলাদেশি অবৈধ পথে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (UNHCR) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ থেকে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন অন্তত ৯৭২ জন বাংলাদেশি নাগরিক। এটি একটি ভয়াবহ পরিসংখ্যান। কিন্তু প্রশ্নটি হচ্ছে- দেশের তরুণরা কেন নিজেদের জীবন বাজি রেখে মৃত্যুযাত্রায় নামছে? আমরা কি কখনো এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি?
অথচ এই প্রশ্নের একেবারে কেন্দ্রেই আছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বাস্তবতা। প্রতিবছর প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, কিন্তু নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ লাখের জন্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ, তবে ‘আংশিক বেকার’ বা স্বল্পআয়ের কাজের মধ্যে থাকা মানুষের সংখ্যা ছয় কোটির বেশি। অর্থাৎ, যাদের কাজ আছে তারাও টিকে থাকতে পারছেন না। শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমবাজারের সংযোগ না থাকায় দক্ষতার ঘাটতি তীব্র। শিক্ষা শেষ করে তরুণরা যখন দেখছেন, তাদের ডিগ্রির কোনো বাস্তব মূল্য নেই, তখন বৈধ কিংবা অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দেওয়া তাদের কাছে একমাত্র মুক্তির রাস্তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ সুযোগের ফায়দা নিতে গড়ে উঠেছে সক্রিয় সিন্ডিকেট। দালাল চক্রকে কাজে লাগিয়ে সংঘটিত হচ্ছে অবৈধপথে কর্মী পাঠানো, মানবপাচারের মতো অপরাধ। বিদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ায় ও বৈধপথে যাওয়ার পথ সংকীর্ণ হওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে স্থল ও সমুদ্রপথে বাংলাদেশীদের অনেকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। মূলধারার গণমাধ্যমের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলছে, অবৈধপথে পাঁচ বছরে ইউরোপে গেছেন ৯৮ হাজার বাংলাদেশী। আইওএমের প্রতিবেদন বলছে, স্থল ও সমুদ্রপথে বাংলাদেশীদের প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠেছে ইউরোপের পাঁচটি দেশ ইতালি, গ্রিস, মাল্টা, সাইপ্রাস ও স্পেন। এর মধ্যে ইতালি শীর্ষে রয়েছে। এছাড়া পশ্চিম বলকান ও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন স্লোভেনিয়া, আলবেনিয়া, বসনিয়া, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, নর্থ মেসিডোনিয়া, মন্টেনিগ্রো ও কসোভোকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছেন বাংলাদেশীরা।
বাংলাদেশীদের জন্য বৈধপথেও ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে বিদেশের শ্রমবাজার। জাল কাগজপত্র, দুর্নীতি, মানবপাচারসহ নানা অভিযোগে গতবছর বেশকিছু দেশে শ্রম অভিবাসন বন্ধ হয়েছে। বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকরা কাজ করছেন- এমন প্রচারণা থাকলেও বাংলাদেশী কর্মীদের অভিবাসন মূলত কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য, বিদেশে দক্ষশ্রমিকের প্রচুর চাহিদা আছে। কিন্তু আমরা সে সুযোগটা নেওয়ার চেষ্টা করছি না। নানা অনুসন্ধানী ও গবেষণা-প্রতিবেদন বলছে, বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অদক্ষ শ্রমিকদের ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশ। প্রসঙ্গত, বিদেশের শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তি রফতানির লক্ষ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ১০৪ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) ও ছয়টি ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি (আইএমটি)। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অধীনে পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান উপযোগী ৫৫টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরেই প্রশিক্ষিত করা হয়েছে পৌনে ১২ লাখের বেশি কর্মীকে। কিন্তু বিবিএসের আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ ২০২৩-এর তথ্যমতে, সংশ্লিষ্ট কাজে কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছেন দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মী। বিদেশে কর্মসংস্থানপ্রত্যাশীদের মধ্যে মাত্র ১০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ বিদেশ পাড়ি জমানোর আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। এর মধ্যে আবার ৪৭ দশমিক ৬৬ শতাংশই দক্ষতা অর্জন করেন বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে জনশক্তি রফতানিতে এখন সম্ভাবনাময় গন্তব্যের নাম হয়ে উঠেছে জাপান। আগামী ১৫ বছরে দেশটিতে এক কোটির বেশি কর্মী প্রয়োজন হবে। কৃষিকাজ, নির্মাণখাত, কেয়ার গিভার, অটোমোবাইল, শিপিংসহ ১৬ ক্যাটাগরিতে জাপানে জনশক্তি রফতানির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ভাষা না জানা ও সংশ্লিষ্ট কাজে প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবসহ নানা কারণে বাংলাদেশ উল্লেখ করার মতো কর্মী পাঠাতে পারছে না। অন্যদিকে নেপাল, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক শ্রমিক যাচ্ছে দেশটিতে। বৈধপথে বিদেশে কর্মী পাঠাতে হলে এ খাতে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে শ্রমবাজারের চাহিদার বাস্তব সংযোগ তৈরি করতে হবে। কারিগরি শিক্ষা ও ভোকেশনাল ট্রেনিং কেন্দ্রগুলোর পাঠ্যক্রম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। বিদেশী ভাষা, কম্পিউটার, কেয়ার গিভার, যন্ত্রচালনা বা অপারেটিং স্কিল, নির্মাণ, ড্রাইভিংয়ে দক্ষতা অর্জনে জোর দিতে হবে। বৈধপথে দক্ষ জনশক্তি রফতানি বাড়াতে হলে পুরো কাঠামো সংস্কার করতে হবে।
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচবছরে বৈধপথে যে পরিমাণ বাংলাদেশী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন প্রায় সমপরিমাণ বাংলাদেশী অবৈধপথে দালালের মাধ্যমে ইউরোপে গেছেন। অবৈধভাবে যারা বিদেশে গিয়েছেন তাদের অনেকেই শ্রমশোষণ, নির্যাতন এমনকি অপহরণ ও হত্যারও শিকার হচ্ছেন। আবার বিদেশেও বৈধভাবে কাজের সুযোগ দিন দিন কমছে। মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও কুয়েতের মতো গন্তব্যে কোটাভিত্তিক শ্রমিক নেওয়া হয়, যার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও দুর্নীতিপূর্ণ। অনেক সময় সরকারি অনুমোদন পেতে দালালচক্রকে ঘুষ দিতে হয়, আবার প্রবাসে গিয়ে চুক্তিভিত্তিক কাজের শর্ত মানা হয় না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক জরিপে বলা হয়, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ৪৮ শতাংশ বাংলাদেশি শ্রমিক প্রতিশ্রুত বেতন পান না বা সময়মতো বেতন পান না। এই বাস্তবতায় তরুণরা ইউরোপকে ভাবছে ‘চূড়ান্ত গন্তব্য’ হিসেবে, যেখানে অন্তত মানবিক মর্যাদা ও স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ থাকবে। কিন্তু এই স্বপ্নের পেছনে যে মৃত্যুর ফাঁদ লুকিয়ে আছে, তা বোঝার সময় অনেকেরই থাকে না। ভূমধ্যসাগরের তলদেশে হাজারো লাশ এখন নিঃশব্দ সাক্ষী সেই অন্ধযাত্রার। লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কো এখন এই ‘ডেথ রুট’-এর প্রধান ট্রানজিট পয়েন্ট। মানবপাচারকারী চক্রগুলো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (IOM) এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ২০ হাজার মানুষ অবৈধভাবে উত্তর আফ্রিকায় যায়, যাদের ৮০ শতাংশের বেশি পরে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে। এই চক্রগুলো একেকজনের কাছ থেকে নেয় ৮ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। অথচ লিবিয়ার বন্দিশিবিরে তাদের বন্দি করে রাখা হয়, নির্যাতন করা হয়, অনেক সময় মুক্তিপণ আদায় করা হয় পরিবারের কাছ থেকে। দেশের ভেতর দালালচক্রের বিস্তারও উদ্বেগজনক। মাদারীপুর, ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী ও সিলেট অঞ্চলে মানবপাচারকারীদের সক্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত অংশের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ থাকায় আইনের প্রয়োগ হয় না। গত পাঁচবছরে ৩৫০টির বেশি মানবপাচার মামলা হলেও দণ্ডিত হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ আসামি। আইন প্রয়োগের এই শিথিলতা পাচারকারীদের উৎসাহিত করছে।
অবৈধ অভিবাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দেশের সামাজিক মনস্তত্ত্ব। বিদেশে যাওয়া এখন একধরনের সামাজিক মর্যাদা হয়ে উঠেছে। গ্রামের মানুষ মনে করে, ‘ইতালিতে গিয়েছে মানেই সফল’। ফলে তরুণেরা ঝুঁকি নিতে ভয় পায় না। অনেকেই জমি বিক্রি করে বা ঋণ নিয়ে এই বিপজ্জনক যাত্রায় নামে, কারণ পরিবারও মনে করে এই বিনিয়োগ একদিন ‘রেমিট্যান্স’ হয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বিনিয়োগ ফেরত আসে করুণপথে, লাশের কফিনে। তথ্য বলছে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারিভাবে দেশে ফেরত এসেছে ৩৪৮টি বাংলাদেশি লাশ, যাদের বেশিরভাগই লিবিয়া বা তিউনিসিয়া থেকে উদ্ধার করা। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অদক্ষতা ও অবহেলাও এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। মানবপাচার প্রতিরোধে সরকার ২০১২ খ্রিস্টাব্দে আইন করেছে, কিন্তু বাস্তব প্রয়োগ এখনও নগণ্য। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প’ আছে, কিন্তু ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের অডিট রিপোর্টে দেখা গেছে, বরাদ্দকৃত ১২০০ কোটি টাকার মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র ৪২ শতাংশ। প্রশিক্ষণের মানও প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ অনেক কেন্দ্রই আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষপ্রশিক্ষকের অভাবে অকার্যকর। ফলে দেশের তরুণরা ‘দক্ষশ্রমিক’ হিসেবে বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। অথচ অদক্ষশ্রমিক হিসেবে বৈধভিসা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের সীমান্তনীতি কঠোর করছে। ইতালি, গ্রিস ও স্পেন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে নতুন আইন চালু করেছে। যার ফলে অবৈধ অভিবাসী ধরা পড়লে তাকে শুধু দেশে ফেরত পাঠানো নয়, বরং তিনবছরের জন্য ওই দেশের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হবে। তবুও বাংলাদেশি তরুণরা এই ঝুঁকি নিচ্ছে। কারণ, তাদের কাছে মৃত্যু থেকেও বড় হলো বেকার জীবনের হতাশা ও ব্যর্থতা।
এমন প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের ভূমিকা শুধু আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না; প্রয়োজন বিকল্প জীবিকা ও আশার কাঠামো গড়ে তোলা। দেশের ভেতরেই এমন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে, যা তরুণদের আত্মমর্যাদার গ্যারান্টি দেয়, স্থায়ী আয় নিশ্চিত করে। কৃষি, আইটি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও হালকা প্রকৌশলখাতে দক্ষতার ভিত্তিতে কর্মসংস্থান বাড়ানো গেলে অভিবাসনের চাপ কমবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে কারিগরি প্রশিক্ষণকে বাধ্যতামূলক করা জরুরি। বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ‘দক্ষতা শিক্ষা’ সংযোজনের মাধ্যমে তরুণদের হাতে একটি কর্মমুখী বিকল্প দিতে হবে। এছাড়া বিদেশে বৈধ অভিবাসনের প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। সরকারি অনুমোদন পদ্ধতি ডিজিটালাইজ করা, দালালনির্ভরতা কমানো এবং প্রবাসীশ্রমিকদের জন্য ‘একক উইন্ডো’ সার্ভিস চালু করা প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশ যদি ‘লিগ্যাল মাইগ্রেশন করিডর’ তৈরি করতে পারে- যেমন ফিলিপাইন বা মরক্কো করেছে, তাহলে বৈধপথে শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হবে। এতে মানবপাচারের ঝুঁকি কমবে, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও বাড়বে। এই সংকটের একটি মানবিক দিকও আছে, যা প্রায়শই আলোচনায় আসে না। যে তরুণটি ইউরোপে পৌঁছে কোনোভাবে বেঁচে যায়, সে প্রায়ই মানবেতর জীবন যাপন করে। অচেনা দেশে অবৈধ অবস্থায় কাজ করে দিনে ১২ ঘণ্টা, কোনো শ্রমিক অধিকার নেই, কোনো চিকিৎসা নেই, আর দেশে পাঠানো টাকা দিয়ে পরিবার বাঁচে। কিন্তু সে নিজে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে। সমাজ তাকে সফল ভাবলেও তার বাস্তবতা শোষণ ও নিঃসঙ্গতার। অবৈধ অভিবাসন তাই কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি এক গভীর সামাজিক ও মানসিক ট্র্যাজেডি। তরুণেরা দেশ ছাড়ছে কারণ তারা আশাহীন; তারা বিশ্বাস করছে না রাষ্ট্রের প্রতিশ্রæতিতে, নীতিনির্ধারকদের কথায়। এই অবিশ্বাসই সবচেয়ে বড় সংকেত- যে সমাজ তার তরুণদের স্বপ্ন দিতে পারে না, সেই সমাজ শেষপর্যন্ত নিজের ভিত্তি হারায়। আজ বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো বহুমাত্রিক পদক্ষেপে সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, যাতে তরুণরা ভূমধ্যসাগরের মৃত্যুকূপ পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দিকে নয়, নিজের দেশেই ভবিষ্যৎ খোঁজে, নিজের দেশেই বাঁচার স্বপ্ন দেখে।
পূর্বকোণ/ইবনুর