
গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘২০দফা শান্তি পরিকল্পনা’র প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে ইসরায়েল ও হামাস সম্মত হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। মিশরের শারম আল-শেখে গাজাযুদ্ধ বন্ধে সবপক্ষকে নিয়ে মধ্যস্থতাকারীদের তৃতীয় আলোচনায় এই সমঝোতা হয়। এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, তারা এমন এক ‘চুক্তি সম্পন্ন করেছে, যাতে গাজায় যুদ্ধের অবসান, দখলদার বাহিনীর প্রত্যাহার, মানবিক সহায়তা প্রবেশ এবং বন্দি বিনিময়ে’র বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন দিয়েছে। প্রথম ধাপের চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গাজায় দুই বছরব্যাপী চলমান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসানের পথে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি ও বন্দি বিনিময় করবে ইসরায়েল-হামাস। তবে শান্তিপরিকল্পনার সব দফা নিয়ে এখনও দুইপক্ষ সমঝোতায় পৌঁছায়নি। বিশেষ করে গাজায় যুদ্ধ-পরবর্তী প্রশাসন, হামাসের অস্ত্র সমর্পণ ও ভবিষ্যৎ এবং গাজা থেকে পুরোপুরি ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা নিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি।
দুইবছর ধরে চলা গাজাযুদ্ধে এই অগ্রগতি অনেকের কাছে বড়ধরনের সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, গাজাযুদ্ধে ইসরায়েল অন্তত ৬৭ হাজার ১৬০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ইসরায়েলি হামলায় আহত হয়েছেন এক লাখ ৬৯ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। নিহত ও আহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অসংখ্য মরদেহ চাপা পড়ে আছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ও ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা বলেছে, ইসরায়েল গাজার হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন এলাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। ৯০ শতাংশ ভবন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজা পুনর্গঠনের জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হবে। আর পুরো উপত্যকাকে পুনরায় বাসযোগ্য করতে কমপক্ষে ১৫ বছর সময় লাগতে পারে। আবার হামাস এখনও ট্রাম্পের প্রস্তাবিত অস্ত্র পরিত্যাগের শর্ত মেনে নেয়নি। সশস্ত্র গোষ্ঠীটির দাবি, যতক্ষণ ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে সরে না যাবে, ততক্ষণ তারা অস্ত্র ছাড়বে না। এছাড়া গাজা থেকে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহার নিয়ে স্পষ্ট সময়সীমা ও কার্যকর নিশ্চয়তার দাবিও জানান হামাসের শীর্ষ নেতারা। এদিকে ট্রাপ প্রস্তাবিত শান্তিপরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপে গাজার পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার নেতৃত্বে নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের কথা বলা হয়েছে। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার অন্তর্বর্তী ওই প্রশাসনের নেতৃত্ব দেবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। হামাস এ শর্তেও বিরোধিতা করেছে। তাদের বক্তব্য- ‘কেবল একটি ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাট সরকারই গাজা পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারে। এতে কাদের ওপর শাসনভার থাকবে তা আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সমর্থনে নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। তবে ফিলিস্তিনিদের বাইরে কাউকে গাজায় শাসন করতে দেওয়া হবে না।’ এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েল যুদ্ধ শেষ করলেও গাজা উপত্যকা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
কে জিতেছে এই যুদ্ধে- এমন প্রশ্নের উত্তরও জটিল। ইসরায়েল সামরিক দিক থেকে স্পষ্টতই শ্রেষ্ঠ। আবার তাদের পেছনে ছিল ও এখনো আছে বিশ^পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা মিত্ররা। তাদের বোমাবর্ষণে গাজার অর্ধেকের বেশি অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে, হাজারো হামাস যোদ্ধা নিহত হয়েছে, এবং তাদের টানেল নেটওয়ার্ক প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ইসরায়েলি বাহিনী গাজার উত্তরাঞ্চল ও সীমান্তের বৃহৎ অংশ দখল করে নিয়ে হামাসের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিন্ন করে দিয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে এটি ইসরায়েলের একধরনের সামরিক সাফল্য। তবে বিজয় বলতে যদি বোঝানো হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ- তাহলে ইসরায়েল সেই বিজয় থেকে অনেক দূরে। কারণ তারা হামাসকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি, বরং যুদ্ধের শেষে হামাস আবারো আলোচনার টেবিলে ফিরে এসেছে একটি রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে। হামাস এখনো গাজার কেন্দ্রে সক্রিয়, তাদের ছত্রছায়ায় জনগণের একটি অংশ প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে সংগঠিত রয়েছে। তাই বলা যায়, ইসরায়েল সামরিকভাবে কিছুটা এগিয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এই যুদ্ধের পূর্ণ বিজয় অর্জন করতে পারেনি।
অন্যদিকে হামাসের অবস্থান যুদ্ধপরবর্তী দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন। তারা ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে, প্রায় সত্তর হাজার ফিলিস্তিনি নিহত, লাখো মানুষ গৃহহীন, হাসপাতাল ধ্বংস, স্কুল থেকে শুরু করে সবকিছুই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তবে হামাস টিকে গেছে, এবং এটাই তাদের জন্য একটি প্রতীকী বিজয়। তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মানসিক শক্তি প্রদর্শন করেছে। ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল হামাসের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি- যা তারা করতে পারেনি। হামাসের কিছু নেতাকে হত্যা করতে পারলেও অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা এখনো সক্রিয়, এবং তারা কাতার-মিশর মধ্যস্থতায় আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। তাই অনেক বিশ্লেষক বলছেন, যুদ্ধের বিজয় নয়, বরং টিকে থাকা ও আলোচনায় ফিরে আসাই হামাসের ‘কৌশলগত জয়’।
গাজা কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেটিই এখন এই যুদ্ধবিরতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাইছে গাজায় একটি ‘অন্তর্বর্তী প্রশাসন’ গঠন করা হোক, যা আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে চলবে। মিশর ও কাতার এতে সহমত, কারণ তারা চায় না হামাস পুনরায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসুক। অন্যদিকে হামাসের অবস্থান স্পষ্ট, তারা কোনো বিদেশি তত্ত্বাবধান মেনে নেবে না এবং গাজার প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের হাতেই থাকতে হবে। এমন অবস্থায় গাজা দুই অংশে বিভক্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একটি অংশ হামাসের প্রভাবাধীন, অন্যটি আন্তর্জাতিক বা ফাতাহ প্রশাসনের অধীনে। ইতিমধ্যেই আলোচনায় আছে, জাতিসংঘ বা আরব লীগের যৌথ বাহিনী দক্ষিণ গাজায় নিরাপত্তা তত্ত্বাবধান করতে পারে, যাতে পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তা নির্বিঘ্ন হয়। তবে হামাস এটিকে ‘নতুন দখলদারিত্বের রূপ’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করছে।
ইসরায়েলও গাজার পুরো নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চায় না। তাদের নিরাপত্তা পরামর্শক বোর্ডের সুপারিশে বলা হয়েছে, গাজার উত্তর ও পূর্ব অংশে একটি ‘সীমান্ত সুরক্ষা বাফার জোন’ রাখা হবে, যেখানে ইসরায়েলি সেনারা টহল দেবে এবং যেকোনো সামরিক পুনর্গঠন রোধ করবে। এতে কার্যত গাজার প্রায় ১৫ শতাংশ এলাকা ইসরায়েলের নজরদারিতে থেকে যাবে। অন্যদিকে হামাস এ অংশে পুনর্গঠন করতে পারবে না, কারণ তাতে চুক্তি ভঙ্গের আশঙ্কা থাকবে। অর্থাৎ গাজা এখন এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ভূখণ্ডটি সাময়িকভাবে তিনভাগে বিভক্ত- হামাস নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় এলাকা, আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে দক্ষিণাঞ্চল, এবং ইসরায়েলি বাফার জোনে সীমান্ত অঞ্চল। এটি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে গাজা বাস্তবিক অর্থে ‘আধা-স্বাধীন’ ভূখণ্ডে পরিণত হবে, যেখানে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বিভক্ত থাকবে একাধিক শক্তির হাতে।
গাজাযুদ্ধবিরতির পর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রশ্নও নতুন করে সামনে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ওয়াশিংটন স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা দুই-রাষ্ট্র সমাধানকে পুনরায় আলোচনায় আনতে চায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, স্পেন, আয়ারল্যান্ড ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও এর পক্ষে ভোট বেড়েছে। কাতার ও সৌদি আরব বলেছে, যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিশ্চিত হলে তারা ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা’র জন্য কূটনৈতিক চাপ বাড়াবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পথে এখনো অন্তত পাঁচটি বড় প্রতিবন্ধকতা আছে।
প্রথমত, ইসরায়েল রাষ্ট্রের বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামো দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে নয়। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধের পর ঘোষণা দিয়েছেন- ইসরায়েল কখনোই গাজায় ‘শত্রুরাষ্ট্র’ গঠনের অনুমতি দেবে না। তার ডানপন্থী জোট এই অবস্থান আরও কঠোর করেছে। দ্বিতীয়ত, ফাতাহ ও হামাসের রাজনৈতিক ঐক্য এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পশ্চিমতীর ও গাজার নেতৃত্ব বিভক্ত, আর এই বিভাজনেই বারবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তৃতীয়ত, রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজন প্রশাসনিক দক্ষতা, নিরাপত্তাবাহিনী, অর্থনৈতিক অবকাঠামো- যা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। চতুর্থত, আন্তর্জাতিক সাহায্যদাতা দেশগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থ ভিন্ন। কেউ ফিলিস্তিনকে অর্থ দেবে, কিন্তু তারা চায় না সেটি হামাসের হাতে যাক। ফলে সাহায্য আসবে, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে। আর পঞ্চমত, আরববিশ্বের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাও ফিলিস্তিন প্রশ্নে একমুখী অবস্থান নিতে বাধা সৃষ্টি করছে। সৌদি আরব, মিশর, কাতার- তিন দেশের মধ্যেই ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
তবু একে সম্পূর্ণ হতাশার ছবি বলা যায় না। যুদ্ধবিরতির পর যদি গাজায় কার্যকর প্রশাসন গড়ে তোলা যায়, মানবিক পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হয় এবং হামাস-ফাতাহ সমঝোতা তৈরি হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পথ ধীরে ধীরে খুলতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ২০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে একটি ‘সীমিত সার্বভৌমত্বের ফিলিস্তিন রাষ্ট্র’ গঠনের রূপরেখা তৈরি করা সম্ভব, যদি ইসরায়েল নিরাপত্তা গ্যারান্টি পায় এবং পশ্চিমতীরের কিছু এলাকার বিনিময়ে ফিলিস্তিনকে হস্তান্তর করা হয়। এটি অনেকটা ‘অসলো-২ চুক্তির’ নতুন রূপ হতে পারে, যেখানে দুটি পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল একীভূত হয়ে ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামো গঠন করবে।
তবে ইসরায়েলের দখলে থাকা ভূমির ভবিষ্যৎ এখানেই সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ইসরায়েল পশ্চিম তীরের প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমি কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছে, যেখানে ইহুদিবসতি স্থাপন অব্যাহত। এই দখলীকৃত ভূমি যদি ফিরিয়ে না দেওয়া হয়, তবে ফিলিস্তিনরাষ্ট্র বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী, ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের সীমারেখাভিত্তিক ভূখণ্ডই হবে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমানা। কিন্তু ইসরায়েল তা মানতে প্রস্তুত নয়। তারা ‘নিরাপত্তার অজুহাত’ দেখিয়ে কিছু অঞ্চল নিজেদের কাছে রাখতে চায়। বিশেষ করে জর্ডান ভ্যালি ও জেরুজালেম সংলগ্ন বসতিগুলো। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ইসরায়েল হয়তো কিছু ভূমি বিনিময়ের প্রস্তাব দেবে। অর্থাৎ পশ্চিম তীরের কিছু অংশ রেখে গাজায় সমান পরিমাণ এলাকা হস্তান্তর করবে। কিন্তু হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ উভয়েই একে প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ এতে দখলদারিত্ব স্থায়ী হয়ে যাবে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের উদয় তাই এখনো সম্ভাবনা ও আশঙ্কার দ্বিধায় ঝুলে আছে। বিশ্বব্যাপী জনমত ক্রমেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, বিশেষত ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকায়। কিন্তু রাষ্ট্র গঠন শুধু জনমত দিয়ে হয় না; প্রয়োজন স্থলবাস্তবতা ও রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি। ফিলিস্তিনের পরবর্তী নেতৃত্ব যদি পুনর্গঠিত প্রশাসন ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি দেখাতে পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে সময় লাগবে না। এই যুদ্ধবিরতি তাই এক দ্বৈত বাস্তবতার সূচনা করেছে। একদিকে এটি যুদ্ধ ক্লান্ত জনগণের জন্য একটি নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় এনে দিয়েছে; অন্যদিকে এটি এমন এক অনিশ্চয়তার পর্বের সূচনা, যেখানে যে কোনো ভুল পদক্ষেপ আবারও রক্তপাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ইসরায়েল তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইবে, হামাস তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করতে চাইবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্থিতিশীলতা চায়- কিন্তু এই তিনটির সমন্বয় করা প্রায় অসম্ভব। তবে ইসরায়েলকে বুঝতে হবে শক্তি দিয়ে নয়, কূটনীতি দিয়েই স্থায়ী নিরাপত্তা আসে। যদি ইসরায়েল তা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়, বিশ^সম্প্রদায়ও নীরব থাকে এবং ফিলিস্তিনি ও আরব নেতৃত্বের বিভাজন জিঁইয়ে থাকে- তাহলে গাজা আবারও পরিণত হবে এক অনন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে, যা কারো জন্য মঙ্গলকর হবে না।
ইতিহাস বলছে, প্রতিটি যুদ্ধবিরতি একদিন কোনো না কোনো শান্তিচুক্তির ভিত্তি তৈরি করে- যদি মানবতা জেগে ওঠে, যদি ন্যায়বিচার অগ্রাধিকার পায়। তাই আজ যে গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতা থেমেছে, জনমানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস নেমে এসেছে, ক্ষুধাপীড়িত ও পঙ্গুত্ব বরণকারী শিশুরা নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছে, তার স্থায়িত্ব দিতে বিশ^সম্প্রদায়সহ সবপক্ষকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আর এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক নতুন ভোরের সম্ভাবনা, বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে কাক্সিক্ষত স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের উত্থান।
পূর্বকোণ/পিআর