চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

সেবাদানে মনযোগ নেই, পড়ে আছে ‘বিলাসী ভবন’

সেবাদানে মনযোগ নেই, পড়ে আছে ‘বিলাসী ভবন’

ইমাম হোসাইন রাজু

১৭ অক্টোবর, ২০২৫ | ৫:৪৮ অপরাহ্ণ

সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামের তিন উপজেলায় মহাসড়কের পাশে তিনটি ট্রমা সেন্টার স্থাপন করে সরকার। অথচ চট্টগ্রামের তিন উপজেলা, লোহাগাড়া, হাটহাজারী ও রাউজানে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তিনটি ট্রমা সেন্টার দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু  বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত একটিও পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হয়নি।

 

সরেজমিনে দেখা গেছে, তিন ট্রমা সেন্টারের চিত্র তিন রকম। এরমধ্যে সম্প্রতি লোহাগাড়া সেন্টারে আংশিক সেবা দিয়ে চললেও বাকি দুটি সেন্টারের গেটে এখানো ঝুলছে তালা। অনেকটাই নীরব ভবন দাঁড়িয়ে আছে, নেই রোগী, নেই সেবাও। যার দরুণ- এখনো মহাসড়কে ছোট-বড় দুর্ঘটনা প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে জীবন। আহতরা ছুটে যায় দূরের হাসপাতালগুলোতে, অনেকের প্রাণ যায় হাসপাতালে পৌঁছার আগেই।

 

যদিও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, খুব শীঘ্রই লোহাগাড়ার মতো হাটহাজারীতে নির্মিত সেন্টারটি চালু করা হবে। আর রাউজানের সেন্টারটিও চালু করতে তোড়জোড় করছেন তাঁরা।

 

এদিকে, চট্টগ্রামের এই তিন মহাসড়ক চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-রাউজান ও চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কগুলো দুর্ঘটনাপ্রবণ। ট্রমা সেন্টার থাকলেও কার্যকরী চিকিৎসা না থাকায় আহতদের শহরেই যেতে বাধ্য হয়। দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকের জীবন প্রদীপ পথেই নিভে যায়।

 

লোহাগাড়ায় ১৩ বছর পর চালু, তাও আংশিক : চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় ২০০৭ সালে নির্মাণ শুরু হয় ২০ শয্যার ট্রমা সেন্টারের। ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় ২০১২ সালে তিনতলা ভবন শেষ হয় এবং ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট উদ্বোধন হয়। কিন্তু দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে সেন্টারটি কার্যকর হয়নি। অবশেষে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে পুনঃসংস্কারের পর সীমিত পরিসরে চিকিৎসা সেবা শুরু হয়। বর্তমানে সেন্টারটিতে ৬ জন চিকিৎসক ও ১৩ জন কর্মচারী নিয়ে ২৪ ঘণ্টা বহির্বিভাগ চালু রয়েছে। তবে অন্তঃবিভাগ এখনও বন্ধ।

 

স্থানীয়রা বলেন, দুর্ঘটনার শিকাররা এখনো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যায়।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. ইকবাল হোছাইন বলেন, এটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে শুরু হয়েছে এবং শিগগিরই পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

হাটহাজারীতে কোটি টাকার ভবন, তালাবদ্ধ দরজা : হাটহাজারীতে পরিস্থিতি আরও করুণ। ৩৭ শতক জমিতে নির্মিত ২০ শয্যার ট্রমা সেন্টারের ভবন দৃষ্টিনন্দন হলেও ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল উদ্বোধনের পর থেকে সেবা নেই। চার তলা ডাক্তারদের ডরমিটরি, পাঁচ তলা নার্সদের ডরমিটরি, পার্কিং, জেনারেটর রুম- সবই প্রস্তুত। কিন্তু গেটে তালা ঝুলছে, ভবন নীরব।

 

স্থানীয়রা জানান, সড়কে প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু  আশপাশে চিকিৎসা দেয়ার মতো ভালো কোন হাসপাতাল নেই। এত টাকা ব্যয়ে ট্রমা সেন্টার তৈরি করলেও কোন কাজেই আসছে না। দুর্ঘটনা ঘটলে আহতদের চট্টগ্রাম শহরে নিতে এক ঘণ্টা সময় লাগে, অনেক মারা যায় রক্তক্ষরণে।

 

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তাপস কান্তি মজুমদার বলেন, জনবল নিয়োগের সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, তবে এখনও কার্যকর হয়নি।

 

রাউজানে দৃষ্টিনন্দন ভবন, কিন্তু  প্রাণহীন : রাউজানেও একই অবস্থা। প্রায় ১২ কোটি টাকায় নির্মিত ট্রমা সেন্টার উদ্বোধন হয় ২০২৩ সালে। কিন্তু‘ তিন বছর পরও বন্ধ। ভবনের দেয়ালে লেখা আছে উদ্বোধনের তারিখ, ভিতরে আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ, জেনারেটর, পার্কিং গ্যারেজ, তবু সেবা নেই। ইতোমধ্যে কিছু ফ্যান চুরি হয়ে গেছে, জেনারেটর চুরি চেষ্টাও হয়েছে বলে জানা গেছে।

 

স্থানীয়রা জানান, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়কে প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু‘ আহতদের তাৎক্ষণিক সেবা দেওয়ার মতো প্রতিষ্ঠান রাউজানে নেই। স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ করিম বলেন, ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবন বানানো হলো, অথচ দরজায় তালা ঝুলছে। দুর্ঘটনায় আহতদের চট্টগ্রাম শহরে নিতে সময় লাগে। ততক্ষণে অনেকে মারা যান।

 

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. শাহজাহান বলেন, ট্রমা সেন্টারটি চালু করতে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু ‘কিছু জটিলতা এবং জনবল নিয়োগ না হওয়ায় দেরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে সেন্টার চালু করতে ৩৬ জনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে।

 

পাইলট প্রকল্প গ্রহণ, যা বলছে স্বাস্থ্য বিভাগ : দীর্ঘ সময় নিষ্ক্রিয় থাকার পর ট্রমা সেন্টারগুলো বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সচল করার চূড়ান্ত উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। ইতোমধ্যে পাইলট প্রকল্প হিসেবে লোহাগাড়া ট্রমা সেন্টারটি চালু করা হয়েছে। এরপর ধাপে ধাপে সচল হবে হাটহাজারীর কেন্দ্রও। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, হাটহাজারী ও রাউজান ট্রমা সেন্টারের অবকাঠামো সম্পূর্ণ তৈরি, কিন্তু ‘ জনবল ও ব্যবস্থাপনা ছাড়া এগুলো কার্যকরী নয়। আমরা দ্রুত চালু করার চেষ্টা করছি এবং আশা করি খুব শিগগির সেবা শুরু হবে।

 

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লোহাগাড়া ট্রমা সেন্টারটি শুরু হয়েছে। আমরা চাই দ্রুত জনবল বৃদ্ধি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সম্পূর্ণভাবে চালু হোক, যাতে দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত সেবা দেওয়া যায়।

 

বিশিষ্টজনের মত : সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি এডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামের এই তিন ট্রমা সেন্টারের বাস্তব অবস্থা স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে, সরকারি অবকাঠামোর ব্যয় কোটি কোটি টাকা হলেও মানুষের জন্য কার্যকরী সেবা নেই। এত কোটি টাকার বিনিয়োগ যদি মানুষের কাজে না আসে, তাহলে এর মানে কী? ট্রমা সেন্টারের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ‘গোল্ডেন আওয়ারে’ জীবন রক্ষা করা। সেগুলো যদি জনবল বা জরুরি সেবাহীন থাকে, তাহলে পুরো প্রকল্পের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

 

পূর্বকোণ/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট