
গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনকে সরাসরি ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বনেতাদের সামনে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।
মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি গাজায় শিশুহত্যা, মানবিক বিপর্যয়, গণনিধন এবং আন্তর্জাতিক নীরবতার তীব্র সমালোচনা করেন। একইসঙ্গে তিনি গাজার একটি হাড্ডিসার শিশুর ছবি দেখিয়ে বলেন, এটি কোনো পরিসংখ্যান নয়, এটি মানবতার নির্মম পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি।
এরদোয়ান বলেন, গত ২৩ মাসে গাজায় প্রতি ঘণ্টায় একটি করে শিশু নিহত হয়েছে। তারা শুধু সংখ্যা নয়, তারা প্রত্যেকে মানুষ। গাজার বাসিন্দারা প্রতিদিন গড়ে ২৫ লাখেরও বেশি সংখ্যায় তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। শিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। মাত্র দুই বা তিন বছরের ছোট ছোট শিশুরা হাত-পা হারাচ্ছে, এবং সেটি এখন সেখানে এক ‘স্বাভাবিক’ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একপর্যায়ে তিনি জাতিসংঘে উপস্থাপন করেন একটি হৃদয়বিদারক ছবি, যেখানে একটি শিশু অপুষ্টির কারণে জীবন্ত কঙ্কাল হয়ে পড়েছে। ছবিটি তুলে ধরে এরদোয়ান প্রশ্ন করেন, কোনো বিবেক এই ছবি সহ্য করতে পারে? কোনো মানবতা এটিকে মেনে নিতে পারে? তিনি বলেন, এই পৃথিবীতে যখন কোনো শিশুর হাতে কাঁটা বিঁধে যায়, তখনও মা-বাবা কেঁদে ফেলেন। অথচ গাজায় অজ্ঞান না করেই শিশুদের হাত-পা কেটে ফেলতে হচ্ছে। এটি মানবতার সর্বনিম্ন স্তর।
গাজায় যা চলছে, তা কোনো যুদ্ধ নয় বলে মন্তব্য করেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। তার ভাষায়, ইসরায়েলি সেনারা সর্বাধুনিক ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করছে নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষদের ওপর। ৭ অক্টোবরের ঘটনার অজুহাতে ইসরায়েল যে অভিযান চালাচ্ছে, তা কোনো সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান নয়; এটি আসলে নির্বিচার গণহত্যা, নিপীড়ন ও পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ। তিনি বলেন, আমরা ইতিহাসের এক ভয়াবহতম বর্বরতা প্রত্যক্ষ করছি— সরাসরি সম্প্রচারিত গণহত্যা, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
এরদোয়ান আরও বলেন, ইসরায়েল এখন আর শুধু গাজা বা পশ্চিম তীরেই সীমাবদ্ধ নেই; তারা আক্রমণ চালিয়েছে সিরিয়া, ইরান, ইয়েমেন, লেবানন ও কাতারে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, ইসরায়েল সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। তিনি বলেন, এসব হামলা প্রমাণ করে যে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শান্তি চান না, এমনকি বন্দিদের মুক্ত করতেও তার কোনো আগ্রহ নেই।
তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলি হামলায় শুধু জীবনহানি নয়, ধ্বংস হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। নারী ও শিশুর অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদ করার অধিকার, সমতা ও ন্যায়বিচার— সবই চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। তিনি এ অবস্থাকে মানবাধিকারের সর্বাত্মক বিপর্যয় হিসেবে বর্ণনা করেন।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এরদোয়ান বলেন, যারা এখনো স্বীকৃতি দেয়নি, তাদের আর দেরি না করে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এর মাধ্যমে তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি ন্যূনতম ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে।
তার ভাষায়, গাজায় যুদ্ধ নয়, বরং একতরফা দখলদারিত্ব এবং গণহত্যা চালানো হচ্ছে। তাই এখনই অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হবে, ইসরায়েলি হামলা বন্ধ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন, এই গণহত্যার জন্য যারা দায়ী, তাদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় এনে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে। এবং এটি শুধু দাবি নয়, এটি ঘটবেই। সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি
পূর্বকোণ/এএইচ