চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি : কূটনৈতিক তাৎপর্য ও বৈশ্বিক দ্বিচারিতা

আবসার মাহফুজ

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ

ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অঙ্গন এখন এক নতুন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ফ্রান্স যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিল, তখন তা কেবল প্রতীকী পদক্ষেপ নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী মানবিক বিপর্যয় ও ন্যায়ের প্রশ্নে এক ঐতিহাসিক মোড় ঘোরানো পদক্ষেপ বলতে হবে। ইতালিসহ বিভিন্ন দেশেও জনগণ রাজপথে নেমে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করছে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ও গাজায় গণহত্যা বন্ধে ইসরায়েলের ওপর চাপ তৈরি করেত। জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫৪টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, অর্থাৎ বৈশ্বিক স্বীকৃতির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৯ শতাংশে। আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার প্রায় সব দেশই বহু আগেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে পশ্চিমা শক্তিগুলো দীর্ঘদিন দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। তারা ইসরায়েলের পক্ষে অন্ধ সমর্থক ছিলো। কিন্তু গাজায় নির্বিচারে গণহত্যার পর দেশগুলোর মধ্যে বিবেকবান মানুষদের চাপে সরকারগুলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করে। পশ্চিমা দুনিয়ার এই নতুন সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিন প্রশ্নকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক, সন্দেহ নেই। এর ফলে ইসরায়েলের ওপর চাপ তৈরি হবে। তবে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল ও গাজায় গণহত্যা বন্ধে এসব দেশের জোরোলো চাপ না থাকায় ইসরায়েল দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া খ্যাত অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল বিশ্বশান্তির জন্যে হুমকি হয়ে উঠছে।

 

পরিসংখ্যান বলছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে স্বীকৃতি সংখ্যা যত বাড়ছে, ইসরায়েল গণহত্যা এবং দখলদারিত্বও জোরদার করছে। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে আলজিয়ার্সে ফিলিস্তিন মুক্তি সংগঠন (PLO) আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার পরপরই ৭৮টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেখান থেকে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা দাঁড়িয়েছে ১৫৩-তে। অর্থাৎ গত সাড়ে তিন দশকে প্রায় দ্বিগুণ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে বৈধ মর্যাদা দিয়েছে। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ সদস্যের মধ্যে বর্তমানে ১৪টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, বাকি অংশ ধীরে ধীরে এই পথে হাঁটছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও স্পেনের মতো দেশগুলোর সা¤প্রতিক সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ক‚টনীতিতে এক বড় পরিবর্তনের সূচনা করেছে। প্রসঙ্গত, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির প্রভাব শুধু দেশসংখ্যায় নয়, জনসংখ্যাগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা এখন প্রায় ৮০০ কোটির কাছাকাছি। যে দেশগুলো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাদের মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ৬০০ কোটির বেশি। অর্থাৎ পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ মানুষ এমন রাষ্ট্রে বাস করছে, যারা ফিলিস্তিনকে বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির বড় অংশ এবং সামরিক জোট ন্যাটোর কেন্দ্রীয় দেশগুলো এখনো ইসরায়েলপন্থী অবস্থানে থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে আটকে রাখছে।

 

আবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সিংহভাগ দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে ও ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্য করার পক্ষে অবস্থান নিলেও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে তা হয়ে উঠছে না। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে ‘নন-মেম্বার অবজারভার স্টেট’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, যেখানে ১৩৮টি দেশ সমর্থন দিয়েছিল, ৯টি দেশ (যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইসরায়েল, চেক প্রজাতন্ত্র) বিরোধিতা করেছিল এবং ৪১টি দেশ বিরত ছিল। ওই ভোটে বিশ্বজনমতের স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্য হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়। এখানে ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভারসাম্যহীনতা প্রকট হয়ে ওঠে। তবে গাজার সা¤প্রতিক পরিস্থিতি, অর্থাৎ গাজায় ইসরায়েলের পৈশাচিক গণহত্যা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির নতুন ঢেউ সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ, ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৬৫ হাজার মানুষকে পাশবিক কায়দায় হত্যা করেছে ইসরায়েল, যাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। এছাড়া প্রায় ১২ লাখ মানুষ মারাত্মক খাদ্য সংকটে ভুগছে এবং ৭০ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত। এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পশ্চিমা দেশের জনমত ফুঁসে উঠেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সর্বশেষ ভোটাভুটিতে দেখা গেছে, ৪৫০ জন এমপি ফিলিস্তিন স্বীকৃতির পক্ষে ভোট দিয়েছেন, বিপক্ষে গেছেন মাত্র ৯০ জন। অর্থাৎ জনমত রাজনীতিকদের ওপর চাপ তৈরি করছে। ফলে তারা সরকারকে চাপ দিচ্ছে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের জন্য। ফলে বিবেকের তাড়নায় না হলেও জনমতের চাপে বাধ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করতে।

 

পশ্চিমা গণমাধ্যমের একটি অংশও এখন জনমতের চাপে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার খবর ছাপছে। আল জাজিরার মতো জনপ্রিয় বিশ^গণমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠতায় নানা সংবাদ বিশে^র বিবেকবান দর্শক-পাঠকের সামনে উপস্থাপনের কারণে এসব গণমাধ্যম কোণঠাসা হয়ে পড়ছে এখন। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণেও এখন সাধারণ মানুষ গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রকৃত চিত্র পেয়ে যাচ্ছে। ফলে পশ্চিমা মিথ্যাবাদী গণমাধ্যমগুলোর প্রতি জন-অনাস্থা তৈরি জনচাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছুটা হলেও বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশনের চেষ্টা করছে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট বা বিবিসির মতো প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো ইসরায়েলি বয়ানকে প্রাধান্য দিত। এখনন আল জাজিরাসহ বিভিন্ন নিরপেক্ষ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গাজার মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশিত হওয়ার পর তাদের সম্পাদকীয় নীতিতেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বিবিসি পর্যন্ত গাজার দুর্ভিক্ষকে ‘সধহ-সধফব ভধসরহব’ বা ‘ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ’ বলে অভিহিত করেছে। তবে তারা কৌশলে ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন করছে। ইসরায়েলি পৈশাচিকতাকে আড়াল করছে। ইসরায়েলি বয়ানকে প্রচার করছে। মার্কিন ও পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যম এখনো হামাসকেন্দ্রিক বয়ানকে অগ্রাধিকার দিয়ে ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে আড়াল করার অভিযোগ আছে। এই দ্বিচারিতা জনমতের আস্থায় ধাক্কা দিচ্ছে এবং ফিলিস্তিন প্রশ্নে পশ্চিমা দ্বৈতনীতি আরও উন্মোচিত হচ্ছে।

 

অন্যদিকে আরববিশ্বের অবস্থানও মিশ্র। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, জর্ডান, মিশরসহ প্রায় সব আরবদেশই ফিলিস্তিনকে বহু আগে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তারা একইসঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক জোরদার করেছে, গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জোরালো নয়। যা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে, ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য স্বার্থের প্রশ্নে তাদের অবস্থানকে দুর্বল করে। বিশেষ করে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের আব্রাহাম চুক্তির পর সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। তবে গাজার গণহত্যা সেই প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সৌদি আরবের রাজপরিবার এখনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনের পথে হাঁটতে সাহস পাচ্ছে না, কারণ গাজায় নেতানিয়াহু বাহিনীর গণহত্যা ও ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে ইহুদিবসতি বানানোর কারণে নিজ দেশের জনগণের মধ্যে প্রবল ফিলিস্তিনপন্থী জনমত বিরাজ করছে। কিন্তু তারা ইসরায়েলকে গণহত্যা বন্ধ করাসহ ফিলিস্তিনবিরোধী তৎপরতার অবসানে কার্যকর চাপ তৈরি করতে ব্যর্থ। এ ব্যাপারে আরবদেশগুলোর কোনো ঐক্য ও উদ্যোগ নেই বললেই চলে। আর এ সুযোগকে কড়ায়গণ্ডায় ব্যবহার করছে ইসরায়েল। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক আইনেও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির যৌক্তিক অবস্থান আছে। জাতিসংঘ সনদের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে মৌলিক নীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ছয়দিনের যুদ্ধে দখলকৃত পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক আদালতও বহুবার ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। তবু শক্তির রাজনীতির কারণে সেই রায় কার্যকর হয়নি। সে বিবেচনায় বলতে হয়, পশ্চিমা যে দেশগুলো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তারা আসলে কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং আইনগত দায়িত্ব পালন করছে।

 

এখন প্রশ্ন হলো, এত স্বীকৃতির পরও ফিলিস্তিন কেন রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারছে না? এর উত্তর নিহিত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ কৌশলে। যুক্তরাষ্ট্র বছরে প্রায় ৩৮০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তা দেয় ইসরায়েলকে, যা বিশ্বে সর্বাধিক। এর ফলে ইসরায়েল শুধু সামরিক শক্তিতে আধিপত্য বিস্তার করে না, বরং ফিলিস্তিনের ওপর পূর্ণ দখল বজায় রাখে। অপরদিকে ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিভাজন বিদ্যমান। গাজায় হামাস এবং পশ্চিম তীরে ফাতাহ- এই দ্বন্দ্ব ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে আরও দুর্বল করেছে। যদি অভ্যন্তরীণ ঐক্য জোরদার না হয়, তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও কাক্সিক্ষত ফল বয়ে আনতে পারবে না।

 

সব মিলিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির পক্ষে সমর্থন প্রদানকারী রাষ্ট্রের সংখ্যা দ্রুত বাড়ার বিষয়টি আশার আলো দেখালেও যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু প্রভাবশালী দেশ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় এবং গাজায় গণহত্যা বন্ধসহ ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী তৎপরতা থামাতে বৈশ্বিক উদ্যোগ না থাকা এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেও দ্বিচারী নীতি ধরে রাখার বিষয়গুলো হতাশার। যদিও পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ দেশ, প্রায় ৬০০ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী রাষ্ট্রগুলো যখন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে বৈধতা দেয়, তখন তা ইসরায়েলের বয়ানকে ভেঙে দেয় এবং বিশ্বরাজনীতিতে এক নৈতিক শক্তি তৈরি করে। কিন্তু ইসরায়েলের ওপর যুক্তিপূর্ণ চাপ তৈরিতে ব্যর্থতার কারণে বাস্তবে ফিলিস্তিনিরা আজও দখল, অবরোধ, অনাহার ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো এ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকলে এবং বিশ্বের মানবিক চেতনার মানুষদের রাজপথ কাঁপানো তৎপরতা দ্রæত না বাড়লে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে বিশ্বের বিপুল দেশ অবস্থান নিলেও তাদের স্বাধীনতা কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। সংগতকারণে এ ব্যাপারে বিশ^ব্যাপী একটি জোরালো আন্দোলন তৈরি জরুরি, যাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ সব পরাশক্তি ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো অভ্যন্তরীণ জনমতের চাপে বাধ্য হয় ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রতিরোধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে। এ ক্ষেত্রে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আধুনিক আরব রাজনীতি এবং বৌদ্ধিক ইতিহাসে’র খ্যাতিমান অধ্যাপক জোসেফ মাসাদ একটি দারুণ প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। তিনি মনে করেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির পরিবর্তে দেশগুলোর উচিত ইসরায়েলের স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেওয়া। ২৪ সেপ্টেম্বর মিডল ইস্ট আইতে প্রকাশিত তাঁর একটি প্রবন্ধে তিনি এ প্রস্তাব দেন। এটি একটি যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব। কারণ ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে বৃটিশ ও তার মিত্রদেশগুলো ও জাতিসংঘের সহায়তায় যেভাবে ইসরায়েলের জন্ম হয়েছে তা ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ। একইসঙ্গে দেশটি জন্মের পর থেকে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সহায়তায় ফিলিস্তিনিদের উৎখাত ও গণহত্যা চালাচ্ছে তাও চরম মানবতাবিরোধী। ইসরালেলের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোটাকিস সতর্ক করে বলেছেন, ‘‘গাজায় ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ অব্যাহত রাখলে ইসরায়েল তার অবশিষ্ট বন্ধুদেরও হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।’ গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে মধ্য-ডানপন্থি এই গ্রিক নেতা বলেন, ‘২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে, তবে ‘হাজারো শিশুর মৃত্যু কোনোভাবেই ন্যায্যতা পেতে পারে না’।’

 

কিন্তু ইসরায়েলের অন্যায় তৎপরতা পুরো মানবজাতির জন্য হুমকিপূর্ণ হলেও ইসরায়েলের ওপর প্রয়োজনীয় চাপ তৈরি হচ্ছে না। কিছু দেশ অস্তিত্বহীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, যার প্রায় পুরো অংশই ইসরায়েল গিলে ফেলেছে, তার স্বীকৃতির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দেশটিকে অস্তিত্ববান করতে এবং গাজাসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা বন্ধ করতে ইসরায়েলকে বাধ্য করা হচ্ছে না। এটি হতাশাজনক। তাই সত্যিই বিবেকের তাড়না থাকলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি ইসরায়েলকে গণহত্যা বন্ধসহ ফিলিস্তিনিদের সব দখলকৃত ভূমি ফেরত দিতে বাধ্য করতে হবে। এ জন্যে বিশ্বসম্প্রদায়ের ঐক্য জরুরি। কিন্তু প্রশ্নটি হচ্ছে, মুসলিমবিশ^, আরবলিগ, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবিক চেতনাধারী দেশগুলো কি এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে? তারা কি ইসরায়েলের রক্ষাকবচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থানন নিতে পারবে? মার্কিন সির্ভরতার কারণে কাজটি কঠিন হবে, সন্দেহ নেই। তবে আশার বিষয়টি হচ্ছে, প্রতীকী স্বীকৃতির পথ ধরে ফিলিস্তিন প্রশ্নে বিশ^সম্প্রদায়ের ঐক্য সুদৃঢ় হচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই ইসরায়েল ও তার দোসরদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছে। একদিন এ পথ ধরেই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র অস্তিত্বশীল হবে, সন্দেহ নেই। হয়তো ইসরায়েল নামের রাষ্ট্রটিও একদিন কর্মফল অনুযায়ী অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে।

 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রতীকী স্বীকৃতিও একদিন বাস্তব স্বাধীনতার ভিত্তি গড়ে তোলে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম প্রথমে প্রতীকী নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক চাপ দিয়েই শুরু হয়েছিল, যা শেষপর্যন্ত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে। একইভাবে ফিলিস্তিন প্রশ্নে আজকের প্রতীকী স্বীকৃতি ভবিষ্যতের পূর্ণ স্বাধীনতার বীজ বপন করছে, বলা যায়। আজকের এ পথ ধরেই একদিন বিশে^র রাজনৈতিক মানচিত্রে ভাস্বর হবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সদিচ্ছার ওপর। যুক্তরাষ্ট্র যদি তার ভেটো রাজনীতি চালিয়ে যায়, তবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আরও বিলম্বিত হবে। কিন্তু যদি বৈশ্বিক জনমতের চাপ, পশ্চিমা দেশের নতুন স্বীকৃতি ও আরববিশ্বের অভ্যন্তরীণ জনচাপ একসঙ্গে কাজ করে, তবে একদিন ফিলিস্তিন শুধু কাগজে নয়, বাস্তবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। তখন আজকের এই স্বীকৃতিগুলোই হয়ে উঠবে ইতিহাসের মোড় ঘোরানো মাইলফলক।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট