চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

বিচ্যুতির ফাঁদে বাড়ছে ভাঙন-বাস্তুচ্যুতি

পানি উন্নয়ন বোর্ড

বিচ্যুতির ফাঁদে বাড়ছে ভাঙন-বাস্তুচ্যুতি

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৮ অক্টোবর, ২০২৫ | ১০:৫৯ পূর্বাহ্ণ

বাঁশখালীর প্রেমাশিয়া এলাকার রোকেয়া বেগম (৫০) জন্মের পর থেকেই নানা দুর্যোগ ও সাগরের সঙ্গে লড়াই করে টিকে ছিলেন। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস তার কাছে নতুন কিছু নয়। ১৯৯১-এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে শুধু বসতভিটা ও জমা-জিরাত নয়, হারিয়েছেন স্বামী-সন্তানসহ ১৪ আপনজন। তারপরও সর্বগ্রাসী সাগরের মায়াজাল ছাড়তে না পেরে খুপরি ঘর বানিয়ে আশ্রয় নেন সেই মৃত্যুপুরীতে। সেই খুপরিও কেড়ে নেয় প্রমত্তা বঙ্গোপসাগর। বাপ-দাদা ও পূর্বপুরুষের ঠিকানা দরিয়ায় বিলীন হয়ে যায়। সর্বস্ব হারিয়ে এখন ঠাঁই নিয়েছেন সাধনপুরের বৈলগাঁও পাহাড়ের খুপরি ঘরে।

 

শুধু রোকেয়া বেগম নন, উপকূলীয় ৮ ইউনিয়নের বহু মানুষ বাস্তুভিটা হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন। ‘৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের পর বিভিন্ন দুর্যোগ-ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে বাঁশখালী, সন্দ্বীপ ও আনোয়ারা উপকূলীয় অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তু ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

 

গত বুধবার (১৫ অক্টোবর) বাঁশখালীর বাহারছড়া, খানখানাবাদ, কদমরসুল-তিন ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখা হয়। এর আগে গত আগস্ট মাসে খানখানাবাদ, কদমরসুল, প্রেমাশিয়া ও বাহারছড়া ইউনিয়নের ১১ কিমি বাঁধ এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। দেখা যায়, বেশির ভাগ এলাকায় বেড়িবাঁধ-ব্লক ধসে গেছে। জিও ব্যাগ তছনছ হয়ে গেছে। উপড়ে পড়েছে ঝাউবনের শত শত গাছ। এক-তৃতীয়াংশ এলাকা অরক্ষিত। চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে উপকূলবাসী। স্থানীয়রা দাবি করেন, বাঁধ নির্মাণের নামে সরকারি টাকা লোপাট হয়েছে। বাঁধ ভেঙে পানির টাকা পানিতে যাচ্ছে।

 

গত বুধবার কদমরসুল ইউনিয়নের হাছিয়াপাড়ার সামশুল আলম (৬৫), সাজেদুর রশিদ, মো. বোরহান উদ্দিনসহ ১০-১৫ জন লোকের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, ‘৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে বিলীন হয়ে যায়। ৩৪ বছরেও হাছিয়াপাড়ায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। ৩০০ মিটার জনবসতি এলাকা সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাপ-দাদার ভিটামাটি হারিয়ে প্রায় ৭০০ পরিবারের বসতি গড়ে ৫ কিলোমিটার দূরে।

 

কদমরসুলের খুসালাপাড়ার কিছু অংশে বাঁধ, ব্লক ও জিও ব্যাগ থাকলেও তা ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। মৎস্যজীবী মো. মোরশেদ ও ব্যবসায়ী নেজাম উদ্দিন বলেন, সাগরের বালুমিশ্রিত মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। পানির স্রোতে বাঁধ ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ৩-৪ মাস আগে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তাও ছিঁড়ে সাগরে চলে যাচ্ছে।

 

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামে লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়; তাতে বেড়িবাঁধও লণ্ডভণ্ড হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পর জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বাস্তুচ্যুতি বা উদ্বাস্তুর পরিসংখ্যান জানতে চেয়ে বাঁশখালী, আনোয়ারা, স›দ্বীপ, বোয়ালখালী উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু সরকারি কোনো দপ্তরে এই পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে পূর্বকোণের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য মতে, ৩৪ বছরে বাঁশখালীতে সাগরঘেঁষা ৬টি ও নদী তীরবর্তী দুই ইউনিয়নে প্রায় ৫ হাজার ৭শ পরিবার গৃহহারা হয়েছেন। ‘৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। স›দ্বীপে ‘৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে অন্তত ১০ হাজার মানুষ গৃহহারা হন। ২০০০-২০১০ সালে প্রায় ৮ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। সরকারি হিসাবে ঘূর্ণিঝড়ে ৪০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল।

 

আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর এলাকার উলুম গাজী জামে মসজিদের মোতোয়াল্লী ও সংবাদকর্মী ইমরান বিন ছবুর জানান, ‘৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে রায়পুর, জুঁইদণ্ডী, বারসাত, হাইলধর, বুরুমছড়া ও রায়পুরের ফখিরাহাট, বারলিয়া, শরঙ্গা এলাকায় অন্তত তিন শতাধিক ঘরবাড়ি ভেঙে নদী-সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। এরমধ্যে শতাধিক পরিবার বাস্তুচ্যুত-উদ্বাস্তু হয়েছে।

 

ভয়াবহ ভাঙনে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ: ২০২৩ সালে তীব্র ভাঙনপ্রবণ নিয়ে সমীক্ষা করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বলা হয়েছে, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলরেখায় তীব্র ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। ১৯৬০ থেকে ২০২০ সালের ৩০টি ঘূর্ণিঝড় বিবেচনা করে উপকূলীয় এলাকাকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

 

২০১৬ সালে রোয়ানু বিধ্বস্ত জনপদের সংবাদ সংগ্রহে একদল সাংবাদিকের সঙ্গে এ প্রতিবেদক গিয়েছিলেন বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকায়। তখন খানখানাবাদ, গণ্ডামারা, ছনুয়াসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা হয়। মাটির বাঁধ ও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এক জনপদ তখন। পরবর্তীসময়ে ওই এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে পাউবো।

 

গত আগস্ট মাসে বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নের খানখানাবাদ, কদমরসুল, প্রেমাশিয়া ও বাহারছড়া ইউনিয়নের বাহারছড়ার ১১ কিমি বাঁধ এলাকা সরেজমিনে দেখা হয়। দেখা যায়, বাঁধের অন্তত ১৬ স্থানে ভাঙন ধরেছে। ব্লক ধসে গেছে। বিভিন্ন স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। ছনুয়া, গণ্ডামারা, সরল, কাথরিয়া, বাহারছড়া, খানখানাবাদ-ছয়টি ইউনিয়নের সাগরঘেঁষা ৩৩ কিলোমিটারের মধ্যে এখনো দুই-তৃতীয়াংশ অরক্ষিত।

 

স্থানীয় জাহেদুল ইসলাম, রহিমা বেগম, আবদুল জলিল বলেন, বর্ষাকালে ভাঙন ভয়াল রূপ নেয়। তিন দশকে সাগর ও সাঙ্গুর ভাঙনে অন্তত চার হাজারের বেশি মানুষ গৃহহারা হয়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন। ৩শ কোটি টাকায় বাঁধ নির্মাণের তিন-চার বছরের মাথায় ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।

 

আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তিন দফায় সরেজমিন পরিদর্শনে উপকূলের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ, গণমাধ্যমকর্মী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীসহ অন্তত ২৫-৩০ জন লোকের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, এখন যেভাবে জলোচ্ছ্বাস কিংবা সাগরের ঢেউয়ে বসতভিটা বা জমিজিরাত নষ্ট হচ্ছে, আগে তেমনটা দেখেননি। বাঁধ টেকসই না হওয়ায় উপকূলবাসী এর সুফল পাচ্ছেন না। এজন্য বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিম্নমানের কাজকে দুষছেন এলাকাবাসী।

 

সময় ও টাকাখেকো প্রকল্প: বাঁশখালীতে ২০১৫ সালে ২০৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প একনেকে পাস হয়। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৯৩ কোটি টাকায়। ২০১৮ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হয় ২০২৩ সালে। প্রকল্পটিকে সময়-টাকাখেকো প্রকল্প বলা হয়। শুরুতে নিম্নমানের পাথর ও সাগরের লবণাক্ত বালু ব্যবহার এবং বাঁধ নির্মাণে বালুমিশ্রিত মাটি ব্যবহারের অভিযোগ ছিল। বছর-দুই বছর না পেরোতেই বাঁধের বিভিন্ন স্থান দেবে গেছে। অন্তত ১০টি স্থানে ভয়াবহ ভাঙন ধরেছে।

 

খানখানাবাদের নুরুল হামিদ, কদমরসুলের সামশুল আলম, সাজেদুর রহমান, বোরহান উদ্দিনসহ অন্তত ১০ জন লোক দাবি করেন, ‘বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে হরিলুট হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব ছিল। দুই বছর না যেতেই বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙন ধরেছে।’

 

বাঁশখালীর বাঁধ নির্মাণে আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে টেন্ডার ও কাজের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এলাকাবাসীর।

 

অনিয়ম ধরা পড়ে পাউবোর তদন্তে: বাঁশখালীর বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে ২০২০ সালে তিন সদস্যের ঊচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। অনিয়ম ও নিম্নমানের কাজের প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। কাজের মান খারাপ ও অতিরিক্ত বিল প্রদানের প্রমাণও উঠে আসে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক জুলফিকার তারেক উল্টো পদোন্নতি পেয়েছেন। বর্তমান চলমান প্রকল্পেরও পরিচালক তিনি।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা ও বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক বলেন, ‘কম টাকায় বেশি কাজ করতে হয়েছে। তাই বাঁধ টেকসই হয়নি।’ বর্তমান প্রকল্পে বাজেট বেশি। কাজ ভালো হবে বলে জানান তিনি।

 

সাঙ্গুর ভাঙনেও বাড়ছে উদ্বাস্তু: সাঙ্গু তীরঘেঁষা এলাকা সাধনপুর ও পুকুরিয়া ইউনিয়নের কৈবর্ত্যপাড়া, তেচ্ছিপাড়া, রাতাখুর্দ্ব, বরুমছড়া এলাকায় তীব্র ভাঙন হচ্ছে। স্থানীয় নয়ন জলদাস, রাহুল জলদাস বলেন, ‘৯১ সালের পর থেকে তেচ্ছিপাড়ায় অন্তত ৪০ ঘর, রাতাখুর্ব্দ এলাকায় দেড় শ ঘর, কৈবর্ত্যপাড়ায় ৫০-৬০ ঘর, বরুমনছড়ায় ৫০ ঘর বিলীন হয়ে গেছে। উদ্বাস্তু হওয়া অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন পাহাড়ের পাদদেশে, আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা অন্য কোথাও।

 

জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম: বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে চরম ঝুঁকির কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আর্থ, এটমোস্ফিয়ারিক এবং প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের একদল গবেষক। গত ১১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ান আর্থ নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

 

গবেষণায় বলায় হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। দেশের মধ্যে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রামের উত্তর অংশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন-সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন তীব্র ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাত বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির দিক প্রকট হয়েছে।

 

উপকূলীয় বাঁধ: ১৯৬০ সালে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাঁশখালী, আনোয়ারা ও স›দ্বীপে ১০২ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে অধিকাংশ এলাকা লণ্ডভণ্ড ও বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৮ সালে নারগিস, ২০০৯ সালের আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়ে অনেক জায়গায় বাঁধ বিলীন হয়ে গেছে।

 

ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯৯২ সালে ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁশখালীতে বিধ্বস্ত বাঁধের সংস্কার করা হয়। সরল, ছনুয়া, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, সাধনপুর, গণ্ডামারা এলাকায় সংস্কার করা হয়। ১৯৯৬ সালে ঘূর্ণিঝড়ে তা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এরপর কয়েক ধাপে অন্তত আরও ১৫ কোটি টাকার সংস্কার করা হয়। এসব সংস্কার যেন পানির টাকা অনেকটা জলে গেছে।

 

পানির প্রকল্পে ১৬ খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়: ২০২৪ সালের ২৭ মে একনেক সভায় কর্ণফুলী নদীর বোয়ালখালী এবং বঙ্গোপসাগর ও সাঙ্গুর তীর প্রতিরক্ষা-বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। ‘দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলায় টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)’ নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৮৭৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আর ‘বোয়ালখালী উপজেলার কর্ণফুলী নদী ও সংযুক্ত খালের ভাঙনরোধকল্পে তীর সংরক্ষণ’ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৪ কোটি নয় লাখ টাকা। বর্তমানে প্রকল্প দুটির কাজ চলছে।

 

প্রকল্প দুটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাঁধ নির্মাণ ও তীর সংরক্ষণে মূল ব্যয় ছাড়া আরও ১৬ খাতে ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আনোয়ারা ও বাঁশখালী প্রকল্পে মুদ্রণ-বাঁধাই, স্ট্যাম্প-সিল কেনা, প্রচার-বিজ্ঞাপন, সম্মানী ভাতা, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ, পেট্রোল-অয়েল ও লুব্রিকেন্ট কেনা এবং অফিস সংস্কার ও আসবাব সরঞ্জাম কেনাকাটাসহ ১৬ খাতে তিন কোটি ৫৫ লাখ টাকার ব্যয় ধরা হয়েছে। এরমধ্যে মুদ্রণ ও বাঁধাই, স্ট্যাম্প ও সিল কেনা, প্রচারে ব্যয় ধরা হয় ১০ লাখ টাকা করে ৩০ লাখ টাকা।

 

সম্মানী ভাতা ও ভ্রমণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। গাড়ি-কম্পিউটার-অফিস সরঞ্জাম, ক্যামেরা ও আসবাবপত্র কেনাকাটায় ধরা হয়েছে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাঁধের টাকা দিয়ে আবাসিক ভবন (কর্মচারীদের কলোনি) মেরামতে ব্যয় ধরা হয় ৫০ লাখ টাকা।

 

বাঁধের টাকা অপ্রয়োজনীয় ও অন্য খাতে ব্যয়ের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর-১) শওকত ইবনে সাহীদ পূর্বকোণকে বলেন, ‘একটি প্রকল্প যদি ৫-৭ বছর চলমান থাকে ততদিন যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জামগুলো টেকে না। তাই প্রতি প্রকল্পে বরাদ্দ ধরা হয়।’ তিনি দাবি করেন, ‘অন্য দপ্তরের তুলনায় পাউবোতে সবচেয়ে কম ( প্রায় দেড় শতাংশ) বরাদ্দ ধরা হয়।’

 

বোয়ালখালীতে কর্ণফুলী নদীর ভাঙনরোধ প্রকল্পে এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ৫ লাখ। এ বিষয়ে রাঙামাটি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা বলেন, ‘অতিরিক্ত ব্যবহারের চাপে কম্পিউটারগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। তাই নতুন নতুন কম্পিউটার ও ল্যাপটপ কিনতে হয়।’

 

এত সরঞ্জাম যায় কোথায়: পটিয়ায় দুটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পওর-১) বিভাগ। এছাড়াও আনোয়ারা, লোহাগাড়া উপজেলায় একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এই বিভাগ। ১১৫৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পের ডিপিপি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সম্মানী ভাতা, ভ্রমণ ব্যয়, পেট্রোল-লুব্রিকেট, মুদ্রণ-প্রকাশন, মোটরযান, কম্পিউটার ও অফিস সরঞ্জাম মেরামত, মোটরযান ক্রয়, কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ কেনা, আইপিএস কেনা ও অন্য খাতে কেনাকাটায় এক কোটি ১২ লাখ ৩০ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়।

 

একই বিভাগ একই এলাকায় বাস্তবায়ন করছে ১৩৩ কোটি ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে হাইড্রোলিক ড্যাম নির্মাণ প্রকল্প। এই প্রকল্পেও বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় খাতে এক কোটি ২৩ লাখ ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্প দুটি চলছে কচ্ছপগতিতে। প্রকল্প পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক এ প্রকল্পের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দুবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।

 

বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে প্রকৌশলী জুলফিকার তারেক বলেন, ‘ড্যামে চীনের নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে। ডিজাইন ও টেকনোলজি দেখার জন্য মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের টিম চায়না সফরে গিয়েছিলেন।’

 

পটিয়ার এই দুটি প্রকল্প ছাড়া সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলার ডলু এবং শঙ্খ নদের ভাঙন প্রতিরক্ষায় ১৬৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪১ হাজার টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২১৪ কোটি ৮৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। এ প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় খাতে দুই দফায় দুই কোটি ৫৪ লাখ টাকার ব্যয় ধরা হয়। এছাড়া ফটোকপিয়ার, মাল্টিমিডিয়া যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ব্যয় ধরা হয় ৪৩ লাখ ৭ হাজার টাকা।

 

একই বিভাগ নগরের আকবর শাহ থেকে লতিফপুর কালীর ছড়া খাল পুনরুজ্জীবিতকরণ প্রকল্প নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২১৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকার প্রস্তাবিত প্রকল্পেও দুই কোটি ২১ লাখ টাকার অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে। এই প্রকল্পে অফিস ভবন নির্মাণে ৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, ‘প্রকল্পে ব্যয় ধরা থাকলেও ব্যয় করা না হলে টাকা সরকারি কোষাগারে জমা থাকে। পুরোনো গাড়ি সংস্কার করে চলতে হয়।’

 

২০১৬ সালে পতেঙ্গা, পটিয়া ও আনোয়ারায় ২৮০ কোটি ৩০ লাখ টাকার প্রকল্প নেয়া হয়। ২০১৮ সালে ব্যয় দাঁড়ায় ৩২০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০২২ সালে ৫৭৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি শেষ হয়। এ প্রকল্পে প্রায় আড়াই কোটি টাকা অন্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।

 

পানির টাকায় ভবন-অফিস সজ্জা: বহদ্দারহাট পানি ভবনে দেখা যায়, তিনতলা ভবনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, তিন নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরসহ প্রতি তলায় বড় ধরনের সাজ-সজ্জার কাজ চলছে। একজন নির্বাহী প্রকৌশলীর নেতৃত্ব ২০-২৫ লাখ টাকার সংস্কার ও কেনাকাটা করা হয়েছে।

 

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী স্বপন কুমার বড়ুয়া পূর্বকোণকে বলেন, ‘ভবন-কার্যালয় ও অফিস মেরামত বা সংস্কারের জন্য কম বাজেট দেওয়া হয়। প্রকল্পে বাজেট ধরা থাকলে কাজ করতে ভালো হয়।’

 

সব প্রকল্পে একই খাতে ব্যয়: ২০২৪ সালে কর্ণফুলী ভাঙনরোধে ১৩৪ কোটি নয় লাখ টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রাঙামাটি বিভাগ। একই বিভাগ ২০১৮ সালে প্রায় তিন শ ৯৮ কোটি ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তীর সংরক্ষণ, প্রতিরক্ষা বাঁধ ও ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০২৪ সালের ৩ জানুয়ারি ডিপিইসি সভার পর্যালোচনায় বলা হয়, মূল ডিপিপি থেকে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ ব্যয় বেড়ে প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় তিন শ ৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রকল্পে বিচ্চুতির ফাঁদে পড়েছে ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। প্রকল্পে ইছামতি নদীর ড্রেজিং নিয়ে ভুল নকশা ছিল পাউবোর। ইছামতি ড্রেজিং করা যায়নি। পরে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩৫ কোটি ৭৪ লাখ ৪১ হাজার টাকা। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ‘ইচ্ছেপূরণ’ প্রকল্পটির ঠিকাদার নিয়োগ ও কাজে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

 

প্রকল্পটিতে দেখা যায়, জ্বালানি ও লুব্রিকেন্ট কেনায় ধরা হয় ১০ লাখ টাকা, মুদ্রণ ও প্রকাশনায় ৪ লাখ, স্টেশনারি, সিল ও স্ট্যাম্পের জন্য ৪ লাখ, এক্সপ্রোজার ভিজিট এক কোটি ২০ লাখ টাকা, সম্মানী ভাতা বা পারিশ্রমিক ১০ লাখ, সম্মানী ভাতা (মধ্যবর্তী মূল্যায়ন) ৫ লাখ, প্রচার-বিজ্ঞাপন ৫ লাখ, ভ্রমণভাতা ৭ লাখ, জরিপ ও অনুসন্ধান ১৫ লাখ, মোটরযান মেরামত ও সংরক্ষণ ১৫ লাখ, মোটরযান কেনা (১২৫ সিসির দুটি মোটর সাইকেল) ৩ লাখ, কম্পিউটার ও যন্ত্রণাংশ কেনাকাটা ৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের ডিপিপিতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ধরা হয় এক কোটি ৫৭ লাখ টাকা। পরে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ায় অপ্রয়োজনীয় খাতেও ব্যয় বেড়ে হয় দুই কোটি টাকার বেশি।

 

প্রতি প্রকল্পে কম্পিউটার, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, গাড়ি কেনা-মেরামতের বিষয়ে রাঙামাটি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা বলেন, ‘আমরা কম্পিউটার কিনেছি দুই বছর হয়েছে। এবার ড্রোন কেনা হয়েছে।’

 

সন্দ্বীপ বিভাগেও একই চিত্র: ভোগৌলিক অবস্থানগত কারণে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রথম আঘাত হানে সাগরঘেরা সন্দ্বীপে। ৫৬ কিলোমিটার উপকূলীয় এ জনপদের প্রধান সমস্যা সাগরের তীব্র ভাঙন। ২০২২ সালে ১৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯ দশমিক ৮ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়।

 

বছর না যেতেই ঝুঁকিপূর্ণ: ২০১৯ সালে সন্দ্বীপে ২০৫ কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণ, ব্লক বসানো ও সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। মগধরার পূর্ব থেকে সারিকাইতের সওদাগরহাট হয়ে কালিরদোনা বাংলা বাজার থেকে পশ্চিমে দুরখাল পর্যন্ত সাগর পাড়ের বাঁধ সংস্কার, ব্লক ও বাঁধ নির্মাণ করা হয়।

 

২০২৩ সালের ১৮ জুলাই ‘চট্টগ্রাম জেলার স›দ্বীপ উপজেলাস্থ পোল্ডার নং-৭২ এর ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের স্থায়ী পুনর্বাসনসহ ঢাল সংরক্ষণ’ নামে ৫৬২ কোটি ২১ লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের বেশির ভাগ কাজ পেয়েছে আওয়ামী লীগ ঘরানার ঠিকাদার। ৫ আগস্টের পর ক্ষমতার পট পরিবতর্নের পর ঠিকাদাররা আত্মগোপনে চলে যায়। ফলে বর্তমানে প্রকল্পটি চলছে শম্ভুকগতিতে।

 

সাড়ে ১৩শ কোটি টাকার প্রকল্প: সন্দ্বীপে বাঁধ ও সীতাকুণ্ড-ফেরিঘাট নির্মাণে প্রায় ১৩শ ৬২ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রকল্প দুটি ডিপিপি পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর-২) ড. তানজির আহমেদ সাইফ।

 

প্রতি প্রকল্পে একই ধরনের ব্যয় বরাদ্দের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক বলেন, ‘কেনাকাটা করেন নির্বাহী প্রকৌশলীরা। তবে নতুন মডেলের সফটওয়্যার ও কম্পিউটার কিনতে হয়।

 

হরিলুট বলল সুজন: জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক এডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, ‘একটি প্রকল্পে এই ধরনের ব্যয় ধরা হলে ঠিক আছে। কিন্তু একাধিক প্রকল্পে যখন একই ধরনের ব্যয় ধরা হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে। এত কম্পিউটার ও যন্ত্রপাতি যায় কোথায় ? জনগণের টাকায় নেওয়া প্রকল্প জনকল্যাণে সঠিকভাবে ব্যয় করতে হবে।’

 

ব্যয় বাড়ছে প্রকল্পে: পাউবোর নথি ঘেঁষে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বাঁধ নির্মাণে ব্যয় বাড়ছে। ২০১৭ সালে জানুয়ারিতে বাঁধ নির্মাণে প্রতিমিটারে খরচ ধরা হয়েছিল দুই দশমিক ৩৩ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে চলমান প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ছয় দশমিক ৬০ লাখ টাকা। ২০২২ সালে ধরা হয়েছে সাত দশমিক ৪৬ লাখ টাকা। ৫ বছরের ব্যবধানে বাঁধ নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ।

 

দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় কী: এমআইটির গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এখন একটি পূর্ণাঙ্গ ঝুঁকিভিত্তিক পরিকল্পনা দরকার। বর্তমানে যেসব অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ হচ্ছে, তার ভিত্তি অনেকটা ঐতিহাসিক জলবায়ু তথ্যের উপর। ভবিষ্যতের দুর্যোগ পুনরাবৃত্তির ধরণ অনুযায়ী নকশা, নীতিমালা ও আর্থিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক বলেন, ‘টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েই প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ব্লকের আকার বড় হচ্ছে।’

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট