
বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার বিস্তার দিন দিন বাড়ছে। গ্লোবাল অবসারভেটরী ফর ক্যানসার এর তথ্য মতে, ২০২২ সালে আনুমানিক ১৩ হাজার মহিলা বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার এ আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারনা করা হয়। বাংলাদেশে মোট ক্যানসার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১,৬৭,২৫৬ জন এবং ক্যানসারজনিত মৃত্যু প্রায় ১,১৬,৫৯৮ জন। ক্যানসারের মোট আক্রান্তের হার হচ্ছে ১০৫.৬/ ১,০০,০০০ জন প্রতিবছর। ক্যানসারের মোট মৃত্যুহার ৭৪.৭/ ১,০০,০০০ জন প্রতি বছর। ২০২৫ সালের একটি সাম্প্রতিক নিবন্ধ অনুযায়ী বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের হার প্রায় ২২.৫/ ১,০০,০০০ নারী। বাংলাদেশে নারীদের ক্যানসার মৃত্যুর মধ্যে স্তন ক্যানসার দায়ী প্রায়৬৯%। GLOBOCAN এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৩ লাখ নতুন স্তন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং প্রায় ৬,৬৬,০০০ মৃত্যু ঘটেছে। মোট কথা সারা বিশ্বব্যাপী মহিলাদের স্তন ক্যানসার এ আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
GLOBOCAN ২০২২ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে স্তন ক্যান্সার উভয় লিঙ্গের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত ম্যালিগন্যান্সি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যায় তৃতীয় স্থানে (১,৯২,০২০টি ঘটনা) থাকলেও, মৃত্যুহারের ক্ষেত্রে ভারত শীর্ষে রয়েছে- শুধুমাত্র ২০২২ সালেই ৯৮,৩৩৭ জন মারা গেছেন। পাকিস্তানে প্রতি বছর কমপক্ষে ২৫,০০০ থেকে ৯০,০০০ নতুন স্তন ক্যান্সারের ঘটনা ঘটে, তবে আনুষ্ঠানিক রেজিস্ট্রির সীমাবদ্ধতার কারণে প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত উচ্চতর। তবে আমাদের দেশে স্তন ক্যানসার এর রোগীর সঠিক সংখ্যাটি আরো বেশী হবে বলে আমার ধারণা। কারণ আমাদের যেহেতু জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রী নাই তাই সঠিক সংখ্যাটি বলা কঠিন। উপরে বর্ণিত বাৎসরিক স্তন ক্যানসারের সংখ্যা বাংলাদেশের ব্যাপারে অনেকটা অনুমাননির্ভর। সঠিক সংখ্যা জানতে হলে স্ক্যানসার রেজিস্ট্রীর ব্যাপারে কাজ শুরু করা
স্তন ক্যানসারের রোগীর চিকিৎসা সাধারণত একজন ডাক্তারের পক্ষে করা সম্ভব হয় না। এর চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। কোন কোন ক্ষেত্রে একটিভ চিকিৎসা ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। হরমোন থেরাপি পেলে কমপক্ষে ৫ বছর চিকিৎসা নিতে হয়। স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা একটি সমন্বিত প্রোগ্রামের মাধ্যমে মালটিডিসিপিল্নারী টিমের সমন্বয়ে ধাপে ধাপে করা হয়ে থাকে। এই টিমের সদস্যারা হলেন ব্রেস্ট সার্জন, মেডিকেল অনকোলজিস্ট, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট ও রেডিওলজিস্ট।
ব্রেস্ট সার্জন হলো একজন সার্জারীর ডাক্তার, যার স্তন ক্যানসার সার্জারী করার যথাযথ ট্রেনিং আছে। সব সার্জন ব্রেস্ট ক্যানসারের সার্জারী করতে পারেন না। মেডিকেল অনকোলজিস্ট একজন স্পেসালিষ্ট ডাক্তার যিনি কেমোথেরাপির (ক্যানসারের ঔষধ) সাহায্য ক্যানসারের চিকিৎসা করে থাকেন। রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট রেডিয়েশণের সাহায্যে ক্যানসারের চিকিৎসা করে থাকেন। রেডিয়েশন দেওয়ার মেশিনের নাম লিনিয়ার এক্সেলেরেটর। এই মেশিনটি একটি অত্যন্ত জটিল একটি এবং ব্যয়বহুল মেশিন। বর্তমান বাজারে এই ধরনের একটি মেশিনের দাম ৩ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার।মোট কথা এই মেশিনটি একটি জায়ান্ট কম্পিউটার। রেডিয়েশন খালি চোখে দেখা যায় না। রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার এর জন্য বিভিন্ন রকমের রেডিয়েশন ডোজ সহ প্রেসক্রিপশন দিয়ে থাকেন এবং রোগের ধরন অনুযায়ী একটি ট্রিটমেন্ট প্লেন করে থাকেন। এই ট্রিটমেন্ট প্লানের কাজটি কম্পিউটারে একটি সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। ক্যানসারের ধরনের উপর ভিত্তি করে একটি প্লান করতে রেডিয়েশন অনকোলজিস্টকে ৩০ মিনিট থেকে ১২০ মিনিট সময় ব্যায় করতে হয়।
রেডিয়েশন অনকোলজিস্টের করা প্লান মোতাবেক লিনিয়ার এক্সেলেরেটর থেকে রেডিয়েশন কতটুকু ডেলিভারী হবে, কিভাবে হবে সেটা নিশ্চিত করার জন্য একজন মেডিকেল ফিজিসিস্ট এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট কোন ডাক্তার নয়। মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট মূলত ফিজিক্স-এ গ্রাজুয়েশন করে এমএসসি/ পিএইচডি করতে হয়। উন্নতবিশ্বে সব ম্যাডিক্যাল ফিজিসিস্টই পিএইচডি ডিগ্রীধারী।
বাংলাদেশে সরকারী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল ফিজিক্স বিষয়ে কোন আন্ডার গ্রাজুয়েট প্রোগ্রাম আছে বলে আমার জানা নেই। তবে বছর কয়েক আগে ডা. জাফরউল্লাহ স্যারের গণবিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল ফিজিক্স এর কোর্স চালু করেছেন। সরকারী বিশ্ববিদ্যালযের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ এই কোর্স চালু করার ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি। লিনিয়ার এক্সিলেটরের সাহায্য রেডিয়েশন ডেলিভারী করে চিকিৎসা সম্পন্ন করার জন্য রেডিয়েশন থেরাপি টেকনোলজিস্টদের ভূমিকা অপরিহার্য। বহিরবিশ্বে এমন কি ভারতেও এই ডিগ্রীটি একটি বিএসসি ডিগ্রী। রেডিয়েশন থেরাপি টেকনোলজিস্টে ভর্তির জন্য এইসএসসিতে বিজ্ঞানে ভালো জিপিএ থাকাটা আবশ্যিক।
বাংলাদেশে এইচএসসিতে বিজ্ঞানে ভালো জিপিএ যাঁরা পেয়ে থাকেন তারাই রেডিয়েশন থেরাপি টেকনোলজিস্টের ডিগ্রী নেওয়ার যোগ্য। কারণ এই কোর্সে এনাটমি, ফিজিক্স ও সায়েন্সের অনেক কোর্স পড়ানো হয় এবং পরবর্তীতে উনারা ৫ মিলিয়ন ডলারের মেশিনগুলো পরিচালনা করেন। রেডিয়েশন থেরাপি কোর্সের ভর্তির যোগ্যতা এবং কোর্স কারিকুলাম পরিবর্তন করা সময়ের দাবী।
লেখার শুরুতে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার কথা বলছিলাম। স্তন ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে নিরাময়ের সম্ভাবনা ৯৫ ভাগ থেকে শতভাগ। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করার একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে ম্যামোগ্রাম। এটি একধরনের এক্স রে মেশিন। ম্যামোগ্রামের সাহায্যে খুবই ছোট (১মিলিমিটার থেকে ৫ মিলিমিটার) আকারের টিউমার সনাক্ত করা সম্ভব। এই কাজটি করে থাকেন রেডিওলজিস্ট (এক্সরের ডাক্তার)। সাধারণত রেডিওলজিস্ট ম্যামোগ্রামের মাধ্যমে যদি কোন টিউমার দেখেন তখন আল্ট্রাসাউনড এর সাহায্যে একটি সুঁই এর মাধ্যমে টিউমারের কিছু অংশ নিয়ে আসেন। এই টেকনিককে বলা ‘কোর নিডল বায়োপ্সি’। তারপর বায়োপ্সি করা টিসুটি পাঠানো হয় প্যাথলজী ল্যাবে। সেখানে একজন প্যাথলজিস্ট যিনি স্তন ক্যানসার নির্ণয়ে পারদর্শী তিনি পুরো টিসুটি পরীক্ষা করে দেখেন এবং সঠিক একটি রিপোর্ট প্রদান করেন। প্যাথলজিস্টের এই কাজটি সম্পন্ন করতে ৪-৭ দিন সময় লাগে। প্যাথলজী রিপোর্টের সাথে সাথে অনেক সময় রোগীর সিটি স্ক্যান, বোন স্ক্যান এবং রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষাও করা হয়ে থাকে। বর্তমানে বায়পসি করার সময় টিউমারের পাশেই একটি মেটালিক মার্কার বসিয়ে দেওয়া হয়। এই মার্কার সার্জনকে গাইড করে অপারেশন করে টিউমার স্তন থেকে বের করে আনতে।
বর্তমান সময়ে প্যাথলজিস্ট শুধু যে ক্যানসার নিরূপন করেন তা কিন্তু নয়। সাথে সাথে ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রী পরীক্ষা করে কোষের ভেতর ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরনের রিসেপ্টর আছে কিনা সেটাও বলতে পারেন। এই রিসেপ্টরের উপস্থিতির ভিত্তিতে স্তন ক্যানসারের পরবর্তী চিকিৎসা নির্ভর করে। এছাড়াও বিশেষ একধরনের প্রোটিন (এইচইআর-২)এর উপস্থিতিও জানা দরকার হয় চিকিৎসার প্রোটোকল নির্ধারণের জন্য। জিনগত সমস্যা নির্ধারণের জন্য নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং টেস্ট করা হয়। এই টেস্টটি বর্তমানে বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট ল্যাব (টিএমএসএস বায়োমলিকিউলার ল্যাব, বগুড়া) সাশ্রয়ী মূল্যে করে থাকেন। এনজিএস টেস্ট ভারতীয় ল্যাব এর মাধ্যমে করালে খরচ ১ লক্ষ্য টাকার মতো হতে পারে।
প্যাথলজী ও অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু হয়। বর্তমানে সারা দেশে স্তন ক্যানসারের সমন্বিত কোন চিকিৎসা আছে বলে জানা নাই। এমনকি দেশের মাদার ইনিস্টিটিউট ‘বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল’ এ ও এই ধরনের কোন ওয়ান স্টপ সার্ভিস এখনো শুরু হয় নাই। দেশের সব মেডিকেল কলেজে কমপক্ষে একটি করে ম্যামোগ্রাম মেশিন স্থাপন করা জরুরি এবং এর সাথে স্তন ক্যানসার কেয়ার প্রোগ্রামও চালু করতে হবে। ঠিক তেমনিভাবে প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর প্যাথলজী বিভাগে ব্রেস্ট ক্যানসার সনাক্ত করার এবং রিপোর্ট করার যাবতীয় টেকনোলজি সরবরাহ করা সরকারের দায়িত্ত। টিচিং হাসপাতালে উন্নত মানের প্যাথলজি ল্যাব না থাকলে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে দেওয়া যায় না।
বর্তমানে সারা দেশে ব্রেস্ট সার্জনের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কম। তেমনি ভাবে রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট ও মেডিকেল অনকোলজিস্ট এর সংখ্যাও কম। সারা দেশে ৮টি বিভাগীয় ক্যানসার সেন্টার নির্মানাধীন, এর কাজ শেষ হলে আশা করি প্রয়োজনীয় সমস্ত ক্যানসার সার্ভিস দেশবাসী একই ছাঁদের নীচে পাবে। এই ক্ষেত্রে আমি মনে করি দেশের সরকারী এবং বেসরকারী বিশেষজ্ঞ ব্রেস্ট সার্জন,রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, মেডিকেল অনকোলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট এবং প্যাথলজিস্ট সবাই মিলে একটি সমন্বিত ব্রেস্ট ক্যানসার কেয়ার প্রোগ্রাম শুরু করা উচিত। কারণ এই ধরনের প্রোগ্রামের সুফল যেকোন সময় ধনী-গরীব নির্বিশেষে আমাদের কারো না কারো উপকারে আসবে।
ক্যানসারের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। আমাদের একটি জাতীয় ক্যানসার কেয়ার ফান্ড গঠন করা জরুরি। যেই ফান্ডে প্রতিটি নাগরিক ১৮ বছর বয়স থেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত মাসিক ১০ টাকা করে জমা দিবেন এবং কারো ক্যানসার হলে ক্যানসার কেয়ার ফান্ড থেকে সমস্ত খরচ বহন করা হবে। আর কতকাল বাংলাদেশের মানুষ ভারত, সিংগাপুর , থাইল্যান্ডে যাওয়া আসা করবে ক্যানসারের চিকিৎসা পেতে? এর অবসান হওয়া অতীব জরুরি।
লেখক: রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, সেইন্টজন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউব্রান্সউইক, কানাডা।
পূর্বকোণ/ইবনুর