
১৯ অক্টোবর, রোববার। ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলার শেষদিন। সকাল সকাল চলে গেলাম। গিয়ে দেখি মেলা ভাঙাহাটের মত। অধিকাংশ স্টল খালি। বাংলাদেশ স্টলও সকালে গুছিয়ে বইয়ের তাক থেকে বই নামিয়ে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্রদূত জুলকারনাইন সকালে এসে বাংলাদেশ স্টলে ঘুরে গেলেন। আমি রাষ্ট্রদূত মহোদয়কে বিদায় জানিয়ে মেলার জার্মান লেখকদের জমজমাট অনুষ্ঠানে গেলাম।
বিরাট হল ঘরের প্রবেশ পথে চলছে বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের উন্মুক্ত টকশো বা সংলাপ। উপস্থাপনকারী বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন, বিশিষ্ট জনপ্রিয় সাহিত্যিক বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। বিশাল হল ঘরের প্রবেশ পথের উন্মুক্ত স্টেজে এই প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে। মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। এই ভিড় শুধু আজকে নয় মেলার প্রতি দিনের চিত্র। সংলাপ ও আলোচনা সবকিছু হচ্ছে জার্মান ভাষায়। স্বাভাবিকভাবে আমরা অসহায় হয়ে দেখা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নাই।
মেলার ছোট ছোট স্থানে এই ধরনের সংলাপ প্রতিদিন বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। হয়েছে সেমিনার। তবে ছোট পরিসরে। তাও হাতে গোনা কয়েকজনের উপস্থিতিতে। কিন্তু জার্মানদের জন্য নির্দিষ্ট হলে গিয়ে দেখলাম ব্যতিক্রম। বিশাল হলে ভিড় দেখে বুঝা গেল কেন জার্মানরা বর্তমান বিশ্বে জ্ঞানচর্চায় অন্যতম সেরা। চিন্তায়, জ্ঞানচর্চায় বিশেষ করে বিজ্ঞান চর্চায় ও দর্শন চর্চায় ইউরোপে তারাই সবার চেয়ে এগিয়ে। ভিড় ঠেলে মূল হল ঘরে গেলাম। সেখানে জার্মান সাহিত্যিক ও কবিদের অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য মানুষ লাইন ধরে বসে আছে। সময় বেঁধে দেয়া আছে বিশিষ্ট ব্যক্তিটি কখন বসবে। একসাথে পাঁচজন বসে অটোগ্রাফ দিচ্ছে। লম্বা লাইন। অবাক করার বিষয় কেউ দাঁড়িয়ে নেই। সকলে বসে পরিবার পরিজনসহ অপেক্ষা করছে কখন তাদের সুযোগ আসবে। প্রিয় মানুষটির অটোগ্রাফ বা কিছুক্ষণের সান্নিধ্য পাবে। অনেকে বসে গোল হয়ে খাওয়া সেরে নিচ্ছে। হলঘরটি বেশ বড় দোতালায় ব্যালকনিসহ বসার ব্যবস্থাও আছে। কোন সাড়া শব্দ নাই। কথা বলছে নিচু স্বরে। এর ভিতর ছোট ছোট খাওয়ার দোকানও আছে। ইউরোপের অন্যতম সেরা জাতি হিসেবে সুশৃক্সক্ষল বজায় রাখা জার্মানদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
জার্মান এলাকা থেকে বের হয়ে বিদেশি এলাকায় আসলাম। এখন ঘুরে ঘুরে দেখলাম মেলার প্যাভিলিয়ন ও স্টলে সকলে গুটিয়ে নিচ্ছে। শুধু ব্যতিক্রম দেখলাম দক্ষিণ কোরিয়ার স্টলে। এখনও ভিড়। তারা পুরানো চিত্রের ছাপ দিচ্ছে কাঠের ডায়াস দিয়ে। দর্শনার্থীরা লাইন ধরে এই ডায়াসের ছাপ সংগ্রহ করছে। মেলার বিশাল এলাকার ছয়টি ভবনের প্রতিটি ভবনে চারটি তলায় বিশাল বিশাল ফ্লোরে ঘুরে দেখতেও অনেক সময় লাগে। এই ছয়টি ভবনের মাঝখানে শোভা পাচ্ছে বড় একটি পার্ক। পার্কে শোভা পাচ্ছে দৃষ্টি নন্দন লম্বা একটি ঝর্না। কৃত্রিম কুলকুল শব্দ সৃষ্টি করে কৃত্রিম স্রোত প্রবাহিত করা হয়েছে। পার্কে আছে বেশ কিছু ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান। মানুষ লাইন ধরে খাবার খেয়ে নিচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে।
শেষ চক্কর দিয়ে মেলাকে বিদায় জানাতে আবার বাংলাদেশ স্টলে ঢুঁ মারলাম। আমি আমার শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীকেও বিদায় শুভেচ্ছা জানালাম। তিনি আমাকে শরীরের দিকে খেয়াল রাখতে পরামর্শ দিলেন। সাইপ্রাসের লেখিকা হেলেনকে পূর্বকোণে তার ইংরেজিতে তার বইয়ের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনের ছবি দেখালাম। উচ্ছ¡সিত তার লেখা বইটি উপহার দিলেন। আমার সাথে সেলফি তুললো। এরপর আর একটি স্টলে ইংল্যান্ডের লেখক ফ্রিল্যান্সার টিম ওয়ার্ডের সাথে দেখা হলো। তিনি নিজেই একটি স্টল খুলে বসে আছেন। মানুষের সাথে মতবিনিময় করছেন। তিনি মূলত ভ্রমণ কাহিনী লিখেন। নিউজিল্যান্ডের ওপর লেখা তার বইটি স্টলে বিক্রয় করছেন।
পাঁচদিনের মেলায় শেষ দুদিনে বই বিক্রয় এবং সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য। এইবাবের বই মেলায় মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলোচনা হলেও সবাইকে ছাড়িয়ে যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যতের প্রভাব নিয়ে।
এবারের মেলায় প্রাপ্তি হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে বিশ্বের বুদ্ধিজীবী মহলের সতর্ক বার্তা। কৃত্রিম বুদ্ধিজাত যন্ত্র মানুষের সহজাত সৃজনশীল চিন্তার স্থান যদি দখল করে নেয় তাহলে মানুষের বেঁচে থাকার সার্থকতার ওপর আঘাত আসবে। মানুষ যন্ত্রের দাস হয়ে উঠবে। এবারের মেলায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিদিন ছোট ছোট সেমিনারে এই সতর্কবার্তা উচ্চারিত হয়।
লেখক: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দৈনিক পূর্বকোণ
পূর্বকোণ/ইবনুর