
বৃষ্টি নামার শব্দ একসময় ছিল বাংলা জনপদের প্রাণের সুর। নদীর ঢেউ, পাখির ডাক, কাদাজলের গন্ধ- প্রকৃতির এই খুশির ভাষাই ছিল জীবনের বুনন। কিন্তু আজ, এই ভাষা বদলে যাচ্ছে। বৃষ্টির ঘনঘটা অনেক সময়েই বন্যার আর্তনাদ, নদীর ঢেউ লবণজলের ধাক্কা, আর বাতাসের হিমে মিশে আছে বুকে জ্বালাধরার মতো ধুলো আর ধোঁয়া। মনে হয়, প্রকৃতি কাঁদছে। আর ভয় হয়, এই কান্না যেন শেষপর্যন্ত জাতির কান্নায় পরিণত না হয়। আমাদের সামনে যে জলবায়ু বাস্তবতা দাঁড়িয়ে গেছে, সেটি রোমান্টিক কোনো গল্পের বিষয় নয়; এটি অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, কৃষি, শহর-গ্রাম, সকল অবকাঠামোসহ আমাদের ভবিষ্যৎ টিকে থাকার প্রশ্ন।
২০২৪ খ্রিস্টাব্দকে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডগঙ) ১৭৫ বছরের রেকর্ডে সবচেয়ে উষ্ণবছর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বছরের গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পযুগের তুলনায় ১.৫ক্কসে-এর কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছিল; দশকের পর দশকজুড়ে উষ্ণায়নের ধারাবাহিকতা, মহাসাগরের তাপমাত্রা আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির রেকর্ড একসঙ্গে ধাক্কা দিয়ে গেছে আমাদের বাস্তবতাকে। এর অর্থ দাঁড়ায়, যে বিপর্যয়কে আমরা একসময় ভবিষ্যতের শঙ্কা বলে ভাবতাম, তা এখন বর্তমানের দিনলিপি। উষ্ণায়ন কেবল তাপমাত্রার স্কেলে ওঠানামা নয়; এটি পানিচক্রকে অস্থির করে দেয়, সাগরের তাপশক্তি সাইক্লোনকে আরও তীব্র করে, গ্লেসিয়ারের গলন থেকে সমুদ্রস্তর বৃদ্ধি- সব মিলিয়ে জীবন ও জীবিকা সংকটের চেইন রিঅ্যাকশন। এই বৈশ্বিক চিত্রের ভেতরে বাংলাদেশ যেন একটি সংবেদনশীল আয়না। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকার উচ্চতা পাঁচমিটারেরও কম; বর্ষায় নদী ও বর্ষার পানিযোগে প্লাবন সাধারণ ঘটনা, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতায় তা অতি-সঘন ও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ বলছে, পরবর্তী ৩০ বছরে জলবায়ুজনিত কারণে ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে স্থানান্তরিত হতে পারে; কৃষিতে জলবায়ু ভ্যারিয়েবিলিটি ও চরম আবহাওয়ার প্রভাবে ২০৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কৃষিজিডিপির এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। গড়ে প্রতিবছর ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। এই সংখ্যাগুলো শুষ্ক পরিসংখ্যান নয়; এগুলো গ্রাম ছাপিয়ে শহরের অস্থায়ী পল্লি, নীচুভূমির চিংড়িঘের, কিংবা নগরের ফুটপাথে ঘুমানো শিশুদের ভবিষ্যতের হিসাব।
বাংলাদেশের বাতাসও আজ স্বাস্থ্যের জন্য এক মৌনহুমকি। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের বৈশ্বিক পিএম২.৫ সূচকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বাধিক দূষিত দেশ হিসেবে উঠে এসেছে; ঢাকার বাতাস বহুদিন ধরেই ‘অস্বাস্থ্যকর’-অনেকদিন ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ মাত্রায় ওঠানামা করে। হাঁপানি, হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, শিশুদের ফুসফুসের বিকলাঙ্গতা- সব মিলিয়ে বাতাসের এই অদৃশ্য অসুস্থতা আমাদের উৎপাদনশীলতা থেকে শুরু করে হাসপাতালের বিছানা পর্যন্ত আরও অনিশ্চিত করে তুলছে। নির্মল বাতাস একসময় প্রকৃতির নিঃশুল্ক দান ছিল; এখন তা যেন বিলাস- যার মূল্য আমরা দিচ্ছি ওষুধে, রোগে, অকালমৃত্যুতে। উষ্ণায়নের সঙ্গে সঙ্গে ‘তাপঝুঁকি’ নতুন জনস্বাস্থ্যসংকটে রূপ নিয়েছে। ডব্লিউএইচও ও ডব্লিউএমওর যৌথ প্রতিবেদনে এসেছে- বিশ্বের ২.৪ বিলিয়ন শ্রমিক (বিশ্বশ্রমশক্তির ৭১ শতাংশ) তাপচাপের ঝুঁকিতে; প্রতিবছর কেবল কর্মক্ষেত্রে তাপজনিত আঘাত প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ এবং মৃত্যু প্রায় ১৯ হাজার। ২০ক্কসে (ডইএঞ) এর পর প্রতিটি অতিরিক্ত ডিগ্রিতে শ্রম-উৎপাদনশীলতা ২-৩% কমে। অর্থাৎ ইটভাটা, গার্মেন্ট, কন্সট্রাকশন, কৃষি- বাংলাদেশের শ্রমনির্ভরখাতে এটি হল বাজারে অদৃশ্য ‘গ্লোবাল ট্যাক্স’। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪-২৫-এর দক্ষিণ এশিয়ার তাপপ্রবাহ বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কসংকেত হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক অ্যাট্রিবিউশন গবেষণায় দেখা গেছে, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন এপ্রিল-মে ২০২৪-এর অতিরিক্ত তাপপ্রবাহকে আরও ঘন ও তীব্র করেছে; বাংলাদেশের মতো নাজুক অর্থনীতির মানুষেরা, বিশেষত অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক, রোহিঙ্গাক্যাম্প বা বস্তির বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ২০২৪-২৫ পর্যায়ে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ৪৪ দিন ‘চরম গরম’ নথিভুক্ত হয়েছে। এটি কেবল খবরের শিরোনাম নয়, বরং কৃষিক্ষেতের ফুল-ফসল, স্কুলে অনুপস্থিতি, হাসপাতালে ইমার্জেন্সির ভিড়, এবং বিদ্যুতের ওপর তীব্র চাপের একটি গোপন অর্থনীতি।
ঝড়ের দেশ বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই সাইক্লোন-শেল্টার, আগাম সতর্কতা, ক্ষয়ক্ষতির ব্যবস্থাপনায় বিশ্বদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবু ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ আবারও শিক্ষা দিয়ে গেছে, ঝুঁকি কেবল ‘ঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ’ নয়; এটি সমুদ্রের উঁচু জোয়ার, নদী-খাল ভাঙন, লবণাক্ততা, কৃষিক্ষেতের মাটির ক্ষতি, পানীয় জলের সংকট, বিদ্যুৎব্যবস্থার ভঙ্গুরতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহনশীল জীবিকা। রেমাল ১৯টি জেলায় ৪০ হাজারেরও বেশি ঘর পুরোপুরি এবং ১ লক্ষ ৩৩ হাজারের বেশি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করে; প্রায় ১৬ জনের প্রাণহানি, ৪-৫ ফুট পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস, লক্ষ লক্ষ মানুষের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা- সব মিলিয়ে একটি ‘মাল্টি-সিস্টেম শক’। এই যে ধারাবাহিক শক, এগুলোকে আমরা যদি বিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক ‘দুর্ঘটনা’ ভেবে ভুল করি, তাহলে নীতি-পরিকল্পনায়ও ভুল করব। বরং এটিকে দেখতে হবে, একটি ‘সিস্টেমিক রিস্ক’ হিসেবে, যার শিকড় রয়েছে জ্বালানি, অর্থনীতি, ভূমিব্যবস্থাপনা, শহরপরিকল্পনার জটিল জালে। আইপিসিসি-র (AR6) চূড়ান্ত সংশ্লেষ প্রতিবেদন আমাদের একদিকে জানায়, মানুষের কর্মকাণ্ডই ১.১ক্ক সে. উষ্ণায়নের মূল চালক; অন্যদিকে সতর্ক করে অভিযোজনের সীমা আছে, বিশেষত নিম্নভূমি ডেল্টা, উপকূল, দরিদ্রজনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। এদিকে ইউএনইপি-র ‘এমিশনস গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৪’ বলছে, যদি ২০২৪ থেকেই ২ক্ক সে. বা ১.৫ক্ক সে. লক্ষ্যে নামতে চাই, তবে ২০৩৫ পর্যন্ত বছরে গড়ে যথাক্রমে ৪% ও ৭.৫% করে বৈশ্বিক নিঃসরণ কমাতে হবে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি এই ঢাল বেয়ে নামার প্রস্তুতি নিয়েছি? আরেকদিকে, ‘অ্যাডাপ্টেশন গ্যাপ’ও ক্রমশ বড় হচ্ছে। ক্ষতি-ক্ষয় (Loss & Damage) ফান্ডিং নিয়ে বৈশ্বিক টানাপোড়েন যখন চলছে, তখন উপকূলের মাটি লবণে পোড়ে, বাতাসে বেআইনি ইটভাটার ধোঁয়া মেশে, শহরে উন্মুক্ত কংক্রিটের ‘হিট আইল্যান্ড’ ফুসে ওঠে, জলাধার-খাল দখলে যায়। বাংলাদেশের মতো দেশে অভিযোজনব্যয় কেবল বাঁধ-সেতু নয়, এটি স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সামাজিক সুরক্ষা জুড়ে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি গড়ার প্রশ্নও; যেখানে তথ্য-উপাত্ত, আগাম সতর্কতা, এবং স্থানীয় জ্ঞানকে সমন্বয় করতে হবে। UNEP/UN সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো বলছে, অভিযোজন অর্থায়নের ঘাটতি পূরণ না হলে ক্ষতির ঢেউ আরও উঁচু হবে। নগর বায়ুদূষণের কথা আলাদা করে বলা দরকার, কারণ এটি ‘নীরব মহামারি’। ইটভাটা, সড়কের ধুলা, নির্মাণকাজ, নিম্নমানের জ্বালানি, পুরোনো যানবাহন-সব মিলিয়ে নগরের ওপর ঢেকে থাকে অম্লাক্ত এক ধূসর পর্দা। IQAir-এর ২০২৪ তালিকা বলছে, বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বাধিক দূষিত দেশ; ঢাকার দৈনিক সূচকে ওঠানামা দেখলেই বোঝা যায়, সকাল-বিকাল আমরা কী নিঃশ্বাস নিচ্ছি। এই দূষণ কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়; এটি স্কুলছাত্রের মনোযোগ থেকে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা, পর্যটক আকর্ষণ থেকে বিদেশি বিনিয়োগ, সবখানেই ‘অদৃশ্য খরচ’ বাড়ায়। তাই বায়ুদূষণ কমানোর লড়াইটি ‘কতগুলো গাড়ি জব্দ’, এই প্রতীকী দৃশ্যের বাইরে নিয়ে ‘এয়ারশেড ম্যানেজমেন্ট’-এ তুলতে হবে। অর্থাৎ একটি সমন্বিত বায়ু-পরিসরের জন্য উৎসভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ, পর্যবেক্ষণ, এবং যৌথ শাসন জরুরি।
এখন প্রশ্ন হলো, কী করতে হবে? প্রথমত, ‘প্রতিরোধের বিজ্ঞান’কে (Prevention) পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে। বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ (BDP2100) ঠিক এই দর্শন থেকে- দীর্ঘমেয়াদি, সেক্টরসমন্বিত, বৈজ্ঞানিক, একটি রোডম্যাপ। সরকারের এই মেগা-পরিকল্পনা নদী, উপকূল, জলাভূমি, ভূমি-ব্যবস্থাপনা, কৃষি, নগর উন্নয়ন- সবখানে ইন্টিগ্রেটেড হস্তক্ষেপের কথা বলে; আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, জ্ঞানের আদান-প্রদান, আর স্থানীয় ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেয়। পরিকল্পনাটি কাগজে নয়, বাস্তবে কার্যকর করতে হবে। প্রকল্প বাছাইয়ে স্বচ্ছতা, বিনিয়োগে অগ্রাধিকার, ‘নেচার-বেইজড সলিউশন’ (NBS)-এর স্কেলিং, এবং সবচেয়ে জরুরি অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন। দ্বিতীয়ত, ‘তাপ-সহনশীল বাংলাদেশ’ গড়তে হবে দ্রুত। এর মানে- ক) জাতীয় ও স্থানীয় Hear Action Plan, আগাম সতর্কতা, স্কুল/কর্মক্ষেত্রের সময়সূচি সাময়িক সমন্বয়, ছায়াঘর, পর্যাপ্ত পানি ও প্রথমিক চিকিৎসা; খ) বিল্ডিং কোডে ‘কুল রুফ’, প্রাকৃতিক বায়ু চলাচল, ছায়া প্রদান; গ) নগরে বড় পরিসরে বৃক্ষরোপণ, জলাধার সংরক্ষণ- ‘ব্লু-গ্রিন’ ইন্ড্রাস্ট্রাকচার; ঘ) শিল্প-নির্মাণখাতে শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক বিশ্রাম-বিরতি, শীতলায়িত বিশ্রামকুঞ্জ, তাপঝুঁকি মূল্যায়ন ও প্রশিক্ষণ- যেমনটি WHO/WMO সুপারিশ করেছে। এগুলো শুধু জনস্বাস্থ্য নয়, উৎপাদনশীলতা ও অর্থনীতিরও সুরক্ষা। তৃতীয়ত, উপকূলে ‘অভিযোজন+জীবিকা’ মডেলকে প্রাতিষ্ঠানিক করতে হবে। শুধু বাঁধ উঁচু করলে হবে না, কারণ সমুদ্রের স্তর বাড়ার সঙ্গে সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাস নতুন ‘কম্বিনেশন শক’ তৈরি করছে। দরকার লবণ-সহনশীল ফসল, সমন্বিত পানিব্যবস্থাপনা (পোল্ডার-ভিত্তিক), মিঠাপানি ধরে রাখার প্রযুক্তি, ম্যানগ্রোভ পুনরুদ্ধার, ক্ষুদ্র-মৎস্যজীবীদের নিরাপত্তা-জাল, এবং বিপদপরবর্তী দ্রুত নগদসহায়তা। রেমালের ক্ষয়ক্ষতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঘরের টিন-টালির টেকসই ডিজাইন, উঁচু প্লিন্থ, পরিপাটি আশ্রয়কেন্দ্র-ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় নারীনেতৃত্ব- এসবের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। অর্জিত জ্ঞানের এই বিষয়গুলোকে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রোসিডিউর’-এ রূপ দিতে হবে। চতুর্থত, ‘নির্মল বাতাস’কে স্বাস্থ্যনীতির মূলধারায় আনতে হবে। পঞ্চমত, কৃষি-জল-জ্বালানিতে ‘স্মার্ট’ রূপান্তর। কৃষিতে জলবায়ু-স্মার্ট বৈচিত্র্য, মাইক্রো-সেচ, মাটির স্বাস্থ্য মানচিত্র, বীজব্যবস্থা, যা অতিবৃষ্টি-খরা উভয়েই টিকে থাকে। পানিসম্পদে, উজানে-ভাটিতে সমন্বয়, ক্যাচমেন্ট পুনরুদ্ধার, অবৈধ দখলমুক্ত খাল-জলাধার। জ্বালানিতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য, বিশেষ করে রুফটপ সোলার, এগ্রি-ভোল্টাইকস, সৌরসেচ, এবং বায়োগ্যাস/বায়োমাসের টেকসই ব্যবহার; ডিজেলভিত্তিক বিকল্প সরবরাহে ধাপে ধাপে ‘ডিম্যান্ড-সাইড ম্যানেজমেন্ট’। এসব রূপান্তরের গতি নির্ধারিত হবে নীতির স্বচ্ছতায়, ফিড-ইন ট্যারিফ, নেট-মিটারিং, এবং ‘জাস্ট ট্রানজিশন’-এর নিরাপত্তাজাল কতটা কার্যকর হয় তার ওপর। ষষ্ঠত, তথ্য-উপাত্ত ও বিজ্ঞান: আগাম সতর্কতা, ঝুঁকি মানচিত্র, আর আর্থ-অবজারভেশন ডেটা। জলবায়ু ও আবহাওয়ার যুগল-ঝুঁকি (Compound Risk) ধরতে উচ্চ-রেজোলিউশনের বৃষ্টিপাত, বন্যা, ভূমিধস, তাপ-সূচকের পূর্বাভাস স্থানীয় ভাষায় ও প্ল্যাটফর্মে সহজলভ্য করতে হবে। সপ্তমত, অর্থায়ন-ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বরাদ্দ বাড়াতে হবে বাজেটে; উন্নয়ন সহযোগিতায় অনুদান-মুখ্য, কনসেশনাল ঋণ-সহায়ক; সবুজ বন্ড, ব্লু বন্ড, ডায়াসপোরা বন্ড- নতুন উইন্ডো; পৌরসভার ‘ক্রেডিটওয়ার্দিনেস’ বাড়িয়ে জল-নিষ্কাশন/বর্জ্য/সবুজায়নে বিনিয়োগ করতে হবে। অষ্টমত, জলবায়ু আঘাতে নারী, শিশু, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রথম ধাক্কা খান। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তাপপ্রবাহের সময় নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি, গর্ভধারণজনিত জটিলতা, এমনকি সামাজিক সহিংসতার সাথে পরোক্ষ সম্পর্কের ইঙ্গিত উঠে এসেছে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে। তাই অভিযোজন প্রকল্পে নারী-নেতৃত্ব, সামাজিক সুরক্ষা, টার্গেটেড ক্যাশ ট্রান্সফার, এবং কেয়ার ইকোনমির হিসাবকে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার’-এর সমান গুরুত্বে দেখতে হবে। নবমত, স্কুলপাঠ্যক্রমে জলবায়ু-সাক্ষরতা, স্থানীয় প্রকৃতি-জ্ঞান, নদী-মাঠ-জলাভূমির সঙ্গে শিশুদের পরিচয় ঘটানোর উদ্যোগ থাকতে হবে। দশমত, পরিবেশ আদালতকে কার্যকর করতে হবে, পরিবেশ ছাড়পত্রে ‘প্রিন্সিপল অব নো রিগ্রেটস’ ঝুঁকির সামান্যতম ইঙ্গিত থাকলে প্রকল্পে পরিবেশগত বিকল্প নকশা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
প্রকৃতি আসলে ‘কাঁদে’ না; আমরা তার চক্র ভেঙে দিলে সে নতুন ভারসাম্য খোঁজে, যা আমাদের কাছে বিপর্যয় মনে হয়। সেই কারণে সমাধানও হতে হবে ‘প্রকৃতিকে বশ মানানোর’ মাধ্যমে নয়, ‘প্রকৃতির সঙ্গে মিটমাট করার, সমঝোতা করার মাধ্যমে। নদীকে বাঁধতে হলে তাকে চলার পথও দিতে হবে; শহরকে উঁচু করতে হলে শ্বাস নেয়ার সবুজ-ছায়া, পানি শুষে নেয়ার মাটি রাখতে হবে; শক্তি চাইলে আকাশের সূর্য, মাঠের বাতাসকে কাজে লাগাতে হবে। যেসব উন্নত দেশ কার্বন নিঃসরণসহ নানাভাবে প্রকৃতিকে বৈরী করে তুলছে, তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত গরীব দেশগুলোর জলবায়ু ক্ষতিপূরণে বাধ্য করতে হবে। আর প্রকৃতি রক্ষার লড়াইকে ‘প্রজন্মের লড়াই’ হিসেবে দেখতে হবে। আজকের শিশুটি যখন বড় হবে- সে যেন নদীর ঘ্রাণকে ভয় না পায়, বৃষ্টিকে আতঙ্ক না বলে, বাতাসকে ওষুধের মতো কিনতে না হয়। সে যেন জানে- তার বাবা-মা, তার বিশ্ববিদ্যালয়, তার পৌরসভা, তার দেশের নীতিনির্ধারকরা একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল- প্রকৃতির কান্নাকে থামাতে। সেই সিদ্ধান্তের নাম বিজ্ঞানভিত্তিক নীতি, ন্যায়ভিত্তিক রূপান্তর, এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির লেনদেনে নতুন সততা।