চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ও গাজার অবরোধ: মানবতার নৌযাত্রা বনাম আগ্রাসনের দেয়াল

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ও গাজার অবরোধ: মানবতার নৌযাত্রা বনাম আগ্রাসনের দেয়াল

আবসার মাহফুজ

৭ অক্টোবর, ২০২৫ | ৩:৫১ অপরাহ্ণ

অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আজ যে মানবিক বিপর্যয় চলছে, তা কেবল একটি ভূখণ্ডের দুর্ভাগ্য নয়, বরং সমকালীন সভ্যতার ব্যর্থতার নির্মম প্রতিচ্ছবি। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে অবরুদ্ধ এই ক্ষুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ও ঘেরাটোপে মানবজীবন এতটাই অসহায় হয়ে পড়েছে যে আজ সেখানে খাদ্য, পানি, ওষুধ, বিদ্যুৎ- সবই নিয়ন্ত্রিত মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। দুই বছরের ধারাবাহিক ইসরায়েলি হামলায় ৬৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা রেড ক্রস বারবার সতর্ক করেছে যে, গাজা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনীতির নিষ্ক্রিয়তা ও ভণ্ডামির কারণে সেই বিপর্যয় প্রতিদিন আরও গভীর হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা কেবল খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নয়, বরং বিশ্বমানবতার এক প্রতীকী নৌযাত্রা।

 

ফ্লোটিলা শব্দটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ‘মাভি মারমারা’ ঘটনার কথা, যখন তুরস্ক থেকে গাজাগামী একটি ত্রাণবাহী নৌযান বহরে ইসরায়েলি সেনারা হামলা চালিয়ে নয়জন মানবাধিকারকর্মীকে হত্যা করেছিল। সেই থেকে আন্তর্জাতিক সমাজ বুঝে গিয়েছিল- ইসরায়েল গাজার অবরোধকে শুধুই সামরিক কৌশল নয়, বরং রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নতুন অধ্যায়। এবার ৪৪টি নৌযানে ৫০০-র বেশি মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সংসদ সদস্য একত্রিত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা থেকে মানুষ এই যাত্রায় যোগ দেন, তাদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শহিদুল আলমও। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল না, ছিল শুধু খাদ্য, ওষুধ এবং মানবতার পতাকা। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনী সেই পতাকাকেও ভয় পেয়েছে, কারণ এটি ছিল নীরব প্রতিবাদ- যা গোটাবিশ্বের সামনে অবরোধের নৃশংসতাকে উন্মোচন করছিল।

 

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ইসরায়েলি নৌবাহিনী একে একে সব নৌযান আটক করেছে এবং আশদোদ বন্দরে নিয়ে গেছে। সর্বশেষ আটক হয় পোল্যান্ডের পতাকাবাহী দ্য ম্যারিনেট। ইসরায়েল বলেছে, তারা ‘বৈধ নৌ অবরোধ’ কার্যকর করছে এবং এসব নৌযানে আসলে মানবিক সাহায্য ছিল না, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনো আন্তর্জাতিক আইন কি অবরুদ্ধ জনগোষ্ঠীর কাছে খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছানোকে অপরাধ বলে? ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের জেনেভা কনভেনশন স্পষ্টভাবে বলে- অবরোধ যদি বেসামরিক জনগণকে অনাহারে ফেলে দেয়, তবে তা যুদ্ধাপরাধ। জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আদালতের বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছেন, গাজার অবরোধ একটি ‘সমষ্টিগত শাস্তি’ যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ। সেক্ষেত্রে ফ্লোটিলা অভিযাত্রীরা অপরাধী নয়, বরং তারা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন।

 

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এই সত্যকে আরও স্পষ্ট করেছে। মালয়েশিয়া এ ঘটনাকে ‘জলদস্যুতা’ আখ্যা দিয়েছে। তুরস্ক বলেছে, ‘মানবিক সহায়তা ঠেকানো মানে হলো সরাসরি গণহত্যায় সহযোগিতা’। লেবানন থেকে ইরান পর্যন্ত নিন্দার ঝড় উঠেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কিছু সদস্য বলেছেন, এটি কেবল গাজা নয়, বিশ্বমানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। বাংলাদেশের ভেতরেও প্রতিবাদ হয়েছে। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলেছেন, এই অভিযান আসলে ইসরায়েলের ভয় দেখানোর কৌশল। তারা চায়, কেউ যেন আর গাজার মানুষের পাশে দাঁড়াতে সাহস না করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যতই ইসরায়েল বাধা দিক, ততই নতুন ফ্লোটিলার জন্ম হবে। কারণ এটি এক নৈতিক যুদ্ধ, যেখানে নিরস্ত্র মানুষ তাদের বিবেক দিয়ে লড়ছে।

 

উল্লেখ্য, ফ্লোটিলা অভিযাত্রার প্রতীকী নামই হলো ‘সুমুদ’। আরবি শব্দটির অর্থ ধৈর্য, দৃঢ়তা, প্রতিরোধ। ফিলিস্তিনি সমাজে এটি এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দর্শনে পরিণত হয়েছে। দখলদারিত্বের মাঝেও যে জীবনের প্রতি আস্থা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে অটলতা- তাই সুমুদ। সংগতকারণে ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ কেবল একটি নৌযাত্রা নয়, বরং বিশ্ববিবেকের এক ঘোষণা- আমরা অবরোধ মানি না, আমরা মানবিকতার পাশে দাঁড়াই।

 

তবে এও সত্য যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় এই ধরনের প্রতীকী উদ্যোগ তেমন বাস্তব সহায়তা পৌঁছাতে পারে না। ইসরায়েলের সামরিক ক্ষমতা, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ছত্রচ্ছায়া, পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিচারিতা- সব মিলিয়ে গাজার অবরোধ ভাঙা এখনো স্বপ্ন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বারবার প্রস্তাব আনা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো সেই প্রস্তাবকে অকেজো করে দিচ্ছে। আরব দেশগুলোর ভেতরও প্রকৃত ঐক্য নেই। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে, অন্যদিকে ইরান বা তুরস্ক সীমিত প্রতিবাদ জানালেও বাস্তব পদক্ষেপ খুবই সীমিত। ফলে ফ্লোটিলা অভিযাত্রার প্রতীকী শক্তি থাকলেও তা অবরোধ ভাঙতে সক্ষম হয়নি।

 

কিন্তু প্রতীকও অনেক সময় ইতিহাসে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে আন্তর্জাতিক বয়কট শুরু হয়েছিল প্রতীকী প্রতিবাদের মাধ্যমেই, পরে তা বিশ্বরাজনীতিকে বদলে দিয়েছিল। গাজার ক্ষেত্রেও হয়তো আজকের ফ্লোটিলাগুলো আগামী দিনের বৃহত্তর জনমত ও আন্তর্জাতিক চাপের বীজ বুনছে। ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ মানবিক যাত্রা ইসরায়েলি নগ্ন বাধায় ব্যর্থ হলেও এখন যাত্রা করছে ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ মানবিক যাত্রা। এভাবে একের পর এক পদক্ষেপ চলমান থাকবে। আর এসব পদক্ষেপের ভেতর দিয়ে বৈশি^ক জাগরণ সৃষ্টি হবে ক্রমশ মানবতার শত্রু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।

 

প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, সেটি হচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা। তারা এখনো নানা কৌশলে ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী তৎপরতাকে বৈধতা দেওয়ার ন্যারেটিভ তৈরি করে যাচ্ছে। ইসরায়েলের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম ও সরকারগুলোর এমন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ও ভূমিকা ইসরায়েলকে আরো পাশবিক আচরণে উৎসাহ যোগাচ্ছে। অথচ ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে যখন অবরোধের শিকার মানুষদের কথা বলা হয়, তখন মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন, শরণার্থীদের আশ্রয় সবকিছুর প্রতি সহমর্মিতা দেখানো হয়। কিন্তু গাজার ক্ষেত্রে উল্টো আচরণ, উল্টো যুক্তি ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা’। এই দ্বিচারিতা পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়া ও রাজনীতির নৈতিক দেউলিয়াত্বকে প্রমাণ করে। ফ্লোটিলা অভিযাত্রা আসলে এই ভণ্ডামিকে উন্মোচন করেছে।

 

আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানবিক নীতির সর্বজনীন প্রয়োগ। যদি ইউক্রেনের মানুষের জীবন মূল্যবান হয়, তবে ফিলিস্তিনিদের জীবনও সমান মূল্যবান। যদি কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা অপরাধ হয়, তবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করাও সমান অপরাধ। কিন্তু যতদিন এই সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে না, ততদিন গাজার মতো ট্র্যাজেডি চলতেই থাকবে। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা আমাদের সামনে সেই অমোঘ সত্যই তুলে ধরেছে।

 

আজ যখন আমরা এই নৌযাত্রার খবর পড়ি, তখন আমাদের চোখে ভেসে ওঠে কিছু সাহসী মুখ- যারা জীবন বাজি রেখে গাজার মানুষের জন্য রওনা হয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন সাংবাদিক, সংসদসদস্য, শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী। তারা জানতেন, হয়তো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন না, হয়তো আটক হবেন, এমনকি প্রাণও যেতে পারে। তবু তারা যাত্রা করেছেন। কেননা মানবতার লড়াইয়ে প্রতীকও শক্তি দেয়, আশা জাগায়। গাজার শিশুরা যখন শুনবে, পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তখন তারা হয়তো একটুখানি সাহস পাবে। আর সেই সাহসই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিরোধ হয়ে উঠবে।

 

ফ্লোটিলা অভিযান শেষ হয়নি। ইসরায়েল আটক করেছে জাহাজ, ফিরিয়ে দিয়েছে মানুষ, তবে দমাতে পারেনি বিবেককে। ইতিমধ্যে নতুন ফ্লোটিলার ঘোষণা এসেছে। বিশ্বজুড়ে সচেতন নাগরিকেরা অর্থ দিচ্ছেন, স্বেচ্ছাসেবক হচ্ছেন। এই ধারাবাহিকতাই প্রমাণ করে, মানবতা কখনো পরাজিত হয় না। হয়তো ধীর, হয়তো প্রতীকী, কিন্তু এর প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। গাজার অবরোধ আজ না ভাঙুক, ইতিহাস একদিন এই প্রতিরোধকেই বিজয়ী ঘোষণা করবে।

অতএব বলতেই হয়, ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ কেবল একটি নৌবহর নয়, এটি এক মানবিক মিছিল, যা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিশ্ববিবেককে জাগাতে চাইছে। ইসরায়েলের আগ্রাসন হয়তো কিছু সময়ের জন্য এটিকে থামাতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই প্রতিরোধই গাজার ভবিষ্যৎ মুক্তির বীজ রোপণ করছে। ধর্ম-বর্ণ-দেশ নির্বিশেষে বিশ্বের প্রতিটি ন্যায়পন্থী মানুষের কর্তব্য হলো এই প্রতিরোধে অংশ নেওয়া- হোক তা লেখনী দিয়ে, কূটনীতি দিয়ে, নৈতিক সমর্থন দিয়ে, কিংবা মানবিক সহায়তা দিয়ে। কারণ ফিলিস্তিনের প্রশ্ন আজ কেবল একটি ভূখণ্ডের প্রশ্ন নয়, এটি মানবতার প্রশ্ন। মানবতা রক্ষার এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট