চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

টিকটক নিয়ে মার্কিন-চীন টানাপোড়েন

নিরাপত্তা, রাজনীতি নাকি প্রভাবের যুদ্ধ?

ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, সম্পাদক

৫ অক্টোবর, ২০২৫ | ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম টিকটক এখন কেবল বিনোদনের নয়, বরং ভূ-রাজনীতিরও একটি ‘যুদ্ধক্ষেত্র’। যুক্তরাষ্ট্র সরকার চাপ দিচ্ছে, চীনা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্স (ByteDance) যেন টিকটকের মার্কিন অংশ বিক্রি করে দেয়। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপটি নিষিদ্ধ করা হবে। কিন্তু এই চাপের পেছনে কেবল তথ্যনিরাপত্তার কারণ নয়, রাজনৈতিক প্রভাব ও মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের বড় স্বার্থও কাজ করছে বলে বিশ্লেষকদের মত।

 

নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির অজুহাত
যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি, টিকটক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য চীনা সরকার ব্যবহার করতে পারে। তাই বাইটড্যান্সের মালিকানায় থাকা এই অ্যাপটি মার্কিন নাগরিকদের জন্য ‘নিরাপত্তা হুমকি’।
এছাড়া, টিকটকের মূল শক্তি তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক রেকমেন্ডেশন অ্যালগরিদম, যেটি ব্যবহারকারীর আগ্রহ অনুযায়ী ভিডিও সাজায়।
মার্কিন কংগ্রেসের নতুন আইন অনুযায়ী, বিদেশি শত্রু রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যুক্তরাষ্ট্রে চলতে পারবে না। তাই বিক্রি বা হস্তান্তরই এখন একমাত্র পথ।

 

গোপন উদ্দেশ্য: তথ্যপ্রবাহের দখল
তবে আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিশ্লেষকদের মতে, টিকটকের ওপর চাপের আরেকটি অঘোষিত উদ্দেশ্য আছে, মার্কিন জনমত নিয়ন্ত্রণ।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ প্রযুক্তি বিনিয়োগকারী ল্যারি এলিসন (ওরাকল’র সহপ্রতিষ্ঠাতা) এবং তাঁর ছেলে ডেভিড এলিসন এখন টিকটক মার্কিন শাখা কিনে নেওয়ার আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এলিসন পরিবার দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলপন্থী রাজনীতির অন্যতম বড় আর্থিকদাতা। ফলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, টিকটক যদি তাদের হাতে যায়, তবে এটি হতে পারে ‘জনমত নিয়ন্ত্রণের একটি নতুন হাতিয়ার’, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব ঠেকানোর জন্য।
গাজা যুদ্ধের পর মার্কিন তরুণ সমাজের মধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দ্রুত বাড়ছে। টিকটকেই সবচেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে সেই ভিডিও, প্রতিবাদ ও সচেতনতামূলক কনটেন্ট।
তাই, এই অ্যাপের নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তন মানে শুধু চীনের প্রভাব সরিয়ে দেওয়া নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে একটি নতুন প্রভাবমন্ডলীর হাতে তথ্যপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর।

 

চীনের অবস্থান: প্রযুক্তি বিক্রি নয়
বাইটড্যান্স এবং চীনা সরকার স্পষ্ট জানিয়েছে, টিকটকের মূল প্রযুক্তি, বিশেষ করে অ্যালগরিদম তারা বিক্রি করবে না।
কারণ চীনের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী ‘ডেটাভিত্তিক তথ্যপ্রবাহ বা ব্যক্তিগতকৃত সুপারিশ অ্যালগরিদম’ জাতীয় প্রযুক্তি বিদেশে বিক্রি বা হস্তান্তর নিষিদ্ধ। প্রয়োজনে বাইটড্যান্স যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক বন্ধ করে দেওয়ার কথাও ভাবছে।

 

সম্ভাব্য সমঝোতা
এখন আলোচনায় আছে এমন একটি প্রস্তাব- টিকটকের মার্কিন অংশের ৮০% মালিকানা যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের হাতে (Oracle ও Silver Lake) সব তথ্য সংরক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ হবে যুক্তরাষ্ট্রেই। চীনের কাছ থেকে কেবল অ্যালগরিদমের লাইসেন্স নেওয়া হবে। তবে, এই সমঝোতায় চীনের অনুমোদন প্রয়োজন, যা তারা এখনো দেয়নি।

 

চীনের বিকল্প পদক্ষেপ
চীন ইতিমধ্যে বিকল্প প্ল্যাটফর্মে মনোযোগ দিচ্ছে।
দৌইন (Douyin): টিকটকের চীনা সংস্করণ, যা দেশের অভ্যন্তরে পরিচালিত হচ্ছে।
লেমন৮ (Lemon8) ও শিয়াওহংশু (Xiaohongshu): চীনের নতুন অ্যাপ, যা বিদেশেও জনপ্রিয় হচ্ছে।এগুলো চীনের ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রস্তুতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। টিকটক নিয়ে এই দ্বন্দ্ব কেবল ব্যবসায়িক নয়, এটি এখন তথ্যযুদ্ধের নতুন অধ্যায়। যুক্তরাষ্ট্র বলছে-এটি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। অন্যদিকে চীন বলছে-এটি প্রযুক্তিগত সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন- এটি মূলত প্রভাবের যুদ্ধকে তরুণ প্রজন্মের মন ও মতামত নিয়ন্ত্রণ করবে।

 

টিকটকের মালিকানা পরিবর্তন মানে শুধু এক দেশের প্রভাব কমানো নয় বরং অন্য এক শক্তিশালী গোষ্ঠীর হাতে তথ্যপ্রবাহের দিকনির্দেশনা তুলে দেওয়া।
আজকের পৃথিবীতে, তথ্যই ক্ষমতা, আর সেই ক্ষমতার দখল নিয়েই লড়ছে ওয়াশিংটন ও বেইজিং।

শেয়ার করুন