
জাতিসংঘের বয়স এ বছর ৮০। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যে প্রতিষ্ঠান মানবজাতিকে নতুন আশার আলো দেখিয়েছিল, আজ তার অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। ইউক্রেন, গাজা ও সুদানের যুদ্ধ জাতিসংঘের অসহায়ত্বকে নগ্নভাবে উন্মোচিত করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো রাজনীতি, যুক্তরাষ্ট্রের অনাগ্রহ, আর আমলাতান্ত্রিক অকার্যকারিতা মিলিয়ে জাতিসংঘ আজ প্রায় দর্শকের ভূমিকায় নেমে এসেছে।
মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের নিন্দা করে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এটি নৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনগতভাবে অগ্রহণযোগ্য।’ কিন্তু বিশ্ব শক্তিগুলো কর্ণপাত করছে না। এক সময় জাতিসংঘ মহাসচিবের কণ্ঠ বিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনিত হতো, আজ তা উপেক্ষিত। এ যেন নৈতিক শক্তির পতন।
মূল সংকট নিরাপত্তা পরিষদের স্থবিরতা। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ আন্তর্জাতিক নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলাকে ভেঙে দিয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ্যে জাতিসংঘকে অপ্রাসঙ্গিক বলে আখ্যা দিচ্ছে। এমনকি কংগ্রেসে জাতিসংঘ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের প্রস্তাব উঠেছে। অর্থাৎ যেই দেশ জাতিসংঘের জন্মদাতা, সেই দেশই এখন এটিকে পরিত্যাগের পথে।
অভ্যন্তরীণ সমালোচনা নতুন নয়। কেউ জাতিসংঘকে পশ্চিমা স্বার্থরক্ষাকারী বলে মনে করে, আবার উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোগ তোলে পশ্চিমাদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের। একই সঙ্গে ৪০ হাজারেরও বেশি কর্মসূচির ভারে জাতিসংঘ এখন এক অদক্ষ আমলাতান্ত্রিক দানবে পরিণত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে সংস্কারের ঘোষণা এসেছে ‘UN80’। এতে বাজেট ও কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এতে জাতিসংঘ কার্যকর না হয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। লীগ অব নেশনসের মতোই এটি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে চলে যেতে পারে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, জাতিসংঘ আসলে কী করবে? কেউ বলছেন শান্তি ও নিরাপত্তায় মনোযোগ দেওয়া জরুরি, কেউ বলছেন টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবিক প্রতিশ্রæতি ছাড় দেওয়া যাবে না। বাস্তবে জাতিসংঘ তিনটি স্তম্ভ- শান্তি, উন্নয়ন ও মানবাধিকার একসঙ্গে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু অর্থাভাব ও রাজনৈতিক অনিচ্ছা মিলিয়ে বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে উঠছে।
জাতিসংঘের সামনে আরেকটি বড় পরীক্ষা আগামী মহাসচিব নির্বাচন। সমালোচকেরা মনে করেন, সাম্প্রতিক দুই মহাসচিব অতিমাত্রায় সতর্ক ছিলেন। এখন প্রয়োজন একজন সাহসী ও সক্রিয় কূটনীতিক, যিনি বিশ্বকে আবার জাতিসংঘের দিকে তাকাতে বাধ্য করবেন। কিন্তু ভেটোধারী শক্তিগুলো এমন কাউকে সমর্থন করবে কি না, তা নিয়েই সংশয়।
জাতিসংঘ আজ ‘হাঁটতে থাকা মৃতদেহ’ এমন মন্তব্য করেছেন এক প্রাক্তন কর্মকর্তা। কিন্তু মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর আগে এখনও সম্ভাবনা রয়ে গেছে। যদি সত্যিই রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, তবে জাতিসংঘ নতুন কাঠামো ও উদ্দেশ্য নিয়ে বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর হতে পারে। অন্যথায় এটি ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে, আর মানবজাতি হয়তো হারাবে বহুপাক্ষিকতার সর্বশেষ প্রতীকটিও।