চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

সিনেমার কালো অধ্যায়, এক টিকিটে ‘দুই ছবি’
নগরীর সুগন্ধা সিনেমা হল

চট্টগ্রামের সিনেমা হল

সিনেমার কালো অধ্যায়, এক টিকিটে ‘দুই ছবি’

অনুপম চৌধুরী

২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের প্রথম সিনেমা হল লায়ন, বছর-দশেক আগে বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় হল ছিল রঙ্গম, কোর্ট বিল্ডিংয়ের মূল ফটকের ঠিক উল্টোদিকে। মালিকানা পরিবর্তনের সঙ্গে নামও পরিবর্তন হতে থাকে। রঙ্গমের প্রথম নাম ছিল লোটাস, পরে জুবিলী, তারপর ১৯৩৮ সালে হয় নিরালা। এর কিছুদিনের মধ্যে হাতবদল হয়ে নামকরণ হয় রঙ্গম। এটাও ইতোমধ্যে বন্ধের তালিকায় চলে গেছে।

 

নগরের তৃতীয় হল ‘সিনেমা প্যালেস’। যা ১৯৪০ সালে যাত্রা শুরু করে এখনও টিকে আছে। চতুর্থ সিনেমা হল ছিল লালদীঘির পাড়ে ‘খুরশীদ মহল’। মালিক ছিলেন আহমদ ছগির চৌধুরী। এখন ওই জায়গায় মহল কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে।

 

ছগির চৌধুরীর শ্বশুর ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন, যার নামে বর্তমান রিয়াজ উদ্দিন বাজার। তিনি একটা সিনেমা হল করলেন বানিয়াটিলাতে (পুরাতন রেল স্টেশনের বিপরীতে), নাম ছিল ‘উজালা’।

 

১৯৬৭ সালে নগরে টুইন হল ‘আলমাস’ ও ‘দিনার’ চালু হয়। এটাই ছিল চট্টগ্রামের প্রথম আধুনিক সিনেমা হল। মালিক ছিলেন একজন অবাঙালি। তার মেয়ের নাম ছিল-আলমাস আর ছেলের নাম দিনার। তাদের নামে দুটি হলের নাম রাখা হয়। এটি ২০২০ সালে বন্ধ হয়ে যায়। আলমাসে দর্শকের আসন ছিল ৬০০ এর ওপরে। আলমাসে বাংলা ছবি চললেও দিনারে চলত বিদেশি ছবি।

 

স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম সিনেমা হল নিউমার্কেটের বিপরীতে ‘জলসা’। ১৯৭৩ সালে চালু হওয়া আধুনিক বাংলা নামে সিনেমা হল। জলসা-তে প্রথম ‘স্বীকৃতি’ নামে একটি ছায়াছবি প্রদর্শিত হয়। এই সিনেমা হলের ওপরে ‘সিটি হল’ নামে আরেকটা সিনেমা হল প্রস্তুত করা হলেও নানা কারণে বাণিজ্যিকভাবে চালু করা যায়নি। ১৯৭৪ সালে গুলজার মোড়ে চালু হয় ‘গুলজার’। স্টেশন রোডে চালু হয় ‘নূপুর’। ‘নূপুর’ হলের ওপর তলায় চালু হয় ‘মেলোডি’। ‘মেলোডি’তে বিদেশি ছবির প্রদর্শন হত। আগ্রাবাদে চালু হয় আরও পাঁচটি সিনেমা হল- ‘বনানী কমপ্লেক্স’, ‘সানাই’, ‘উপহার’, ‘সাগরিকা’ ও ‘রিদম’।

 

‘বনানী’ সিনেমা হলকে বলা হতো এশিয়ার স্বপ্নপুরী। জনশ্রুতি আছে, বনানী ছিল দেশের একমাত্র সবচেয়ে বড় হল। অনেকে যশোরের ‘মনিহার’কে বলত দেশের সবচেয়ে বড় হল। তবে ‘বনানী’তে দর্শকের আসন সংখ্যা ছিল ২ হাজার।

 

১৯৯৩ সালের বাংলা ভাষায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত নাট্য চলচ্চিত্র ছিল পদ্মানদীর মাঝি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। অভিনয় করেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, চম্পা, রূপা গঙ্গোপাধ্যায় ও উৎপল দত্ত।

 

এই ছবি প্রদর্শনীতে তারা সবাই চট্টগ্রামে আসেন। ওইসময় গৌতম ঘোষ বলেছিলেন, ‘বনানী কমপ্লেক্সের মত একটা সুবিশাল সিনেমা হলে যে আমার সিনেমা রিলিজ দেওয়া হল, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্মরণীয় ঘটনা’।

 

এই পাঁচটা হলের একটিও এখন অবশিষ্ট নেই। দর্শকের অভাবে একের পর এক বন্ধ হয়ে যেতে থাকে পূরবী, সানাই, আকাশ, নূপুর, চাঁদনী, কর্ণফুলী, উজালা, ঝুমুর, নেভী হল, গুলশান, শাহীন, অলংকার, আকাশ, বিডিআর হল, গ্যারিসন, ক্যান্টনমেন্ট, রুপালী, সংগীত, ঝংকার। এছাড়া বন্ধ হয়ে গেছে সীতাকুণ্ডের পরাগ, ফটিকছড়ির ঝংকার, পটিয়ার ছন্দা ও সবুজ, রাঙ্গুনিয়ার বনশ্রী ও বনলতা, বান্দরবানের বনানী ও খাগড়াছড়ির বনশ্রী।

 

লালদীঘির খুরশিদ মহল সিনেমা হল ভেঙে তৈরি হয়েছে মহল মার্কেট, স্টেশন সড়কের উজালা ভেঙে করা হয়েছে এশিয়ান এসআর হোটেল, আগ্রাবাদের বনানী ভেঙে করা হয়েছে বনানী কমপ্লেক্স, নিউমার্কেটের জলসা সিনেমা হলের জায়গায় হয়েছে জলসা মার্কেট। এভাবে লায়ন, গুলজার, নূপুর ও রঙ্গম সিনেমা হল ভেঙে করা হয়েছে বহুতল মার্কেট।

 

এক টিকিটে ‘দুই ছবি’ : ১৯৮৬-৮৭ সালে বাংলা সিনেমায় নেমে আসে ‘কালো মেঘ’। যাকে বাংলা সিনেমার কালো অধ্যায় বললেও ভুল হবে না। যা ছিল বাংলা সিনেমার জন্য এক প্রকার সুনামি। এক টিকিটে দুই ছবির প্রচলন শুরুর পর থেকে বলা চলে বাংলা সিনেমায় ধস নামা শুরু হয়। প্রথমে ২৫-৩০ মিনিট সিনেমা চলার পর বিরতি দিয়ে শুরু হতো ‘নীল ছবি’। প্রথমদিকে কম টাকায় বিদেশ থেকে এসব কাটপিস এনে চালানো হলেও পরে রাজধানী ঢাকাতেই তৈরি হতো ‘নীল ছবি’। এর ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি মোটামুটি হল ত্যাগ করল। প্রথমদিকে একেবারে হাউসফুল থাকলেও পরে দর্শক খরায় সিনেমা হল-ই বন্ধ হয়ে যায়। এর মাধ্যমেই দেশের বিনোদন জগতে অশ্লীলতা প্রবেশ করে।

 

চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সভাপতি শৈবাল চৌধুরী বলেন, ‘এক টিকিটে দুই ছবি বাংলা সিনেমার জন্য কালো অধ্যায়। সিনেমা হল বন্ধের অনেক কারণ থাকলেও এটাই ছিল প্রধান কারণ। যার ফলশ্রুতিতে হল মালিকরা প্রচুর দর্শক হারালো। সিনেমা হারাল তার শিল্প।’

 

সমালোচকরা যা বলছেন : প্রথমত ৯০ দশকের শেষ দিকে দর্শক কমতে থাকে। যার ফলে সিনেমা হল মালিকরা ভাবলেন, দর্শক টানতে হলে এক টিকিটে দুই ছবি দেখানোর অফার দিতে হবে। এজন্য গুণগত মান নষ্ট হলো। যেসব ছবির মান খারাপ, সেগুলোও জোড়া দিয়ে চালানো হতো। আয় কমে গেল। প্রযোজক-পরিবেশক এক ছবির জন্য আলাদা টাকা না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। হলমুখী দর্শক বিমুখ হলো। প্রথম ছবি হয়তো ভালো, দ্বিতীয়টা মানহীন থাকায় দর্শক বিরক্ত হয়ে পরেরবার আসতে চাইতো না। শেষ পরিণতিতে ভালো প্রযোজকরা সিনেমা বানানোই বন্ধ করে দেন। তখন নিম্নমানের ছবি, অশ্লীলতা আর সস্তা নির্মাণে ভরে যায় ইন্ডাস্ট্রি। ফলে ‘এক টিকিটে দুই ছবি’ সিনেমা জগতের পুরো সিস্টেমটাই ভেঙে ফেলে। যার প্রেক্ষাপটতো সবার জানা।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট